চিকিৎসার অভাবে রোগীর অকাল মৃত্যু অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক: ডঃ নন্দী পুরকায়স্হ
বরাক উপত্যকা তথা আসামের স্বনামধন্য অস্হি বিশেষজ্ঞ ও শিলচর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ সুজিত কুমার নন্দী পুরকায়স্হ শুধু ডাক্তার হিসেবেই জনপ্রিয় নন, উঁচুদরের মানুষ হিসেবেও পরিচিত।ডঃ নন্দী পুরকায়স্থ গৌহাটি মেডিকেল কলেজ থেকে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন ১৯৬৫ সালে। এর পর তিনি অ্যাল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস, নিউ দিল্লীর অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন এবং তখনকার বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন ডঃ প্রকাশ চন্দ্রের অধীনে কাজ করেন ও ১৯৬৯ সালে অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। যখন ভারতবর্ষের অনেক বড় জায়গায় ক্যারিয়ার শুরু করার সুযোগ ছিল তখনও নিজের জন্মস্থানে ফিরে আসাকেই উনি সমীচিন মনে করেছেন। শিলচর মেডিক্যাল কলেজে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে সঙ্গে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিক্যাল সায়েন্স এর ডিন হিসেবেও কাজ করেন। উনার কার্যকালে শিলচর মেডিক্যাল কলেজে যেমন অনেক উন্নতি হয়েছে তেমনি হাসপাতালেও অনেক নতুন বিভাগ খোলা হয়। চিকিৎসা বিদ্যায় বিভিন্ন অবদানের জন্য তিনি যেমন সন্মানিত হয়েছেন নানাভাবে তেমনি পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছেন বারবার। সামাজিক কাজেও উনার অবদান কম নয়। উজ্জ্বীবন স্পাসটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে উনি কাজ করছেন ১৯৯৫ সাল থেকে।
যখন বরাক উপত্যকায় মানুষের মধ্যে চিকিৎসা এবং চিকিৎসক নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন, অভিযোগ এবং ক্ষোভ অনেকদিন ধরেই দানা বাঁধছে, যখন অনেকেই শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্হলে নার্সিংহোমকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, কিংবা যখন বরাকবাসীকে চিকিৎসার জন্য বারবার আসামের বাইরে পাড়ি দিতে হচ্ছে তখন আমরা শিলচর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা অস্থি বিশেষজ্ঞ ডঃ নন্দী পুরকায়স্হের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
সাক্ষাৎকারের সম্পাদিত অংশ তুলে ধরছি।
বর্তমানে কলেজ যখন সূবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখন মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে একে আপনি কতটা উন্নত বলে মনে করেন?
আমার তো মনে হয় অনেক উন্নতি হয়েছে, নতুন নতুন ভবন নির্মান করা হচ্ছে, নতুন ফ্যাকাল্টি মেম্বার নিয়োগ করা হয়েছে, নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। যদিও নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, ইউরোলজি, ইউরোসার্জারি বিভাগ এখনও খোলা হয়নি, যা অত্যন্ত জরুরী। কার্ডিওলজির যে একজন প্রফেসর ছিলেন উনিও এখন ছুটিতে। তাই সুপার স্পেশালিটিস বিভাগ খোলা অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে হাসপাতাল সম্পর্কে কি বলবেন, কারণ ৫০ বছর সময়টা তো নেহাত কম নয়?
হাসপাতালে গতানুগতিক যে বিভাগগুলো ছিল এগুলোই রয়েছে। নতুন কোন বিভাগ খোলা হয়নি। অথচ শুধু আসামের নয় পাশাপাশি রাজ্যের যেমন মনিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডের বৃহৎ সংখ্যক রোগীও চিকিৎসা করাতে আসেন। তারা নিশ্চয়ই আসেন উত্তম চিকিৎসার আশায়। তাই আরও অনেকগুলি বিভাগ খোলা অন্যন্ত জরুরী,এখানে বলা উচিত ১৫/ ২০ বছর আগেই এগুলো খোলা উচিত ছিল। যদিও বাইরে থেকে নিউরোসার্জনরা আসছেন মাসে একবার। কিন্তু কার্ডিওলজি বিভাগে সার্জন নেই এবং নিউরোসার্জারির দৈনন্দিন দেখাশোনা বিভাগও নেই। তাই অনেক সময় সড়ক দূর্ঘটনাগ্রস্ত বিশেষভাবে মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীরা যথাযথ এবং সময়মত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ফলে অনেকে অকালে মৃত্যু বরণ করছেন। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
তবে কি এসবের জন্যই শিলচর মেডিক্যাল কলেজের উপর ভরসা না করে নার্সিংহোমে যেতে পছন্দ করছে বেশিরভাগ মানুষ?
