"লকডাউনের জাবড়ামি": অরিজিৎ আদিত্য
জাবড়া যে কী জাবড়া বস্তু তা গত কয়েক দিনে হাড় হাড়ে টের পাচ্ছি।
শনিবার সকালে ‘শ্যামের বাঁশি’ বাজিয়ে উনি শেষ এসেছিলেন। রবিবার জনতা কারফিউ, ব্যস্ সেদিন থেকে তিনি যাকে বলে ‘তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই’। সোমবার দুপর থেকেই শোনা যাচ্ছিল রাজ্য সরকার লকডাউন ঘোষণা করবে। হলও তাই। বিকেল থেকে প্যানিক বায়িং-এর হুড়ুমদুড়ুম। এটা আনো রে সেটা আনো রে।
এরই মধ্যে আবাসনের একজন বললেন, খুব তো ব্যাগ ভর্তি বাজার করছেন৷ কিন্তু গারবেজ ফেলবন কোথায়? বুড়ো তো শনিবার থেকে হাওয়া হাওয়াই।
তো সেই শুরু ‘জাবড়ামি’র।
ফোন করা হলো আমাদের চার নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার বিজেন্দ্র প্রসাদ সিংকে। কিন্তু তিনিও অথৈ জলে। তবু হাল বাতলে বললেন, আপনারা পাড়ার লোকেরা কোন একটা জায়গায় গারবেজ ডাম্প করে রাখুন, দেখি তিন চারদিন পর গাড়ি দিয়ে তোলাতে পারি কি না। পুরসভার সাফাই কর্মীরা আসতে পারছেন না। কী যে করা! বিজেন্দ্রর গলায় অসহায় আত্মসমর্পণ।
আবাসনের আমরা কয়েকজন পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। সমস্যা হল, আবর্জনা ডাম্প করাটা হবে কোথায়! শ্যাওড়াতলা মণ্ডপের লাগোয়া বড় খালি জায়গা রয়েছে, কিন্তু সেখানে ডাম্প করা হলে আশপাশের বাড়ির লোকেরা টিকতে পারবেন না।
পাড়ার এক দাদা আরেক প্রশ্নও তুললেন, “ধর, তিন চারদিনেও মিউনিসিপালিটির গাড়ি এলো না, তখন? হু উইল টেক দা রেসপন্সিবিলিটি?’ আমরা স্পিকটি নট।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট, গারবেজ ফেলা নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ির সমস্যাই বেশি। আমাদের আবাসনে কুড়িটি ফ্ল্যাট, ফলে গারবেজও ঢের। আমাদের মুখ চুন করে ওই দাদা বললেন, আগের দিন হলে কথা ছিল না, আমাদের বাড়ির এই দেখ কত খালি জায়গা৷ এইখানেই ইয়া বড় গর্ত করে সব জাবড়া ফেলে আগুন ধরিয়ে দিতাম। ল্যাঠা শেষ৷ সব ছাই।
আমরা অবশ্য এই কথা কেউ আর জিজ্ঞেস করার সাহস করিনি যে, অতীতে পারলে বর্তমান কী দোষ করল!
তো, ওই দাদাই বললেন, পাশের আবাসনে চল্লিশেরও ওপর ফ্ল্যাট, ওঁদের নিজস্ব সাফাই কর্মী রয়েছে, তাকে বরং ডেকে দেখা যাক।
ওই আবাসনের সভাপতিকে খবর দিতেই তিনি এসে গেলেন। আরেক রাউন্ড ডিসকাশন। বিজেন্দ্র প্রসাদ টু শ্যাওড়াতলা টু মিউনিসিপালিটির অনিশ্চিত গাড়ি। পাশাপাশি ওই দাদা তাঁদের খোলা জায়গায় গর্ত করে আগুন ধরানোর উজ্জ্বল অথচ অসম্ভব সম্ভবনার কথাও বললেন। শুনে সভাপতি মশাই বললেন, এ তো উত্তম প্রস্তাব। আগুনে ভাইরাস টাইরাস পুড়ে খাক।
এবার আমরাও একটু সাহস পেলাম, বললাম, দাদা দেখো একটু ভেবে, সামনে মিউনিসিপালিটি ইলেকশন, এমন ক্রাইসিসে জনগণের জন্য এগিয়ে এলে, কোনও না কোনও পার্টি ঠিক টিকিট দেবে। আর জেতা নিয়ে ভাবতে হবে।
চিড়ে অবশ্য ভিজলো না, তার আগেই দাদা দু হাতে মাছি তাড়িয়ে বললেন, সে গুড়ে বালি, চার নম্বর এবার লেডিজ।
