Also read in

রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি-সেই মধ্যরাতের ভয় কিন্তু আজও তাড়া করে বাঙালিদের

এই শিরোনামটি পড়ে হয়তোবা অনেকেই ভাবছেন যে কিসের জন্য আমি এমন একটি শিরোনাম বেছে নিলাম। হয়তো আজকালকার নুতন প্রজন্ম এই শিরোনাম সম্পর্কে অজ্ঞ। হ্যাঁ,আমিও এই প্রজন্মেরই বটে, তবে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ইতিহাস কিছুটা হলেও জানি, জানি কিভাবে বাঙালিদেরকে তাদের নিজভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল যেটা একটি ঐতিহাসিক সত্য, কিভাবে রক্তের বিনিময়ে বরাকের বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করেছিল। কিন্তু উগ্রজাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীরা এইটুকুতে ক্ষান্ত না হয়ে বাঙালীদেরকে তাদের নিজভূমি থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত শুরু করেছে রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জিকে হাতিয়ার করে। তারা নাকি বলছে বরাকের মানুষ বাংলাদেশ থেকে আগত।আমার জানা মতে ভাষা সংঘাতের সৃষ্টি করেনা, বৈচিত্র্যের মধ্যেই যে ঐক্য রয়েছে সেটা ভারতের দর্শনশাস্ত্র বলে। আমার ভাষা একটা হতে পারে, আপনার আরেকটা হতে পারে, কিন্তু আপনিও তো একজন মানুষ, আমিও মানুষ, তাই মিলেমিশে থাকাটা কি শ্রেয় নয়? ভূপেন হাজারিকার তো একটি গানই রয়েছে “মানুষ মানুষের জন্যে”, অতএব যারা ভাষাকে মিলনের পুণ্যভূমি করার পরিবর্তে সংঘাতের সৃষ্টি করে তাদেরকে মানুষ বলে গণ্য করাটা উচিত হবেনা। যারা আজ বুক ফুলিয়ে নিজেদেরকে ভূমিপুত্র বলে দাবি করে, খোঁজ নিয়ে দেখবেন তারাও অন্য জায়গা থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন। মানব সভ্যতা অভিপ্রয়াণের সাক্ষী। পৃথিবীর প্রথম মানবসভ্যতার উৎপত্তি আফ্রিকা থেকে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, তবে কি শুধু আফ্রিকানরাই বৈধ নাগরিক পুরো পৃথিবীতে? নিশ্চই নয়। এখন আসা যাক এন.আর.সি প্রসঙ্গে-

আসামে এন.আর.সির (রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি) কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে রাজ্যের মেজাজ বিশেষ করে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় সবচেয়ে ভাল ক্ষেত্রে ‘উৎকণ্ঠিত’ এবং সবচেয়ে খারাপ ক্ষেত্রে ‘আত্মঘাতী’। আসামের প্রত্যেক বাঙালি ভীতিগ্রস্ত হয়ে গেছে, তারা ভয় পাচ্ছে যে তাদের বাংলাদেশি বানিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হবে, তারা নিজেদের নাম এন.আর.সি তে ঢোকানোর জন্য যেকোন কিছু করতে রাজি।হাইলাকান্দির একজন আবেদনকারীকে দূরে অবস্থিত নরসিংপুরের একটি সেন্টারে যেতে হচ্ছে যদিও হাইলাকান্দিতে অসংখ্য সেন্টার রয়েছে। কিসের জন্য নোটিসগুলি সময়মতো দেওয়া হচ্ছে না? কিসের জন্য তারক পালের নাম ‘তার কপাল’ লেখা হচ্ছে? এই সব অসঙ্গতি এবং আরো অনেককিছু বরাক উপত্যাকার বাসিন্দাদের রাত্র জাগরণের জন্য যথেষ্ট এবং তারা ঘুমোলেও দুঃস্বপ্ন তাদের আবার জাগিয়ে তুলছে।

