Also read in

মহানবমীতে গিয়ারে চাপ, সেল্ফিতেই পুজোর রিংটোন সেট টিনএজারদের

“সবার বুকে যাক বয়ে যাক প্রেমের ফল্গুধারা
শতবর্ষে এবার অম্বিকাপুর পূর্বপাড়া..
হাসপাতাল রোড আর অম্বিকাপুর পূর্বপাড়া।”
হ্যাঁ আজ থেকে ঠিক চারদিন আগে শিলচর অম্বিকাপট্টি পয়েণ্ট সংলগ্ন এক অস্থায়ী মঞ্চে উন্মোচন হওয়া এই ভিডিও থিমসং, শহর শিলচরের বুকে ‘পুজো’ নামক আবেগের রিংটোন সেট করে দিয়ে যায়। এই আবেগের জন্য প্রতিটি বাঙালি একটা বছরের অপেক্ষা করে থাকে। শুরু হতে থাকে হাজারো স্বপ্ন বোনা। শুধু তাই নয় এক্কেবারে ষোলোআনা উসুল করে দেবার প্রচেষ্টায় প্রতিটি বাঙালি নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সারা বিশ্বজুড়ে। এটাই বোধহয় মানবজীবনের সুখ-দুঃখের মাঝে সেরা প্রাপ্তি৷ তবে সেই আবেগে থাকে না কোন ভয়, থাকে না কোন দেনা-পাওনার হিসেবনিকেশ। এভাবেই যুগের পর যুগ কেটে যায়, কিন্তু ভাললাগা ভালবাসাগুলি বুকের কুঁড়েঘরে জলছাপ হয়ে মিশে যায়। হয়ে ওঠে খুবই কাছের।

আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ঘন ঘন চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যায় এমনই এক রাতের সাক্ষী ছিলেন শিলচরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। মহাষষ্ঠীর ভোরে মুষলধারে নেমে আসে বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে আশঙ্কার কালোছায়া নেমে আসে। এবারও কী তবে পুজোর প্ল্যান বানচাল করে দিতে কোমর কষে নেমেছেন বরুণদেবতা? যদি নেমে থাকেন তবে তাঁর প্ল্যান যেন ভেস্তে যায় সেই আশায় মায়ের কাছে ছুটে গেছেন সবাই।প্রার্থনা জানিয়েছেন যে অন্তত এবারের পুজো যেন ভেস্তে না যায়। মা বোধহয় মর্তলোকে বাপের বাড়ির আবদার শুনলেন। কারণ এরপর আর বৃষ্টির টিকির নাগাল কেউ পাননি। সুতরাং এমন পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে মহাসপ্তমী কাটল অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই। মহাসপ্তমীর সকাল থেকে রাত পুরোটাই কেটে গেল এক অন্যরকম ছন্দে। বেশ কিছু পুজো মণ্ডপ পঞ্চমীর সন্ধ্যাতে উদ্ধোধন হয়ে যাওয়ায় শিলচরের মানুষ সেদিন থেকেই চুটিয়ে এ মণ্ডপ থেকে সে মণ্ডপে ঘুরাঘুরি শুরু করে দেন। ফলে সপ্তমীতে সারা রাতজুড়েই শহরে একের পর এক প্যাণ্ডেলে মানুষের ছড়াছড়ি ছিল। অনেকেই সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা শেষ করে ফেলেন। ব্যস আর কি চাই। এবারে আগামী দুদিন জমিয়ে আড্ডা হবে পাড়ায় পাড়ায়। সারা বছর ভর অপেক্ষার পর আসা এ আড্ডা মিস করাটা শহরের অধিকাংশ মানুষই চান না। তাই তো আবেগ ভালবাসা আর স্নেহের মেলবন্ধনে এসব আড্ডা এক আলাদাভাবে স্থান করে নেয় বুকের মাঝে।

