Also read in

“রণটিলা” – এক অবহেলিত ধর্মক্ষেত্র

 

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম বাগানে লর্ড ক্লাইভের সেনাদের হাতে সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় থেকেই এদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত। তারপর দীর্ঘ একশ’ বছর ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ব্রিটিশ বানিয়ারা আমাদের দেশকে দখল করে, শাসন ও শোষণ করে। ঠিক একশ’ বছরের মাথায় অন্যায় ভাবে শোষিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, পদদলিত ভারতবাসীর ক্ষোভ-বিক্ষোভ ফেটে পড়ে “সিপাহি বিদ্রোহ”র মাধ্যমে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা এই মহাবিদ্রোহকে “সিপাহি বিদ্রোহ” নামে আখ্যায়িত করলেও প্রকৃত অর্থে সেটিই ছিল ভারতের স্বাধীনতা স্পৃহার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। কলকাতার পাশে ব্যারাকপুরে এই বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলেন শহিদ মঙ্গল পান্ডে। দেখতে দেখতে সেই স্ফুলিঙ্গ আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বড় বড় সেনা শিবির গুলিতে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের লেলিহান শিখা। সাদা চামড়ার বিদেশি সেনা অফিসারদের আদেশ অস্বীকার করে ব্যারাক গুলি থেকে বেরিয়ে আসেন হাজারে হাজারে সৈন্য। বহু জায়গায় সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের। লুঠ করা হয় অস্ত্রশস্ত্র, রেশন ও টাকা পয়সা। কিন্তু সেটা কোনও সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান ছিলনা। কোনও যথার্থ নেতৃত্বও সেই বিদ্রোহের রাশ ধরতে পারেন নি।

নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাঈ… এরা সবাই ছিলেন অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন। ফলে সামান্য চেষ্টার মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসকেরা সেই অভ্যুত্থান দমন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই ঘটনায় টনক নড়ে ব্রিটিশ সরকারের। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি সরকারের হাতে শাসনভার তুলে নেয় এবং ভারতবাসীর বিক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানে কয়েকটি কমিটি নিয়োগ করে। সেই সব কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থার প্রচুর সংস্কার সাধনও করা হয়। এসব অবশ্য পৃথক বিষয়। সিপাহি বিদ্রোহ শুধু দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার আর বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল এই বরাক বিধৌত মাটিতেও। তার কথাই আজ বলতে বসেছি।

 

Ashu Paul

 

১৮৫৭-র নভেম্বর মাসের শেষে চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা বাহিনীর চৌত্রিশ নম্বর নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ভারতীয় সিপাহিরা ব্রিটিশ আনুগত্য মানতে অস্বীকার করে। নিজ নিজ অস্ত্র হাতে নিয়ে ব্যারাক থেকে বেরিয়েই তারা জেল দখল করে বন্দী স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের মুক্ত করে দেয়। জেলা শহরে অবস্থিত ট্রেজারি লুঠ করে তারা অর্থ সংগ্রহ করে সঙ্গে নেয়। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ সেনা এবং তাদের অনুগত ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিপাহীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ভাবে লড়াই শুরু হয়ে যায় পথে প্রান্তরে। বিদ্রোহী সেনাদের চেয়ে ব্রিটিশ সেনাদের সংখ্যা ও দক্ষতা স্বভাবিক ভাবেই বেশি ছিল। তাই বিদ্রোহীরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে এদিক ওদিক সরে যাওয়ার কৌশল নেয়। কিন্তু এভাবে তারা ছোট ছোট অংশে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদেরই একটি বড় অংশ পশ্চাদপসরণ করতে করতে কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলের ভিতর দিয়ে, সিলেট-ত্রিপুরার সীমানা হয়ে উত্তর দিকে চলে আসে এবং করিমগঞ্জের দক্ষিণ- পশ্চিমে লাতু গ্রামের মালেগড় নামক জায়গায় আশ্রয় নেয়। সেখানে ব্রিটিশ সেনা অফিসার মেজর বিং-এর নেতৃত্বে এক ব্রিটিশ বাহিনী বিদ্রোহী সেনাদের উপর আক্রমণ চালালে তীব্র লড়াই চালিয়ে ২৬ জন বিদ্রোহী ভারতীয় সেনা প্রাণ বিসর্জন দেন। ব্রিটিশ বাহিনীর কয়েকজন সেনাও সেই লড়াইয়ে প্রাণ হারান।

