চলে গেলেন উত্তর পূর্ব ভারতের আমিরে শরিয়ত আল্লামা তৈয়বুর রহমান
নক্ষত্র পতন ঘটল বরাক উপত্যকায়। উত্তর পুর্ব ভারতের আমিরে শরিয়ত, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা তৈয়বুর রহমান বড়ভুইয়া আর নেই। বুধবার বেলা বারোটা বিশ মিনিট নাগাদ রাংগাউটির নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। গুয়াহাটির রহমান হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্ত চিকিৎসায় সাড়া না দেওয়ায় মঙ্গলবার রাতে হাসপাতাল থেকে অচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা তৈয়বুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ চাউর হতেই সর্বত্রই শোকের ছায়া নেমে আসে। অগনিত লোক তাঁর বাড়িতে ছুটে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন। হাইলাকান্দির জেলা শাসক কীর্তি জল্লি, জেলা পরিষদের সিইও শান্তি সিংহ বাড়িতে ছুটে গিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন।
তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়ার মৃত্যুতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল, প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম রায়, সিদ্দেক আহমদ, সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেস সভানেত্রী সাংসদ সুস্মিতা দেব, জেলা কংগ্রেস সভাপতি জয়নাল উদ্দিন লস্কর, জেলা বিজেপি সভাপতি সুব্রত নাথ সহ বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তি, সংস্থা, সংগঠনের প্রতিনিধিরা গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হল বলে প্রত্যেকেই শোক বার্তায় উল্লেখ করেছেন।
প্রয়াত তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়ার জানাজার নামাজ বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় রাংগাউটিতে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, প্রয়াত তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়া ১৯৩১ সালে হাইলাকান্দির রাংগাউটি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ২০ নং রাংগাউটি এল পি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। প্রাথমিক শিক্ষান্ত পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন।।
হাইলাকান্দি সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৩ সালে আসাম মাদ্রাসা ইন্টার মিডিয়েট ও ১৯৫৫ সালে আসাম মাদ্রাসা ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এম এ পাশ করেন। এই পরীক্ষায় তিনি স্বর্নপদক লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে রাস্ট্রভাষা বিশারদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রৌপ্য পদক লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি হাইলাকান্দি সিনিয়র মাদ্রাসায় হিন্দি শিক্ষক রূপে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। ১৯৭৬ সালে মাদ্রাসার অধীক্ষকের কার্যভার গ্রহন করেন।
সুদীর্ঘ বিশ বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৬ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করেন। ১৯৯৬ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করলেও ২০১৬ পর্যন্ত তিনি মাদ্রাসা ফাইনাল পরীক্ষার পাঠ্য পবিত্র মিশকাত শরীফ পাঠ দান করে যান।
২০০৮ সালে তাকে কাছাড় টাইটেল মাদ্রাসার শায়খুল হদিস রূপে নিয়ুক্তি দেওয়া হয়। কর্মজীবনে তিনি বিশেষ সুনাম অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হন। আসাম টাইটেল মাদ্রাসা ফ্যাইনাল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার সহ কর্মজীবনে ইসলামী জ্ঞানে বিশেষ পান্ডিত্য প্রদর্শনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৫ সালে বদরপুর দেওরাইল মাদ্রাসার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাঁকে স্বর্নপদক প্রদান করা হয়। তাছাড়া ১৯৮২ সালে ভারত সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল তাকে পুরস্কৃত করে। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়। ভারতের তদানিন্তন রাস্ট্রপতি শ্রী বেংকট রমন তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। ১৯৯২ সালে শিক্ষার উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য সারদা চরন দে স্মৃতি ট্রাস্ট তাঁকে রৌপ্যপদক প্রদান করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তাঁকে মুক্তকন্ঠ পুরস্কার, এম কিউ এইচ এওয়ার্ড, শেখ আহমদ আলি এওয়ার্ড ইত্যাদি পুরস্কার প্রদান করা হয়।।
প্রয়াত তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়া ছাত্র জীবন থেকে বিভিন্ন সমাজসেবা মুলক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেব। ১৯৪৫ সালে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশ নেন। তাছাড়া তিনি হাইলাকান্দি হিলাল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ ২৬’ বছর, আসাম মাদ্রাসা একাডেমিক কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ষোল বছর, হাইলাকান্দি জেলা নদয়াতুত তামীরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দীর্ঘ ২৩ বছর, ও হাইলাকান্দি জেলা কাজিয়ে শরীয়ত হিসেবে দীর্ঘ ১৪ বছর কার্য নির্বাহ করেন। তিনি আসাম নদয়াতুত তামীরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে আসাম মাদ্রাসা শিক্ষক সংস্থার সভাপতি, আসাম মাদ্রাসা বোর্ডের সদস্য, সিলেবাস রিভিউ কমিটির সদস্য, আসাম রাজ্যিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য, হাইলাকান্দি শিক্ষক নিয়ুক্তি সিলেকশন কমিটির সদস্য, আসাম রাজ্যিক মিল্লি কাউন্সিলর সাধারণ সম্পাদক, সর্বভারতীয় মিল্লি কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। উত্তর পুর্ব ভারতের প্রথম আমিরে শরিয়ত মওলানা আবদুল জলিল চৌধুরীর র মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে সর্বসম্মতিক্রমে তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়াকে আমিরে শরিয়তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যুর পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি আমিরে শরিয়তের দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৯১ সাল থেকে তিনি সর্বভারতীয় পার্সোনাল ল বোর্ডের কার্যকরী কমিটির সদস্য পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাছাড়া সর্বভারতীয় ফেকাহ একাডেমির সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন। প্রয়াত তৈয়ীবুর রহমান বড়ভুইয়া জীবনে দু’বার জাহাজে এবং ছ’বার বিমানে মোট আটবার হজব্রত পালন করেন। ভারতবর্ষ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে তাঁর অগণিত শিষ্য রয়েছেন। বর্নময় ওই ব্যাক্তিত্বের প্রয়ানে সর্বত্রই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
Comments are closed.