ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক কিনথাপ - চতুর্থ পর্ব
কিনথাপ তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে গ্যাদঙেই আশ্রয় নিলেন। দিন কয়েকের মধ্যেই পালটে গেল সেই লামা। গ্রামবাসীদের সঙ্গে জুয়াও খেলতে শুরু করল। কিভাবে কিজানি গ্রামের মোড়লের সাথেও ভাব জমিয়ে ফেলল সে। দুজনে উঠে গেল মোড়লের বাড়িতে। দুদিন পর সেই লামা এসে বলল, একটা বিশেষ কাজে সে গ্যায়লা ফিরে যাচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে এসে আবার যোগ দেবে কিনথাপের সঙ্গে। এই ক’দিন সে মোড়লের বাড়িতেই থাকতে পারবে। সরলমনে কিনথাপ সেকথা বিশ্বাস করলেন। কিন্তু দু মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখা নেই সেই লামার। এদিকে পেট চালানোর জন্য দর্জির কাজ করছেন তিনি। মোড়লের বাড়িতে আছেন,খাচ্ছেন, তাই তার পারিবারিক কাজেও সাহায্য সহযোগিতা করছেন। একদিন এক গ্রাম্য যুবকের কাছে জানতে পারলেন, সেই লামা জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গিয়েছিল। সেই দেনা মেটাতেই সে কিনথাপকে নিজের ক্রীতদাস পরিচয় দিয়ে গ্যাদঙের মোড়লের কাছে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল কিনথাপের। জন্মভূমি থেকে শতশত মাইল দূরে এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে নিজের অজান্তেই ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন তিনি ! এখন উপায়? মোড়লকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে তিনি জানলেন, কথা সত্য। নিজের তীর্থযাত্রী পরিচয় দিয়ে তিনি অনেক অনুনয় বিনয় করলেন। জানালেন, সেই লামা তার প্রভু তো নয়ই, তাকে তিনি ভাল করে চেনেনও না। লাসাতেই পরিচয়। সেও তীর্থভ্রমণে যেতে চায় শুনে তাকে সঙ্গী হিসেবে সাথে নিয়েছেন।মোড়ল তার কথায় কান দিলেন না। তবে বললেন, লামা কে দেওয়া সেই চল্লিশ টাকা যদি তিনি দিতে পারেন, তবে তিনি মুক্ত হতে পারবেন ক্রীতদাসত্ব থেকে।চোখে অন্ধকার দেখলেও ভেঙে পড়লেন না কিনথাপ। আন্তরিকতার সাথে মোড়লের বাড়ির কাজ করে যেতে থাকলেন। এভাবে সাতমাস ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করার পর একদিন সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু আশ্চর্য ধাতুতে গড়া এই কিনথাপ। দায়িত্বের কথা ঘোর বিপদের দিনেও ভুললেন না। লাসার পথে পালিয়ে না গিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন সাংপোর নিম্ন অববাহিকা ধরে। সাংপো-ই ব্রহ্মপুত্র কি না, তা প্রমাণের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার আর ক্যাপ্টেন হেনরির কাছ থেকে। তাকে এগিয়ে যেতেই হবে।
পো মে জিলার সীমানা ছাড়িয়ে তিনি দরজিসাকু জিলায় ঢুকে পড়লেন। পেরিয়ে গেলেন একের পর এক পাহাড়ি গ্রাম। যতোই এগোচ্ছেন, বরফ ঢাকা পাহাড় কমে আসছে, বাড়ছে জঙ্গলের ঘনত্ব। চেনা অচেনা হাজার জাতের গাছ গাছালি লতায় পাতায় জঙ্গল ক্রমেই দুর্ভেদ্য হচ্ছে। দক্ষিণাভিমুখী নদীও বাড়িয়ে দিয়েছে তার খেয়ালিপনা। প্রতি কুড়ি পঁচিশ মিটারেই বাঁক নিচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে।কোথাও কোথাও বিশাল শিলাখণ্ড কে ভাঞতে না পেরে লুকিয়ে যাচ্ছে তার তলায়, আবার বেরিয়ে আসছে। এভাবেই কাটলো আরো কিছুদিন। নরতুঙ গ্রামের পাশেই মরবুং বৌদ্ধ বিহার। রাত্রিবেলা আশ্রয় নিলেন সেই গুম্ফায়।কিন্তু কিনথাপের ভাগ্য মন্দ। নরতুঙ গ্রাম পেরিয়ে আসার সময় এক সরকারি গোয়েন্দার চোখে পড়ে যান তিনি। গ্যাদঙের মোড়ল আগেই সরকারী আধিকারিক দের কাছে ক্রীতদাস পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে রেখেছিল। সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল নরতুঙেও। গভীর রাতে সেই গোয়েন্দা তার অনুচরদের নিয়ে মরবুং গুম্ফায় এসে কিনথাপকে গ্রেফতার করে। গুম্ফার প্রধান লামার পায়ে কেঁদে পড়লেন কিনথাপ। লাসা থেকে সেই বিশ্বাসঘাতক সঙ্গীর সঙ্গে তীর্থযাত্রা এবং পরবর্তীতে অন্যায়ভাবে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া, সাতমাস বেগার খাটা, সব কিছুই খুলে বললেন। লামার দয়া হলো। