Also read in

দু’হাজার কুড়ির উনিশ

এমন একটা উনিশের কথা আমরা কখনো কল্পনাও করি নি। শিলচর ছেড়ে এসেছি আজ ১৩ বছর হল। এই ১৩ টি বছর ধরে উনিশ এলেই শিলচরে যাই। কেমন একটা মন্ত্রতাড়িতের মত যাই। খুব অনুশাসন মেনে যাই তা নয়। একটা যেন নিশির ডাক আমাকে টেনে নিয়ে যায় শিলচরে, উনিশের শিলচরে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় সময়। কখনো শিলচর রেলস্টেশন, কখনো উধারবন্দ, কখনো শিলচর শ্মশানঘাটে। খুব একটা পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান থাকেই তেমন নয়। উনিশের শিলচরে ঘটা করে আমাকে কেউ আমন্ত্রণও করে না। পৌঁছে গেলে কখনো কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিই। কখনো গান গাই। কখনো দুটো কথা বলি। কখনো কিছুই করি না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকি। উনিশের উত্তাপ নিই আশরীর। গতবছর নির্বাচন ছিল কলকাতায়। ফলে উনিশের শিলচর যাওয়ার টিকিট কাটা ছিল না। দু’দিন আগে আমার কন্যা বলল, বাবা, আমরা উনিশে শিলচর যাবো না? শেষ মুহূর্তে অনেকবেশি টাকা দিয়ে টিকিট কাটা হল। ভোটও দিতে হবে কলকাতায়। তাই কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ¯ স্নান সেরে আমরা ভোটকেন্দ্রের কাতারে পৌঁছে গিয়েছি। প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই ছিলাম। কত তাড়াতাড়ি ভোট দেওয়ার কাজ সেরে আমরা বিমানবন্দরে ছুটব সেই তাড়ায়। ভোটকেন্দ্রে পরিচিতজনেরা জিজ্ঞেস করলেন, কীসের এত তাড়া? উত্তরে বলি, আজ উনিশে, আমাদের বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ দিবস। শিলচর যেতে হবে। প্রশ্নকর্তা ফের জিজ্ঞেস করেন, অনুষ্ঠান আছে? গানের? উত্তরে বলি, না, কিছুই নেই। শুধু শহীদবেদীতে ফুল দেবো। প্রশ্নকর্তা অবাক। শুধু এজন্যে বিমানের টিকিট কেটে শিলচর যাবেন সপরিবারে? এতটা টাকা খরচ করে? তাঁর বিস্ময় দেখে আর খোলসা করি নি যে শেষ মুহূর্তে টিকিট করার জন্যে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি টাকায় কিনতে হয়েছে টিকিট। শিলচরে যখন পৌঁছেছি তখন বিকেল তিনটে। মেয়েকে বললাম, ব্যাগ সুটকেস রেখে আগে চল গান্ধীবাগ যাই। আর দেরি করলে গান্ধীবাগের জমায়েত হালকা হয়ে যাবে। উত্তাপ কমে যাবে। শহর শিলচরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মেয়ে বাবা পৌঁছে যাই গান্ধীবাগে। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের। পরিচিত লোকেদের কুশল বিনিময়ের পর পৌঁছে যাই গান্ধীবাগে। একটু দেরি হয়েছে। ভিড় তাই হালকা। আমাদের দেখে পরিচিতরা এগিয়ে আসে। কেউ অবাক হয় না কোত্থাও। কারণ ওরা প্রায় সকলেই জানেন উনিশের শিলচরে আমি প্রতিবারই পৌঁছে যাই। একবার গান্ধীবাগে শহিদবেদীর কাতারে দাঁড়ানো আমাকে বরিষ্ঠ সাংবাদিক তৈমুর রাজা চৌধুরী বললেন, উনিশের অতিথি চলে এসেছ? উত্তরে বলেছিলাম, আমি কি অতিথি হতে পারি? আমি উনিশের অতিথি নই, উনিশের নাইয়রি। আমার ওই কথাটাকেই পরের দিন তৈমুরদা ওঁদের কাগজে একটি সংবাদের শিরোনাম করেছিলেন। নাইয়রির কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকে না। সে আসলে যায় না, ফেরে। উনিশের শিলচর আমার সেরকমই ফেরার আশ্রয়। আমি ফিরি আমার কৈশোরের কাছে। আমার শেকড়ের কাছে। আমার আত্মপরিচিতির কাছে,আমি ফিরি উনিশের শিলচরে। আঁচলের উত্তাপ নিয়ে বেশিরভাগ সময় পরের দিনই ফিরে আসি। গতবার গিয়েছিলাম চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ের জন্যে। পড়ন্ত বিকেলে গান্ধীবাগ থেকে ফিরে এসেছি আমার দিদির বাড়িতে। আর কোত্থাও বেরোই নি। পরের দিন ভোরবেলা বিমান ধরে ফিরে দমদম থেকেই সরাসরি চলে গিয়েছি বর্ধমানে আমার কর্মস্থলে।