তবে পুজো মানেই শহর শিলচরের টিনএজার হোক কিংবা সদ্য টিন এজ পেরিয়ে আসা প্রতিটি ছেলেমেয়ের কাছে এক আলাদা বার্তা পৌছে দেয়। বেশিরভাগই বছরভর অপেক্ষার পালা শেষে বাড়ি ফিরে আসেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের পুরনোদিনের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করার জন্য মনপ্রাণ আকুল হয়ে ওঠে সবার। এমতাবস্থায় ভরসার স্থান একমাত্র শিলচরের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম। স্বাত্ত্বিক পূজার্চনার জন্য শুরু থেকেই প্রতিজন ভক্তের হৃদয়ে এক আলাদা স্থান অর্জন করতে পেরেছেন সন্ন্যাসী মহারাজরা। সুতরাং প্রতিবছর সপ্তমী, অষ্টমী কিংবা নবমী তিনদিনই পুষ্পাঞ্জলি অর্পনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান শহর শিলচরের কলেজপড়ুয়া কিংবা সদ্য ভার্সিটির দরজা পেরিয়ে কর্মজীবনের বারান্দায় পা রাখা যুবক-যুবতীরা। এবারও তার অন্যথা হয়নি। সপ্তমীর সকালেই ভরে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ। পাঞ্জাবী আর শাড়ির মিশেল স্বাভাবিকভাবেই এক আলাদা অনুভূতির সঞ্চার করে দেয় সবারই মনে। সপ্তমীর সকালে মায়ের পদতলে অঞ্জলিদানে অপেক্ষার অবসান হয়। ঢাক-ঢোল-ধুনুচি নাচে মনে বেজে ওঠে মায়ের পুজোর ঘণ্টা। বিদেশের মাটি থেকে দেশের মাটিতে পা রেখে সেই আগেকার বন্ধুবান্ধবদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার জায়গা তাই নিঃসন্দেহে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম প্রাঙ্গণ। তাই সকাল থেকেই রং বেরঙের পাঞ্জাবি আর শাড়ির বাহার শুরু হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। আড্ডার ছলে জমে ওঠে পুরনো গল্প। কথায় কথায় উঠে আসে বর্তমানের কথা। হ্যাঁ এভাবেই ছন্দে মেতে ওঠে আমার শহর শিলচর। দিন শেষে আসে রাতের পালা। রাতের পুজো দেখতে দেখতে কখন যে ভোররাত হয়ে আসে তার কোন খোঁজই রাখেন না দর্শনার্থীরা। ভিড় এড়াতে রাতের শহরই পছন্দ তাঁদের। সুতরাং সপ্তমীতে সারা শহরজুড়ে প্রায় প্রতিটি মণ্ডপেই দেখা যায় দর্শনার্থীদের অবাধ বিচরণ।

এভাবেই আসে মহাষ্টমীর সকাল। পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপে সকাল হতেই ছুটে আসেন পাড়ার কাকিমা-জ্যাঠিমারা৷ যার যার মত করে নেমে পড়েন পুজোর আয়োজনে। তবে অনেকেই মনে করে থাকেন অষ্টমী মানেই একটু স্পেশাল কিছু। তাই মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতে ভরসার যোগান দেয় সেই রামকৃষ্ণ মিশন। হাজার হাজার ভক্তরা ফলপ্রসাদ সহযোগে খিচুড়ি আর ডালনা বেশ তারিয়ে তারিয়েই উপভোগ করেন। দিনের শেষ হতেই শহরের রাজপথে মণ্ডপমুখো হন সবাই৷ সন্ধ্যাবেলা মায়ের আরতি আর ঢাকের বাজনার তালে শহরের বুকের বিভিন্ন মণ্ডপগুলিতে জমে উঠে এক মোহময় পরিবেশ। প্রতিটি মণ্ডপ সন্ধ্যা হতেই চলে যায় সেল্ফিপ্রেমীদের দখলে। ফেসবুকের পর্দা কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের স্টেটাস দেওয়ার জন্য চলতে থাকে একের পর এক ফটোসেশন। কিংবা মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে বার বার একটাই আবেগ ভেসে উঠে শহরের বুকে। এ আবেগ আর কিছুই নয় বছর ঘুরে মায়ের আগমনের দ্বিতীয় দিনে হইচই করে ঘুরে বেড়ানোর আবেগ৷ এ আবেগ ভালবাসার মানুষের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তকে সযত্নে আগলে রেখে মনের স্মৃতির মণিকোঠায় চিরকালের জন্য বন্দি করে রাখার আবেগ। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে দিয়ে রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ শহর জুড়ে নেমে আসে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত এ শহরের রাজপথে বিভিন্ন প্যাণ্ডেলের আলোর রোশনাই এক আলাদা শিলচরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের। আর যাই হোক স্মৃতিতে অনেকটাই জায়গা দখল করে রাখবে এ বৃষ্টিধারা। বিভিন্ন প্যাণ্ডেলে আটকে পড়া দর্শনার্থীদের একাংশ একান্ত নিরূপায় হয়ে অগত্যা প্যাণ্ডেলের ভেতরেই ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে নিজেদের বিভিন্ন কথা তুলে ধরেন কিংবা বিভিন্ন গানে কোমর দুলিয়ে নেচে ওঠেন উনারা। তবে হঠাৎ করে নেমে আসা এ বৃষ্টি যদিও সারা রাত বহাল তবিয়তেই বিরাজমান ছিল শহরের বুকে। সবাই ভাবছিলেন কি হয়, কি হয়, না জানি নবমীর সকালের সব প্ল্যান ভেস্তে দেয় এ বৃষ্টি। কিন্তু না তেমন কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি।