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি কিনথাপকে মুক্ত করে দিলেন। এই মহানতার প্রতিদানে এখানেও সাড়ে চারমাস বৌদ্ধবিহারের কাজ করলেন তিনি। তারপর একদিন প্রধান লামার কাছে অনুমতি চাইলেন। নদীর ওপারে গোন্দু পোদ্রাঙ পর্বতের পবিত্র হ্রদ গুলিতে তীর্থ করতে যাবেন। ভগবান বুদ্ধের প্রতি সাধারণ এক শ্রমিকের এমন শ্রদ্ধাভক্তি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অনুমতি দিলেন সানন্দে। নদী পেরিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যদিয়ে তিনি আত্মগোপন করে করে সাংপোর পাড় ধরে এগোতে লাগলেন। কিন্তু সমতলের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। গভীর জঙ্গলে এক গুহায় লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি কয়েকদিন কাটালেন। আরো কতদূর যেতে হবে, আরো কত দুর্গম হবে পাহাড়, আরো কি ধরণের আপদ বিপদ অপেক্ষা করে আছে কে জানে। সিদ্ধান্ত নিলেন, আর এগোবেন না। সেই গুহাতেই বসে বসে তিনি গাছের ডাল কেটে বানালেন দু’ফুট লম্বা, বেশ মোটা ৫০০টি টুকরো। তারপর সেগুলিতে পরিয়ে দিলেন জেনারেল ওয়াকারের দেওয়া সেই ধাতুর রিং গুলি। গত প্রায় দেড় বছর ধরে অগুন্তি বিপদেও অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেগুলি লুকিয়ে রাখতে সফল হয়েছিলেন কিনথাপ। এবার ফিরে যেতে হবে লাসায়। সেখানে গিয়ে কালিম্পঙ বা কলকাতায় খবর পাঠাতে হবে, যাতে ঠিক তিন মাস পরে লোহিত, দিবং আর সিয়াং নদীর তীরে ছাউনি ফেলেন ক্যাপ্টেন হেনরি। ফিরে চললেন কিনথাপ।
ভাগ্যের কী পরিহাস! তথ্য এবং জ্ঞানের অভাবে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে চীন সীমান্তের শেষ গ্রাম জেলিং থেকে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরে এসেও ফিরে যাচ্ছেন তিনি সুদূর লাসায়। আর মাত্র আশি কিলোমিটার নেমে আসতে পারলে তিনিই হতেন ব্রহ্মপুত্রের আসল আবিষ্কারক। পৌছে যেতেন শদিয়ায়। আরো তিন মাস সেই চড়াই উৎরাই ভেঙে, সেই শীতের কামড় খেয়ে, সেই প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টকে স্বীকার করে কিনথাপ গিয়ে পৌছালেন লাসায়। কালিম্পঙের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে খবর পাঠালেন নেম সিঙের কাছে। নেম সিংও একজন পর্বত অভিযাত্রী, তার কাছেই খবর পাঠানোর কথা বলে দিয়েছিলেন জেনারেল ওয়াকার এবং ক্যাপ্টেন হেনরি। কিন্তু প্রচণ্ড অসুস্থ হওয়ায় হেনরির দিদি যে এসে তাকে ইতালিতে নিয়ে গেছেন চিকিৎসার জন্য, এ খবর তো আর হিমালয়ের গভীর উপত্যকায় দাসত্ব খাটতে থাকা কিনথাপের জানার কথা নয়। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের এক হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ১৮৮৩র ১৪ এপ্রিল প্রাণত্যাগ করেন ক্যাপ্টেন হারমান হেনরি। এদিকে, আড়াই বছর ধরে কোনো খবর না পেয়ে জেনারেল ওয়াকারও ধরে নিয়েছিলেন হিমালয়ের তুষার সাম্রাজ্যের কোথাও বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন কিনথাপ। তাই খবর পেয়েও সে কথা কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না নেম সিং। কিন্তু নির্দেশ মত খবর পাঠিয়ে ১৮৮২ সালের শীতে কিনথাপ আবার তিন মাস হেঁটে ফিরে চললেন মরবুঙের উদ্দেশ্যে। আগে আসার সময়ের গ্রাম গুলি এড়িয়ে কিছুটা নতুন পথে মরবুঙে এসে পৌছালেন তিনি। খুঁজে বের করলেন সেই গুহা। নির্দিষ্ট দিন থেকে প্রতিদিন পঞ্চাশ টুকরো করে রিং লাগানো গাছের ডাল ফেলে দিলেন সাংপোর জলে। কিন্তু খবর না পাওয়ায় কেউই তখন সিয়াং, দিবং বা লোহিতের পারে অপেক্ষা করে ছিলনা তার সেই ডালের অপেক্ষায়। কিছু ডাল নিশ্চয় টুটিং, পাশিঘাট, শদিয়া হয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারা বেয়ে হারিয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের অথৈ নীলে। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে এক অদম্য সিংহপুরুষের রক্তে ঘামে লেখা এক অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের কাহিনী এবং স্বপ্নও। ১৮৮৪ সালের ১৭ নভেম্বর লাসা এবং সিকিম হয়ে প্রচণ্ড প্রাণশক্তির জোরে দার্জিলিঙে ফিরে এসেছিলেন বিধ্বস্ত কিনথাপ। কিন্তু সে খবরও দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল ওয়াকারের কাছে গিয়ে পৌছায় নি। চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তিনিও ইংল্যান্ডে ফিরে গেছেন ১৮৮৩ সালে।
পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে হলে নিচে ক্লিক করুন :
https://barakbulletin.com/bn_BD/ashu-pauls-special-writeup-on-kinthup-part-3/
Comments are closed.