এ ক্ষেত্রে ভরসা না করার মত কিছু হয় নি। যে বিভাগগুলো রয়েছে ওরা ভালই কাজ করছে। তবে বিভিন্ন বিভাগ না থাকায় অসুবিধে হচ্ছে তো বটে। আবার এও ঠিক যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়ত যেভাবে মানুষের সেবা করা উচিত সেভাবে করা যাচ্ছে না। তাই আরও হাসপাতালের দরকার।তবে আবারও বলছি সবচাইতে জরুরী আমাদের সুপার স্পেশালিটিস বিভাগ। বিশেষভাবে নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, ইউরোলজি, ইউরোসার্জারি বিভাগ অতিসত্বর খোলা প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগ নেই, অথচ এখন যেহারে ডায়বেটিক রোগী বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এন্ডোক্রিনোলজিস্ট নেই।
তাছাড়া কলেজকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই, অনেক সময় অনেকজন রোগী একসঙ্গে ভর্তি হলে সবাইকে এক সঙ্গে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয় না কিংবা চিকিৎসা করতে সময় লাগে তাই অনেকে ভাবেন নার্সিংহোমে চলে যাওয়াই ভাল।
কিন্তু শিলচরের আনাচে কানাচে এত যে নার্সিংহোম গজিয়ে উঠছে, তার পেছনেও কি পরোক্ষভাবে মেডিক্যাল কলেজের দূরবস্থা দায়ী নয়?
এক্ষেত্রে হাসপাতালের দূরবস্থা দায়ী বলব না, এখন নার্সিংহোমে যাওয়ার পেছনে মানুষের একটা মোহ বা প্রবণতা কাজ করে। তাছাড়া এখানে এক চক্র রয়েছে যারা অনেকসময়ই মানুষকে ভুল পথে চালিত করে এই ক্ষেত্রে। মেডিক্যাল কলেজে অনেক সময় লাগবে বরং নার্সিংহোমে অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, এমনভাবেই ওদেরকে বোঝানো হয়। কিন্তু কথাটা সবসময় সত্যি নয়।
আর যারা শিলচরের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পছন্দ করছেন, তাদের মধ্যে কি বরাকের চিকিৎসকদের উপর অবিশ্বাস কাজ করছে?
জলের প্রবাহ যেমন উপর থেকে নীচের দিকে অতিবাহিত হয়, তেমনি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও তেমনি একটা প্রবাহ চলছে বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর। এটা শুধু শিলচর নয়, কোলকাতা, দিল্লির মত বড় বড় জায়গার মানুষের মধ্যেও একই মানষিকতা কাজ করছে। বড় থেকে আরো বড় জায়গায় যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে একটা অংশ তো নিঃসন্দেহে বাইরে যাচ্ছে ভাল সেবা পাওয়ার জন্য।
তাহলে আপনার মতে শিলচরের ডাক্তাররা ভালোই……
না, সবাই ভাল তা বলব না। তবে ভাল ডাক্তাররাও রয়েছেন।
কিন্তু পত্রপত্রিকায় অনেক সময়ই অভিযোগ পাওয়া যায় যে বরাকউপত্যকায় অনেক ভুল চিকিৎসাও হয়। তাহলে?
এটাতে আমি সহমত নই। ভুল মানুষ মাত্রেই হয়। শুধু বরাকউপত্যকা কেন ভুল চিকিৎসা তো গুয়াহাটি, দিল্লি, এমনকি লন্ডনেও হচ্ছে। তাছাড়া কোন কিছু ঘটলে সবসময় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার না করেই খবর মাধ্যমগুলোতে ঘটনাটা এসে যায়, ফলে সত্যতারও অভাব ঘটে কখনও।
এখানে কিন্তু অভিযোগের তালিকায় আরো রয়েছে, শিলচরের ডাক্তাররা নিজেদের ক্লিনিক খুলে রীতিমত ‘ব্যবসা’ করছেন। আর ‘ব্যবসা’ জাতীয় শব্দ প্রকৃত চিকিৎসকদের জন্য অপমানজনক নয়?
