শহর শিলচর, পরিচ্ছন্নতা এবং আমরা
শিলচর বা বরাক উপত্যকা ততটা পরিষ্কার না হলেও তাকে ঠিক নোংরা বলেও কখনও সম্বোধন করা হয়নি। ‘শান্তির দ্বীপ’ নামে পরিচিত এই শহর তথা বরাক উপত্যকা পরিষ্কার এবং সবুজ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বন ধ্বংসের কারণে এই শহর তথা গোটা উপত্যকার শ্যামল এবং সবুজ পরিবেশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
একইভাবে পরিচ্ছন্নতাও প্রশ্নের মুখে। প্রধানমন্ত্রী পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে মানুষজদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য “স্বচ্ছ ভারত” অভিযানের সূচনা করেন। কিন্তু বরাক উপত্যকায় এই অভিযানটি সফল হওয়ার পরিবর্তে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। বন ধ্বংস এবং অপরিচ্ছন্নতা শিলচরকে একটি দূষিত শহর করে তুলেছে।
কেন আমাদের শহর এত নোংরা? উত্তরটা কিন্তু আমাদেরকেই লজ্জ্বিত করবে। কারণ আমরা নিজেরাই এর জন্য দায়ী। হ্যাঁ, প্রত্যেকবার আমরা নাগরিক সমস্যাগুলি নিয়ে চায়ের আড্ডায় বসে আলোচনা করি এবং গরম চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশাসন এবং সরকারকে দোষারূপ করি। ফ্যানের নীচে বসে এই রসালো আড্ডায় প্রশাসন এবং সরকারকে দোষারূপ করাটা খুব সহজ কাজ। যদিও এই অবস্থার জন্য তারা কিছু পরিমানে দায়ী কিন্তু অন্যান্য আরো অনেক কারণগুলিরও ব্যাখ্যা করাটা প্রয়োজন। অনেক কারণগুলির মধ্যে নীচে পাঁচটি দেওয়া হলো-
১. দায়িত্বজ্ঞানহীন বাসিন্দারা : আমরা শিলচরকে নিজেদের শহর বলি, বরাককে নিজের উপত্যকা বলতে গর্ববোধ করি, তবে কিসের জন্য তাদের সঙ্গে বহিরাগতের মতো আচরণ করি? দায়িত্বজ্ঞানহীন নাগরিকরা পুরো শহরটাকে ডাস্টবিনে রূপান্তরিত করেছে, তারা আবর্জনাগুলি প্যাক করে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দেখবেন যে মানুষটি সকালবেলা লোকজনকে নৈতিকতার ভাষণ দেয়, শহরকে পরিছন্ন রাখার পরামর্শ দেয়, সেই একই মানুষ রাত্রেবেলা চুপিসারে রাস্তার মধ্যে আবর্জনা ফেলে দিয়ে চলে যায়। ভোরবেলা বা গভীর রাতে দেখতে পারবেন কিভাবে মানুষরা গাড়িতে বেরিয়ে রাস্তার মধ্যে আবর্জনা ফেলে চলে যায়। এমনকি তারা যদি ডাস্টবিনের সামনে চলেও যায় তবে একটু দূরত্ব থেকে আবর্জনা ঢিল ছুঁড়ে ফেলে যার ফলে ডাস্টবিনের আশপাশ এলাকাগুলিও একটি ডাস্টবিনে পরিণত হয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন বাসিন্দারাই এই অপরিচ্ছন্নতার মূল কারণ।
২. পরিকাঠামো সমস্যা – পৌরসভা প্রথমে পৌর এলাকায় সর্বত্র প্লাস্টিক ডাস্টবিন সংস্থাপন করেছিল। কিন্তু প্লাস্টিকের ডাস্টবিনগুলি ফেটে যাওয়ার ফলে লোহার ডাস্টবিন প্রতিস্থাপন করা হয়। এখন সমস্যাটি হলো এই লোহার ক্যানগুলি শীঘ্রই জংকারের কারণে আবার ফেটে যেতে পারে। প্রশাসনকে শুষ্ক বর্জ্যর জন্য পৃথক ডাস্টবিন এবং শিক্ত বর্জ্যর জন্য আলাদা ডাস্টবিন লাগানোর প্রয়োজন। এছাড়াও আমাদের শহরের ডাম্পিং গ্রাউন্ডগুলির উচ্চতা খুব বেশী যার ফলে আবর্জনা সংগ্রহকারীরা এই উচ্চতায় তাদের গাড়িগুলি উত্তোলন করতে পারে না এবং ডাস্টবিনের পাশে ফেলে দিয়ে যায়।
৩. পৌরসভা ইস্যু –
পৌরসভা এলাকায় পরিষ্কার এবং পরিছন্নতার দায়িত্ব পৌরসভা বোর্ডের। কিন্তু বিগত এক বছর ধরে পৌরসভায় গুরুতর সংকট চলছে। পরিদর্শনের মাধ্যমে পৌর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। পৌরসভা শ্রমিকরা বিগত আট মাস ধরে তাদের বেতন পাচ্ছে না এবং প্রায়ই ধর্মঘট আহ্বান করা হচ্ছে। ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে পরিষ্কার-পরিছন্নতা বজায় রাখা একটি গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
৪. সড়কে বর্জ্য: – শিলচরে কখনও কখনও বর্জ্য নিষ্কাশন সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করে। কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে শহরের বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। প্রশাসন এটি এড়ানোর জন্য নর্দমার আবর্জনা পরিষ্কার করে রাস্তার পাশে ফেলে যায়। এই আবর্জনা গাড়ি এবং মানুষের পদচারণের সাথে সাথে পায়ে পায়ে ছড়িয়ে যায়। এই দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা শেষমেশ কীট পতঙ্গের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়, যা থেকে ভাইরাস ছড়ায় এবং মানুষ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
৫. প্লাস্টিকের ব্যবহার –
প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্জন করা উচিত। প্লাস্টিকের প্লেট (থার্মোকলের) এবং ডিসপোজেবল গ্লাসগুলি সাধারণত বিবাহ, পূজা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে একদিনের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং তারপরে ফেলে দেয়া হয়। মাছ সবজি কিনে মানুষ প্লাস্টিক ব্যাগ ভরে ঘরে নিয়ে যায় এবং সেই প্লাস্টিক ব্যাগ আবার উড়িয়ে ফেলে দেয় যেখানে সেখানে।এইগুলি বায়ো ডিগ্রেডেবল নয় এবং নর্দমার স্রোতকে বিঘ্নিত করে।
আমরা উপরে উল্লিখিত বেশিরভাগ বিষয়গুলিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি যদি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা এবং রোগমুক্ত শহর আমাদের উদ্দেশ্য হয়। আমরা কি নাকে রুমাল চেপে রাস্তায় হাঁটতে চাই, না পরিষ্কার হাওয়ায় মুক্তভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে চাই, ইচ্ছেটি সম্পূর্ণ আমাদের।
Comments are closed.