এন.আর.সি প্রক্রিয়াটি আবেদনপত্র লেখার মাধ্যমে শুরু হয়। আবেদনপত্রগুলি পূরণ করাই একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল যা সাধারণ মানুষের কাছেই বোধগম্য ছিল না আর অশিক্ষিত মানুষদের কথা আর নাই বা বললাম। এবারে খতিয়ে দেখা যাক সমস্যাগুলো এবং তার জড় কতদূর বিস্তৃত।

১. জটিল আবেদনপত্র: সহস্র বাক্স এবং ১০০ টির মতো প্রশ্ন রয়েছে। একজনের সমস্ত বাক্সগুলো পূর্ণ করতে হবে।অনেক আবেদনকারী তাদের নাম পর্যন্ত লেখতে জানেনা। এমনকি শিক্ষিতদের কাছেও এন.আর.সি ফর্মগুলি পূরণ করা একটি খুবই কঠিন কাজ। এটার জন্য বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এনআরসি আবেদন পত্র পূরণ করার জন্য অর্থ লেনদেনের কথাও সামনে এসেছে…

২. কর্মঘন্টার সময় জমা দেওয়া: একবার আবেদনপত্র পূর্ণ করার জটিল প্রক্রিয়াটি শেষ করলে আপনার আবেদনপত্রটি নিকটবর্তী এন.এস.কেতে জমা দিতে হবে। তার জন্য আপনার নিজের দোকান বন্ধ করতে হবে এবং দৈনন্দিন আয়কে একদিনের জন্য খোয়াতে হবে। বরাক উপত্যকায় খুব কমসংখ্যক লোক চাকরি করে, বাকি সবাই ছোট দোকান চালাচ্ছে বা ব্যবসা অথবা দিন মজুরি করছে। এরই মধ্যে সবাইকে একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে আবেদনপত্রগুলি জমা দেওয়ার জন্য। অনেকের হয়তোবা একদিনের কাজ না করার মাসুল স্বরূপ ক্ষুধার্ত ঘুমোতে হবে।

৩. তালিকায় নাম না উঠা: এত কষ্ট করে আবেদনপত্র পূরণ করে জমা দেওয়ার পর যদি আপনি মনে করেন যে আপনার কাজ সেরে ফেলেছেন তবে আপনি ভুল করছেন… কারণ যখন প্রথম খসড়াটি মধ্যরাতের ঘন অন্ধকারে প্রকাশ পায় তখন বরাক উপত্যকা এবং বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মানুষেদের মাথায় প্রায় বাজ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। খুব কম নামই ছিল তালিকায়। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়াতে এক সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়।

৪. বংশবৃক্ষ যাচাই: সবচেয়ে জটিল এবং অসংগঠিত প্রক্রিয়ারগুলির মধ্যে একটি হলো এই বংশবৃক্ষ যাচাই।কেউ কেউ তো এই বংশবৃক্ষকে বিষবৃক্ষ বলে সম্বোধন করেছেন। বংশবৃক্ষ যাচাইয়ের জন্য এন.এস.কেতে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। সুতরাং আপনি এত দূর থেকে কেন্দ্রে যাবেন এবং কর্মকর্তারা আপনাকে একটি বা দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, তারপর একটি কাগজ আপনাকে দেবেন সই করার জন্য। এক হাজার মাইল অতিক্রান্ত করে আসার পর এটি একধরণের হেনস্থা। মুম্বাইয়ে কৃষকদের সমাবেশ দৈনিকগুলির শিরোনাম দখল করতে সক্ষম হয়, এনআরসি কেন্দ্রে যাতায়াত করাটা কয়েকজনের জন্য সমানভাবে ক্লান্তিকর কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যমের কাছে অলক্ষিত রয়ে যায়।

