Also read in

ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক কিনথাপ" - পঞ্চম তথা শেষ পর্ব

কাহিনীর পূর্ববর্তী অংশ জানতে হলে নিচে ক্লিক করুন :

ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক কিনথাপ – চতুর্থ পর্ব

১৮৮৬ সালে কর্ণেল ট্যানার নামে আরেক পর্বত অভিযাত্রী বিভিন্ন সূত্র থেকে কিনথাপের অভিযানের খবর পান। তিনি ছুটে যান দার্জিলিঙে। শহরের এক এঁদো গলিতে ভগ্নপ্রায় এক আস্তানায় দর্জির কাজ করে দিনাতিপাত করছিলেন কিনথাপ। ট্যানার তাকে নিয়ে যান উগিয়েন গ্যাস্তো নামের এক বৌদ্ধ লামার কাছে। কিনথাপ তার অভিযানের সমস্ত ঘটনা নিজের ভাষায় বিবৃত করেন সেই লামার কাছে। সেই লামার কাছ থেকে লামা ভাষায় সেটা শোনেন নরপু নামের লামা বংশোদ্ভূত সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এক ইংরাজি শিক্ষিত কর্মী। নরপু-র লিখিত সেই বিবরণ ১৮৮৯ সালে ছাপিয়ে “কিনথাপ অভিযানের বিবরণ” নাম দিয়ে প্রকাশ করে সার্ভে অব ইন্ডিয়া। ১৮৭৯-র এপ্রিল থেকে ১৮৮৪-র নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘটনাবলী শুধুমাত্র স্মৃতি থেকে বলেছেন কিনথাপ।তা-ও বলেছেন দার্জিলিং ফিরে আসার আরো দু বছর পর। তাছাড়া কিনথাপের মুখ থেকে উগিয়েন গ্যাস্তো, আর গ্যাস্তোর মুখ থেকে নরপু যা শুনেছেন, তাই লিখেছেন।

কাজেই অল্প বিস্তর এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। এই প্রতিবেদন নিয়ে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায় সারা বিশ্বে। তার প্রধান কারণ কিনথাপ একজন অশিক্ষিত পাহাড়ি দর্জি মাত্র। এত বিপদসঙ্কুল পথ তিনি সত্যিই পাড়ি দিয়েছেন, সত্যিই তিনি সাংপোর তীর ধরে মরবুং অব্দি গিয়েছেন – তৎকালীন বিদ্বৎ সমাজ তা মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু এক বছর পর ট্যানার নিজে সেই বই সাথে নিয়ে সাংপো অভিযানে গিয়ে রামধনু জলপ্রপাত (রেনবো ফলস) ও গুপ্ত জলপ্রপাত (হিডেন ফলস) পর্যন্ত যেতে সক্ষম হন। চরম আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, কিনথাপের বিবরণ ৯৫ শতাংশেরও বেশি হুবহু বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়। প্রতিটি গ্রামের দূরত্ব, উচ্চতা, নদীর বাঁক, গভীরতা, হিমবাহের নাম এবং অবস্থান,ছোট বড় মাঝারি উপনদী গুলির সাংপোতে মিশে যাওয়া ইত্যাদির বিবরণ প্রায় নিখুঁত ভাবে বিবৃত করেছেন কিনথাপ। শুধু একটাই অমিল খুঁজে পাওয়া গেল।

পেমাকো ছুং-এর পাশে এক শ’ দেড়েক ফুটের জলপ্রপাতের কথা লেখা আছে বইয়ে। সেটি পাওয়া গেল না। ট্যানার ফিরে এসে অনুসন্ধান করে দেখলেন, কিনথাপ সেখানে কোনও জলপ্রপাতের কথা আদৌ বলেন নি। গ্যাস্তোও স্বীকার করলেন, জলপ্রপাত নয় দেড়শ’ ফুটের মত জায়গা হড়হড়িয়ে সাংপো-র নেমে যাওয়ার কথাই বলেছেন কিনথাপ। নরপু-ও বললেন, হড়হড়িয়ে নেমে যাওয়ার ব্যাপারটিকেই তিনি জলপ্রপাত বলে ভুল বুঝেছেন। মিথ্যা বলার অপবাদ থেকে রেহাই পেলেন কিনথাপ। কিনথাপের প্রতি শ্রদ্ধায় সারা বিশ্বের মাথা নীচু হয়ে গেল। তাঁর সম্মানে সাংপোর ভৌগোলিক তথ্যে এই জায়গাটিকে একটি ‘জলপ্রপাত’হিসেবেই বিশেষ স্বীকৃতি দিয়ে নামকরণ হলো “কিনথাপ ফলস”।