ত্রিপুরা, লুসাই পাহাড় এবং মণিপুর তখনও ব্রিটিশ শাসনাধীন হয়নি। তাই অন্যান্য বিদ্রোহীরা আত্মগোপনের জন্য তিন চারটি ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন পথে ওইসব রাজ্যের দিকে এগিয়ে যান। মণিপুরের তখনকার যুবরাজ বিদ্রোহী বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মণিপুরের উদ্দেশে যে দলটি যাত্রা করেছিল, তারা শনবিল, গামারিয়া, সরসপুর, কোম্পানিগঞ্জ হয়ে মোহনপুরের কাছে বর্নি নদী (কাটাখাল) পেরিয়ে একটি অনুচ্চ টিলায় সাময়িক ভাবে আত্মগোপন করে। বিশ্বাসঘাতকেরা যুগে যুগে থাকে, সে যুগেও ছিল। খাদ্য সংগ্রহের জন্য সেইসব বিদ্রোহীরা আশপাশের গ্রামে যেতেন। তাছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিদ্রোহে শামিল করার চেষ্টাও করতেন তারা। ফল মিলল উল্টো। কিছু কিছু লোক বিদ্রোহীদের অবস্থান সম্পর্কে খবর পৌছিয়ে দিলেন প্রশাসনের কাছে। অবিভক্ত কাছাড়ের মুখ্য প্রশাসক রবার্ট স্টুয়ার্ট তখন ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন পাঁচগ্রামে। খবর পেয়েই ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট রস-কে তিনি পাঠালেন মোহনপুরের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে একাংশ বিদ্রোহী সেনা মোহনপুর ছেড়ে ধোয়ারবন্দ, জালেঙ্গা ও চাতলায় ছড়িয়ে পড়েন।

 

Bhupen Hazarika memorial stage in Ron Tilla premises

 

ঠিক ১৬০ বছর আগে, ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৭, দলবল সহ লেফটেন্যান্ট রস পৌছে যান মোহনপুরে। গ্রামের কিছু মানুষকে ভয় দেখিয়ে হদিশ পেয়ে যান আত্মগোপন করা সেই টিলার। সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘিরে ফেলেন সেই টিলা। রাত পোহানোর পর বিদ্রোহীরা যখন খেতে বসেছেন, শুরু হয়ে যায় ব্রিটিশ সেনার গুলি বৃষ্টি। অপ্রস্তুত হলেও সুবেদার রজব আলির নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা লড়ে যান দাঁতে দাঁত চেপে। সেই অসম লড়াইয়ে মোট ১২ জন বীর সিপাহি স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন। শোনা যায়, তাদের মধ্যে একজন গুরুতর আহত ছিলেন। ব্রিটিশেরা তাকে উঠিয়ে কাটাখাল নদী পার করে এনে বর্তমান মোহনপুর হাইস্কুলের নিকটে থাকা এক বড় বটগাছে ফাঁসি দেয়। যুদ্ধ (রণ) হয়েছিল বলে সেই টিলা লোকমুখে “রণটিলা” নামে খ্যাত হয়ে যায়। যেসব বিদ্রোহী মণিপুরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, মাত্র দুদিনের মাথায়, ২৪ ডিসেম্বর, তাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে জালেঙ্গা অঞ্চলে আবার হামলা চালায় ব্রিটিশ সেনাপতি স্টুয়ার্টের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। জালেঙ্গা অঞ্চলের চা বাগান গুলির অধিকর্তা জেমস ডেভিডসন এবং বেশ কিছু স্থানীয় কুকি ও লুসাই অধিবাসীরা এখানে ব্রিটিশ বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জানুয়ারি মাসে বিন্নাকান্দি এলাকায় ভুবন পাহাড়ের পাদদেশে বিদ্রোহীদের শেষ অংশের সঙ্গে ফের যুদ্ধ হয় ব্রিটিশ বাহিনীর। যতদূর জানা যায়, মণিপুরের যুবরাজ নরেন্দ্রজিৎ সিংহের সেনাবাহিনীও সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। কিন্তু লেফটেন্যান্ট রস এবং লেফটেন্যান্ট বিন্সটের নেতৃত্বাধীন বিশাল বাহিনীর কাছে তারা সবাই পরাজিত ও নিহত হন। যুবরাজ নরেন্দ্রজিৎ গুরুতর আহত অবস্থায় ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন। বিদ্রোহীদের নেতা রাজীব আলি খান ও তাঁর স্ত্রী যুদ্ধ করতে করতে মারাত্মক আহত হয়েও ভুবন পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে আত্মগোপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কি হয়েছিল বা কোথায় তারা গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কোনও তথ্য ঐতিহাসিকেরা খুঁজে পাননি। ধারণা করা যায়, চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে তারা জঙ্গলের মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছিলেন।

যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সেইসব অমর শহিদেরা, সেই স্বাধীন দেশের সরকার, নেতৃবৃন্দ এমন কী সাধারণ মানুষও কি তাঁদের সেই চরম আত্মত্যাগের কথা মনে রেখেছেন ? হাইলাকান্দি জেলার বোয়ালিপারের “রুদ্রাণী” সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে কয়েক বছর ধরে সেখানে ২২ ডিসেম্বর তারিখে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করে বীর শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলেছেন। খবরের কাগজ মারফত এই সংবাদ পেয়েই ঠিক করলাম, যাবো। যেতেই হবে। এগারোটায় বেরিয়ে চল্লিশ মিনিটে পৌছে গেলাম মোহনপুর। কিন্তু কোথায় এই রণ টিলা ? স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে করে এগিয়ে গেলাম। রাস্তার পাশে কোনও সাইনবোর্ড বা পথ নির্দেশ পর্যন্ত  নেই। দুই স্কুল পড়ুয়া ছাত্রকে জিজ্ঞেস করায় দেখিয়ে দিল, ওই ওদিকে। পাকা সড়ক ছেড়ে মাইল খানেক কাঁচা এবড়োখেবড়ো রাস্তা। কোথাও বেশ পিচ্ছিল। পাঁচ সাত মিনিটে পৌছে গেলাম সেখানে। হ্যাঁ, অনুষ্ঠান চলছে। সামান্য উঁচু ঢিবিতে উঠলাম সিঁড়ি ভেঙে। স্মৃতি স্তম্ভ টি বড় সুন্দর। সারা বছর অবহেলায় থাকলেও রুদ্রাণীর উদ্যোগে নতুন করে রঙ লেগেছে। কিছুটা জায়গা কেটে সমতল করা হয়েছে। ঘিরে দেওয়া হয়েছে পাকা দেওয়াল দিয়ে। সরকারি খরচে ত্রিকোণাকৃতি একটি মঞ্চ বানিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে “ভূপেন হাজারিকা স্মৃতি মঞ্চ”। কিসের সঙ্গে কী ! ভূপেন হাজারিকা আমাদের গর্ব। স্বনামধন্য গায়ক, সুরকার। কিন্তু রণটিলার সিপাহি বিদ্রোহের শহিদ স্মৃতি স্তম্ভের জন্য নির্মিত অনুষ্ঠান মঞ্চের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোথায় ! সেটারও মেন্টেনেন্স খুব দুর্বল। স্মৃতি স্তম্ভের সিঁড়িও ভেঙে যাচ্ছে। দেখাশোনা করা, সাফসুতরো রাখা, সবই করেন স্থানীয় মানুষজন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

“ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবাঃ

মামকা পাণ্ডবাশ্চৈব কিম কুর্বত, সঞ্জয় ?”

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ন্যায়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ যেখানে হয়, সে স্থান অবশ্যই ধর্মক্ষেত্র। মালেগড়, জালেঙ্গা, বিন্নাকান্দি, রণটিলাও নিঃসন্দেহে আমাদের ধর্মক্ষেত্র।

যে স্বাধীন দেশে আমরা বসবাস করছি, যে স্বাধীনতার স্বাদ আজ আমরা উপভোগ করছি, যে স্বাধীন দেশে আজ আমাদের সরকারের মন্ত্রীরা রাজত্ব করছেন, সেই স্বাধীনতার জন্য যারা একদিন নিজেদের জীবন-যৌবন-ধন-মান হেলায় উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে আমরা কি একটু নজর দিতে পারব না ? এখন তো রাজ্যে এবং কেন্দ্রে পরিবর্তন এর সরকার, রণটিলা সহ ওই স্থানগুলির প্রতি অবহেলার কিছুটা পরিবর্তন কি আমরা আশা করতে পারি ?

 

এই নিবন্ধটি লিখেছেন টাউন ও কান্ট্রি প্ল্যানিং এর অবসরপ্রাপ্ত বাস্তুকার শ্রী আশু পাল। পাল, ভলান্টারী ব্লাড ডোনেশন ফোরামের এতদ্বঞ্চলের মূল স্তম্ভ; উনার এই অবদানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

Comments are closed.