অভিযোগটা মানছিও আবার মানছিও না। কারণ শিলচর জায়গা ছোট এবং রোগীর তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। আমার বয়স অনুযায়ী ১৫ জন রোগী দেখাই উচিত। কিন্তু বেশী রোগী এলে আমাকে দেখতে হয়। নাহলে রোগী দেখছি না বলে নিজে খারাপ হতে হবে সবার কাছে। ছোট জায়গায় সামাজিক বন্ধনটা খুব বেশি থাকায় রোগী দেখার সংখ্যার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা টানা মুস্কিল।
তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে ‘ব্যবসা’ শব্দ জুড়ে যাওয়া অবশ্যই অপমানজনক। আর আপনি যে অভিযোগের কথা বলেছেন, তা সব ক্ষেত্রে না হলেও কিছু ক্ষেত্রেতো অবশ্যই সত্যি।
নার্সিংহোমের মত শিলচর মেডিক্যাল কলেজও কি বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসে?
চুক্তি অনুসারে নিশ্চয়ই আনতে পারে। গুয়াহাটি কিংবা ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজ থেকেও আনা যেতে পারে।
কিন্তু আনা হয় কি?
আমি যতদূর জানি, যে বিভাগগুলোতে বিশেষজ্ঞ নেই, সেখানে আনার এখনও ব্যবস্থা করা হয়নি।
বাইরে থেকে ডাক্তার এনে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়?
হ্যাঁ, অনেক সময়ই হয়। এখানে আরো একটা কথা বলতে চাই। যন্ত্রপাতির দিক দিয়েও মেডিক্যাল কলেজ নার্সিংহোম থেকে কোন অংশে কম নয়।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি, বাইরেতো এখন আকছার হচ্ছে, তবে শিলচরেও কি হাঁটু প্রতিস্হাপন মানে নি রিপ্লেসমেন্ট হয়?
হ্যাঁ, শিলচরে নিয়মিতভাবেই নি রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে।
এই অস্ত্রোপচার কি একশ শতাংশ সফল হয়?
হ্যাঁ, যদি ভালোভাবে করা হয় মানে প্রয়োজনীয় সবকিছু বজায় রেখে করা হয় তাহলে অবশ্যই সফল হয়।
আপনার এই আশ্বাস অবশ্যই অনেকের উপকারে আসবে, কারণ ব্যাধিতে ভোগলেও নি রিপ্লেসমেন্ট করাতে অনেকেই ভয় পান। বলা হয় ৩০ উর্দ্ধে মহিলারা ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় সংক্রান্ত অনেক রোগের শিকার হন। তাদের জন্য আপনার কোনও বিশেষ পরামর্শ?
এই ক্ষেত্রে আমি বলব প্রথমে সুষম খাদ্য (যা সহজলভ্য) বা ব্যাল্যান্স ডায়েট মেনে চলতে হবে, তার সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম। তবে সবচাইতে জরুরী ভিটামিন ডি।যার অভাবে অনেক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই অন্তত পক্ষে আধা ঘন্টা সময় সবার রোদ্রে বসা উচিত। এই তিনটি জিনিস যদি মেনে চলা যায় তবে এক্ষেত্রে নিজেকে রোগমুক্ত রাখা সম্ভব হবে।
অস্থি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার সাধারণ মানুষের প্রতি কোন পরামর্শ?
যা মহিলাদের জন্য বলেছি তা-ই সবার জন্য প্রযোজ্য। ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সাঁতারটা খুবই সহায়ক। কিন্তু শিলচরে যেহেতু সাঁতারের বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই তাই খোলা আকাশের নীচে সকালে অন্তত আধা ঘন্টা সময় হাঁটা খুব জরুরী। আর সব জয়েন্টের মধ্যে নি জয়েন্টটা খুবই সাংঘাতিক। আজকাল হাঁটুর ব্যাধিতে অনেকেই ভোগছেন। তাই এক্ষেত্রে অন্যান্য সাবধানতার সঙ্গে নিজেদের ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরী।
Comments are closed.