প্রায় তিরিশ বছর পর, ১৯১৩ সালে আরেক বিখ্যাত অভিযাত্রী ফ্রেডরিখ মার্শম্যান বেইলি এবং হেনরি মর্শহেড শদিয়া থেকে সিয়াঙের উজান অববাহিকা ধরে অভিযান চালিয়ে পেমাকো ছুং অব্দি পৌছে যান। কিনথাপের বর্ণনার সঙ্গে কোথাও তিনি বাস্তবের কোনো গরমিল খুঁজে পান নি। তিরিশ বছর আগে, প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে একা একজন অশিক্ষিত মানুষ কোনো ধরণের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ছাড়াই এতদূর এসেছেন, প্রতিটি জায়গার, প্রতিটি পদক্ষেপের নিখুঁত বর্ণনা দীর্ঘদিন শুধু স্মৃতিতে ধরে রেখে বিবৃত করেছেন, কাজের প্রতি কী অসাধারণ নিষ্ঠা আর কী প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম সত্বেও তিনি লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি – ভাবতেই বেইলি-র মাথা শ্রদ্ধায় অবনমিত হয়ে এলো ওই না দেখা মহান পর্বত অভিযাত্রীর জন্য। ফেরার পথে মরবুং বৌদ্ধ বিহারে ঢুকে তিনি প্রধান লামার হাতে সশ্রদ্ধ চিত্তে ৫০টি টাকা তুলে দিয়ে বলেন,সেই মহান অভিযাত্রীকে আপনারা মন থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত করে দিন। এই মঠের প্রাক্তন প্রধান লামা কিনথাপকে মুক্ত করেছিলেন সরকারি গুপ্তচরের হাত থেকে। শদিয়া ফিরেই বেইলি ছুটে যান দার্জিলিঙে। কিনথাপ তখন ৬৬ বছরের বৃদ্ধ। আবেগে শ্রদ্ধায় বুকে জড়িয়ে ধরেন সেই অখ্যাত নায়ক কে। চোখের জলে ভাসছিলেন বেইলি। জীবনের বাকি দিন গুলি যাতে আর কষ্ট করে কাটাতে না হয় তার জন্য কিনথাপকে উপযুক্ত মাসোহারা দেবার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন জানান তিনি। কিন্তু মাসোহারার বদলে এককালীন এক হাজার টাকার অনুদান দেয় সরকার। সেদিনের এক হাজার টাকা আজকের দিনের তুলনায় অবশ্যই এক বিশাল রাশি হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু কিনথাপকে সাংপো-ব্রহ্মপুত্রের প্রথম সফল অভিযাত্রীর শিরোপা দেওয়ার বদান্যতা, না সেদিনের ব্রিটিশ সরকার দেখাতে পেরেছিল, না পেরেছে আজকের দিনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি। অপ্রাপ্তি ও অস্বীকৃতির এই জ্বালা বুকে নিয়ে ৭১ বছর বয়সে এই মহান অভিযাত্রী দার্জিলিঙেই চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন।

২০১৬ সালে ডিব্রুগড়ে থাকার সময় খ্যাতনামা সাংবাদিক মৃণাল তালুকদারের লেখা “ছাংপোৰ পৰা ব্রহ্মপুত্রলৈ” বইখানি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম সংস্কৃতিকর্মী শ্রদ্ধেয়া মৈত্রেয়ী বরুয়া ভৌমিকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। ওই বইয়েরই এক পরিচ্ছেদে আমি খুঁজে পাই কিনথাপকে। সেই বিশাল ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণ ভাবে নাড়া দিয়ে যান। তারপর থেকে গত চার বছর ধরে তন্নতন্ন করে ইন্টারনেটে তাঁকে খুঁজেছি। ইংরাজিতে কোথাও তাঁকে Kintup আবার কোথাও Kinthup নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও আবার এটিকে একটি ছদ্মনাম বলেও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন লেখায় অল্প বিস্তর অমিল এবং তথ্যের তারতম্য রয়েছে। সব লেখালেখি থেকেই যেহেতু আমার এই কাহিনীর মশলা সংগ্রহ করেছি, তাই সেগুলোর ছাপ আমার লেখায় নিশ্চয় থাকবে। এই লেখাকে তাই ঐতিহাসিক দলিল না ভেবে একজন অচেনা মানুষের কাহিনী হিসেবে দেখতে পাঠকদের অনুরোধ জানাচ্ছি।– আশু পাল।

কাহিনীর পূর্ববর্তী অংশ জানতে হলে নিচে ক্লিক করুন :

ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক কিনথাপ – চতুর্থ পর্ব

Comments are closed.