৫.এনআরসি কেন্দ্র: আপনার ঘরের পাশেই এন.আর.সি কেন্দ্র, কিন্তু আপনাকে ডাকা হবে বহু মাইল দূরে অন্য একটি সেবাকেন্দ্রে। যখন কোনও বিতর্ক দেখা দেয়, তখন আবেদনকারীর ঠিকানাতে নোটিশ পাঠানো হয় এবং নোটিশে উল্লেখ করা হয় সেই সেন্টারের নাম যেখানে গিয়ে আপনাকে উপস্থিত হতে হবে। হাইলাকান্দি আবাসিক এলাকার একটি বিবাদ নরসিংপুরের একটি কেন্দ্রেও মিটমাট হতে পারে যদিও হাইলাকান্দিতেও কেন্দ্র রয়েছে। আবেদনকারীকে কিসের জন্য এত দূরে যেতে হচ্ছে, এর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটা মনে রাখা উচিত যে সবাই পরিবহন ব্যয় বহন না করতে পেরে মাইলের পর মাইল হেঁটেও যেতে পারে …

6. নাম: শিলচরে শচীন টেন্ডুলকারে যে সেঞ্চুরিটি মারে সেটা গুয়াহাটিতে গিয়ে ‘চচীন’ হয়ে যায় যেহেতু অসমীয়া লিপিতে ‘শ’ নেই এবং সেটাকে ‘চ’ হিসাবে উচ্চারণ করা হয়। লিপিগুলির এই বিভ্রান্তির সঙ্গে কর্মচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এন.আর.সিতে গুরুতর বানান বিভ্রাটের জন্য দায়ী। কমপক্ষে ৮০ শতাংশ বাঙালিদের নামের বানান ভুল এবং আজ সেসব নাম সামাজিক মাধ্যমে ‘মেমস’ হিসাবে ছড়িয়েছে। একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হল তারক পাল, এটি একটি সাধারণ বাংলা নাম, যেটা খসড়াতে ‘তার কপাল’ হয়ে গিয়েছে, এটি অনেকের কাছে হাস্যকর বিষয় হলেও মানুষটি অবশ্যই দুঃস্বপ্ন দেখছেন কিংবা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই বানান বিভ্রাট।

৭. জাল বা আসলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই: যারা জাল লিগাসি তথ্য, বংশবৃক্ষ দিয়েছেন এবং যারা সঠিক দিয়েছে্ন তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। উভয়ের সঙ্গে একই ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্তত ভারতের কোথাও তো আমরা শেষমেশ সমতা পেলাম… অপরাধী ও নির্দোষের সঙ্গে একইভাবে আচরণ করাটা কাম্য নয়। জালিয়াতিতে লিপ্ত ব্যক্তিটি প্রকৃত তথ্য দেওয়া ব্যক্তিটির জীবন কঠিন করে তুলে …

8. নোটিশ: নোটিশ হল একজন মানুষকে একটি ঘটনা সম্বন্ধে ঘটনাটির আগে জানানো, যাতে ব্যক্তিটি নোটিশ পেয়ে ভালো করে প্রস্তুত হয়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারে। এনআরসি প্রক্রিয়ায় এটির সম্পূর্ণ ভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। আপনি আজ একটি নোটিশ পেতে পারেন যে আপনাকে আগামীকাল ১০০ মাইল দূরে একটি কেন্দ্রে যেতে হবে। কোনো নোটিশই সময়মতো দেওয়া হয়না যার জন্য মানুষদের মধ্যে গুরুতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।

৯. গৃহবধূদের সংকট : প্রায় ২৯ লাখ গৃহবধূকে সেন্টারে যাওয়া এবং আসার কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। যারা পঞ্চায়েত সার্টিফিকেট এবং সার্কেল অফিসার সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন তাদের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট অফিসারের কাছে সশরীরে উপস্থিত হতে হবে।

১০. ডিটেনশন ক্যাম্প না বাংলাদেশ?: সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ এটা!!!… বিদেশি ঘোষণা করার ভয়টাই সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন যার জন্য মানুষ নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন। ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা সবারই জানা, ডিটেনশন ক্যাম্পের অনেক মানুষই যে ভারতীয় এরকম খবরও এসেছে এবং তারা আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রের শিকার।

কি হবে শেষপর্যন্ত সেটা কেউ বলতে পারবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে যেটা হচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই ঠিক হচ্ছে না। ভারতীয়দেরকেও যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে।

Comments are closed.