২০০৭ সালে শিলচর ছেড়েছি। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের একটা গান সতত মনে বাজে, কে বলে ‘যাও যাও’, আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া/ টুটবে আগল তোমার দ্বারে লাগবে আমায় ফিরে ফিরে ফিরে আসার হাওয়া। উনিশ এলে আমার অস্তিত্ত্বের সর্বস্ব জুড়ে একটা ফিরে আসার হাওয়া লাগে। আমি স্মৃতির কাছে ফিরে যাই। শুধু একার স্মৃতি নয়। আমার ফেলে আসা প্রজন্মের সম্মিলিত স্মৃতির কাছে ফিরে যাই। ফিরে যাই ইতিহাসের কাছে। ইতিহাসের চলে আসা পথে আমরা সামূহিকভাবে বারবার যে হোঁচটগুলি খেতে থাকি, আর রক্তাক্ত হই, তার হিসেব নিতে মন চায়। আমাদের বোধের ঘরে কি পরগাছা জন্ম নিয়েছে? আমরা কি উনিশের মর্মবাণীকে শুনতে পেয়েছিলাম কোনোদিন! নাকি তাকে ঘিরে আমাদের উৎসবে উদযাপনে হারিয়ে গেছে আমাদের শ্রবণক্ষমতা। আমরা ইতিহাসের কল্লোল শুনতে পাই নি। শুনতে পাই নি কান্নাও।

এবার আমার ফিরে যাওয়া নেই। নেই নিশির ডাক আর তার ঘোর। এবার উৎসব নেই, উদযাপন নেই। দেশহীনতার ভয়ঙ্কর ঘূর্ণীপাকে যখন আমাদের আত্মজনেরা দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। যখন আমরা ক্রমে ভুলতে বসেছি কোন পথ খাদের দিকে, কোন পথ মোহনার দিকে চলে গেছে, তখন অতিমারী এসে আমাদের সকলকে অন্তরীণ করেছে। এখন আমাদের উচ্চকিত উদযাপন ও সমারোহের কোনো জো নেই। এবার শহিদ বেদীকে খুঁজতে হবে আমাদের অন্তর্লোকে। গভীর আত্মবীক্ষণের মধ্যেই করতে হবে শহিদস্মরণ। এই আত্মবীক্ষণ হয়ত জরুরি ছিল। আমাদের কোলাহলমুখর উদযাপনের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল উনিশের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিচেতনা। মেতে ওঠার আর দশটা বাইরের আয়োজনের একটা হয়ে উঠেছিল উনিশ। অথচ উনিশ তো এসেছিল একটি রাজনৈতিক আবর্তের পরিণতি হিসেবে। উনিশ সম্পূর্ণত একটি রাজনৈতিক ঘটনা। রাজনীতির সাথে যাদেরই সামান্যতম সংযোগ রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক ভাবে একটি অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে উনিশের সামনে এসে। প্রথমত একটি অগণতান্ত্রিক শাসননীতির প্রতিবাদেই গর্জে উঠেছিল মানুষ। সারা আসামেই। সেই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ত ছিল তৎকালীন কাছাড়, আজকের বরাক উপত্যকা। এর তাৎপর্য ছিল সারা রাজ্যের রাজনীতির মধ্যেই। সেই রাজনীতি পরিচিতির রাজনীতি। কী পরিচিতি গ্রহণ করবে এই রাজ্য? একটি ভাষা ও নির্দিষ্ট একটি সংস্কৃতির? নাকি বহুভাষার ও বহুসংস্কৃতির? যার মাতৃভাষা অসমিয়া নয় সে কী পরিচয়ে পরিচিত হবে এই রাজ্যে? বহিরাগত? স্থানীয় হয়ে উঠতে হলে তাকে বিসর্জন দিতে হবে নিজের মাতৃভাষা? যে সরকারি ভাষা আইনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছিল গোটা রাজ্য, সেখানে অসন্তোষ তো কেন্দ্রীভূত ছিল না শুধু বঙ্গভাষীদের মধ্যে। যে গণআন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে উনিশের রক্তদান সেটা তো ছিল বহুভাষিকতা প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। কোনো পক্ষেই শুধু একটি ভাষার আধিপত্য মেনে না নেবার বার্তাই ছিল উনিশের মধ্যে। আত্মপরিচয় প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে জড়িত। রাষ্ট্র কারো উপর কোনো পরিচিতি চাপিয়ে দিতে পারে না। গণতান্ত্রিকতার এই আহ্বানের নামই উনিশ। এই গণতান্ত্রিকতা শুধু বাইরের নয়, ঘরেরও। বহুভাষিকতার লড়াই কখনো সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে মান্যতা দিয়ে হতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্ব অর্জন ব্যতিরেকে বহুভাষিক বহুসংস্কৃতির সমাজ গড়ার সংগ্রামও সম্ভব নয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে, পরে সরে এসে রবীন্দ্রনাথ আমাদের যে সামূহিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেছিলেন, আমরা এখনও তার মর্মোপলব্ধি করতে পারি নি। সেজন্যেই আমাদের উনিশ খুব বেশি বাইরের আড়ম্বর হয়ে উঠেছিল।

এবার বাইরের দরজা বন্ধ। অন্তরের দরজা খুলতে হবে। উনিশকে বহিরঙ্গের কোলাহল থেকে সরিয়ে এনে অন্তরঙ্গের উন্মোচনে সঠিক তাৎপর্যে অনুভব করার এটাই প্রকৃত সুযোগ। আমরা যেন সেই সুযোগের অবহেলা না করি।
জয় উনিশের জয়।

(এই প্রবন্ধের লেখক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার একজন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী এবং পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক আধিকারিক )

Comments are closed.