অগত্যা পাশের আবাসনের সাফাই কর্মীকেই ফোন করা হল। তো তিনি এলেন। সাইকেল চেপে। একদম পারফেক্ট সাফাই কর্মী, হাইজিন সচেতন। মুখে মাস্ক লাগানো। রেট টেট ঠিক হলো। তার সোজা কথা, রাখতে হলে পারমানেন্ট রাখতে হবে। কারফিউর পর পুরনোজন এলেও বাদ দেওয়া যাবে না।
আমাদের এখন শিরে সংক্রান্তি। একুশ দিন গারবেজ পড়ে থাকলে আমাদের ফ্ল্যাট থেকেই করোনার ঠাকুরদা বেরবে। একে তুষ্ট করার জন্য আমরা পুরনো ওই বুড়ো সাফাই কর্মীর হাজারটা দোষ বের করি। নুইয়ে পড়া শীর্ণ শরীরটাকে টেনে টেনে চার তলায় ওঠা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফ নেওয়া বা বুড়োর বিধবা মেয়ে আর দুই নাতির কথা শুনে আমাদের যে করুণা হতো, করোনার ঠ্যালায় তা পগারপার। করোনার ধাক্কায় ইকোনমি দুরমুশ হয়ে যাবে, প্রচুর মানুষ জবলেস হবে, এইসব তত্ত্বের প্রথম বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আমরা বুড়োর চাকরি নট করে নতুনজনকে এপয়েন্ট করলাম। তিন দিনের আবর্জনা জমে আছে, ফলে কাজ আজ থেকেই। আবাসনের কেয়ারটেকার সব ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ওকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেবে। সাফাই কর্মী ততক্ষণে মাস্ক খুলে ফেলেছে। আমরা একজন আরেক জনের দিকে তাকাই। ওর থুতনিতে দাঁড়ি।
ভাই, তোমার নাম কী? কনফার্ম হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করি।
সার, আনোয়ার।
আমরা কিছুই বলি না। কিন্তু আমরা বুঝি কোনও কোনও ফ্ল্যাট থেকে আপত্তি উঠতে পারে। হলোই বা আবর্জনার, তবু বাড়ির বালটি মুসলমানে ধরবে! এই আপত্তি ওঠার হান্ড্রেড পারসেন্ট চান্স।
তবু কেয়ারটেকারকে দিয়ে ওকে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে পাঠালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর সে নেমে এল। “স্যার সব ঠিক আছে। সমস্যা একটাই জাবড়া নেওয়ার বস্তা নেই। বাড়ি থেকে এক দৌড়ে নিয়ে আসছি।”
যাক, কেউ আপত্তি তোলেনি। ধর্মের চেয়েও বুঝি জাবড়া বড়!
কিন্তু লোকটা এলো না। এলো না মানে আসতে পারলো না। পুলিশ আটকে দিয়েছে৷ ফোন করে কেয়ারটেকারকে জানিয়ে দিয়েছে।
এ তো মহা জাবড়া! আমাদের মাথায় হাত।
সন্ধে নাগাদ কেয়ারটেকার এসে জানালো, আরেকজন পাওয়া গেছে। নীচে নেমে দেখি, শীর্ণকায় এক যুবক। জানালো, দিনমজুরের কাজ করে। লকডাউন, ফলে আজ কাজ জোটেনি। অগত্যা আবর্জনা ফেলার কাজেও রাজি।
কিন্তু ফেলবে কোথায়? পাড়ায় ফেলা যাবে না। তা হলে?
সন্ধে ততক্ষণে নেমে এসেছে। লোকটা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। যদি এই কাজটাও হাতছাড়া হয়, তা হলে বাড়ি যাবে কী নিয়ে?
অসহায় আমরাও। যদি গারবেজের স্তূপ জমে, যদি বিজেন্দ্র প্রসাদ গাড়ি পাঠাতে না পারেন, যদি ওই গারবেজ থেকে কিলবিলিয়ে ওঠে মারণ ভাইরাস।
শেষমেশ লোকটাই বস্তায় ভরে গারবেজ নিয়ে যায়। লকডাউনের অন্ধকার শহরের কোন গলিতে তা ফেলবে, সেটা তার দায়। আমার বাড়িতে ভাইরাস না ঢুকলেই হলো।
এই প্রবন্ধের লেখক অরিজিৎ আদিত্য একজন খ্যাতনামা লেখক
Comments are closed.