মহানবমীর সকাল হতেই মেঘলা আকাশ ভেদ করে একচিলতে রোদের আলোর দেখা মেলে। এতে মূহুর্তেই আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েন সবাই। পুজোর শেষদিনে টপগিয়ারে চাপ দিয়েই সকাল থেকে তাই শহরের রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার জনতার ঢল। বিকাল হতেই পুজোর শেষদিনের আনন্দ উদযাপনে ঝাপিয়ে পড়েন সব শ্রেণীর মানুষ। হই-হুল্লোড়ে এগিয়ে চলেন সবাই। কোথায় ভিড় ছিল না বলতে পারেন? অম্বিকাপট্টি, হাসপাতাল রোড, বিলপার, দক্ষিণ বিলপার, সোনাই রোড, তারাপুর, শিলংপট্টি সহ শহরের প্রত্যন্ত এলাকায় যেদিকেই চোখ গেছে সবদিকে শুধু অগুনতি মাথাই দেখা গেছে। ঘড়ির কাঁটা প্রায় রাত ৯টা ছুঁই ছুঁই করছে ঠিক তখনই শহরের বুকে নেমে আসে মুষলধারে বৃষ্টিধারা। বিভিন্ন মণ্ডপে আটকে পড়েন দর্শনার্থীরা। কিন্তু এভাবে আটকে পড়লে তো আর পায়ে হেঁটে শহরের প্রতিমা দেখা সম্ভব নয়। ঠিক তখনই এক অতুলনীয় দৃশ্য আমাদের চোখে তাক লাগিয়ে দেয়। অশুভ শক্তির বিনাশিনীকে শেষবারের মত দেখার জন্য বৃষ্টিভেজা শরীরেই এগিয়ে যেতে থাকে জনস্রোত। একদিকে অঝোরধারায় বৃষ্টি আর অন্যদিকে সেই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দর্শনার্থীর এহেন বেপরোয়া ভাব সত্যি ইতিহাসের পাতায় সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত। আসলে রাত পেরোলেই আবার সেই একটি বছরের অপেক্ষা। তাই সারা রাত জেগে পুজোর শেষরাত উপভোগ করার পরিকল্পনা নিয়েই পথে৷ নামেন সবাই। শুধু শহর কিংবা শহরতলি নয় এবারকার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উধারবন্দের পুজো দেখতেও সারারাতব্যাপী গাড়ির মিছিল দেখা যায় সুদূর মহাসড়কেও। হ্যাঁ এভাবেই ২০১৯ এর শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষরাতের পুজোয় মেতে উঠেছিল আমাদের প্রাণের শহর, আমাদের ভালবাসার শহর শিলচর। আগামীর দিনগুলি যেন সুন্দর হয়ে ওঠে এ কামনায় মায়ের বিদায়বেলায় সবার মঙ্গল কামনার সাথে মায়ের কাছে একটাই আবদার, মায়ের আশীর্বাদে সবার জীবনে নেমে আসুক সুখ-শান্তি। ভালবাসায় ভরে উঠুক প্রতিজন মানুষের জীবন। আর হ্যাঁ আজ বিদায়বেলায় বিজয়ার রাতটা যেন ভালভাবে কোনধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই কাটে এ আশা রাখছি। সবাই ভাল থাকবেন, আর সবাইকে ভাল রাখবেন।।

Comments are closed.