"দরজায় বাইরে থেকে তালা ছিল না," আম্বিকাপট্টি আগুনে সন্তান হারানো সর্বরী
অফিসে যাওয়ার আগে যখন চার বছরের রত্নদ্বীপকে তার মা ‘টাটা’ করছিলেন, তখনো তিনি জানতেন না কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার কোল উজার হয়ে যাবে!এও জানতেন না যে ছেলেকে চিরতরে বিদায় জানাচ্ছেন! আবার যখন জানতে পারলেন, ছেলে মারা যাওয়ার আগে পিশির চুলের মুঠি ধরে আর্তচিৎকার করে উঠেছিল, পিশি আমাকে বাঁচাও, তখন মায়ের হৃদয়ও আর্তনাদে কুঁকড়ে ওঠে, যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।
একদিকে কোলের সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে ঘটনাকে ঘিরে জট পাকানো নানা কথা,সব মিলিয়ে রত্নদ্বীপের মা’র দিশেহারা অবস্থা। আসলে কি ঘটেছিল সেদিন? সত্যি কি তালা বন্ধ ছিল রত্নদ্বীপ? কেন তাকে বাঁচাতে পারলো না তার পিসি সুপ্তি নাথ? কেমন ছিল ননদের সঙ্গে সম্পর্ক রত্নদ্বীপ’র মায়ের?যে ঘটনা ৪ বছরের ফুটফুটে শিশুকে বাঁচতে দিল না, অসময়ে ছিনিয়ে নিল মায়ের কোল থেকে, সেই ঘটনা আমাদের সবার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে, কেঁদে উঠেছে আমাদের হৃদয়!তাই ঘটনাকে ঘিরে এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রত্নদ্বীপ’র মায়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন বরাক বুলেটিনের সাংবাদিক। তার সম্পাদিত অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
ওই দিনের ঘটনাটা সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি
ওইদিনের ঘটনার সম্পর্কে আমি কি আর বলব! সকালে বাচ্চাকে খাইয়ে হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে টিভির সামনে বসিয়ে অফিসে গিয়েছিলাম। অফিসে আসার আগে ছেলে বায়না করেছিল, মা আমাকে চকলেট দিয়ে যাবে। মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে বলে স্কুল বন্ধ ছিল, তাই বাড়িতে রেখে যেতে হয়েছে। না হলে তো ও স্কুলেই থাকতো। ওকে অন্যদিনের মতো ‘বাই’ করে অফিসে যাই। তখনো জানতাম না শেষবারের মতো ‘বাই’ করছি। অফিসে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার ব্রিগেডের শব্দ শুনতে পাই। তখনো জানিনা, দুর্ঘটনাটা আমার ঘরেই ঘটে গেছে। আমরা অফিসে আলোচনা করেছি, কোথায় যেন আগুন লেগেছে! তখন কি জানতাম আমার কোলই উজার হতে চলেছে! কিছুক্ষণ পরেই আমার এক প্রতিবেশির ফোন পাই। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছেন, কি হয়েছে খবর নেওয়ার জন্য তিনি বলেন। আমার ঘরে ফোন নেই। তাই আমি পাশের বাড়িতে ফোন করি। তখন ওই বাড়ির মেয়েটি আমাকে জানায় যে আমাদের ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। একজন সহকর্মী আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সঙ্গে আসেন। বাড়ির সামনে প্রচণ্ড ভিড়। সবাই বলছে আমার ছেলে এবং আমার ননদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি বারবার চিৎকার করে বলছি, ওরা ঘরেই আছে। তখনো দেখতে পাচ্ছি ফায়ার ব্রিগেডের জল আমার ঘর অবধি পৌঁছয়নি।
ঘটনার পর একটা কথা শোনা গিয়েছিল যে আপনার ছেলে আপনাকে ফোন করে জানিয়েছে, ঘরে আগুন লেগে গেছে। এমনকি জেলা উপায়ুক্তও কথাটা উল্লেখ করেছেন। কথাটা কি সত্যি?
না, কথাটা সত্যি নয়। কারণ আমার ঘরে যে ফোন ছিল সেটার মধ্যে কোনও সিম ছিল না। আর এন্ড্রয়েড ফোনটা আমার সঙ্গেই ছিল। তাই আমার ছেলের ফোন করার প্রশ্নই উঠে না।
আপনার ছেলের সঙ্গে যিনি ছিলেন, তিনি আগুন লাগার পর ঘর থেকে বেরোলেন না কেন?
সেটাই তো আমারও প্রশ্ন!আমার ছেলে নাকি ওর চুল মুঠো করে ধরে চিৎকার করে বলেছিল, পিশি আমাকে বাঁচাও। কিন্তু ও কেন আমার ছেলেকে বের করে নিয়ে আসলো না? কেন ও যেখানে গেল সেখানে আমার ছেলেকেও নিয়ে গেল না? ও কেন আমার ছেলেকেও বাথরুমে নিয়ে গেল না? শাওয়ার ছেড়ে দিলে তো দুজনই বাঁচতে পারতো। আমি শুধু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাই।
ওর সঙ্গে যে তখন ঘরে ছিল সে হচ্ছে আমার ননদ। আমার বরের পিসতুতো বোন। ও আমাদের বাড়িতে এসেছিল একটি চাকরির সন্ধানে। চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়িও করছিল।অথচ দেখুন ও আমাদের বাড়িতে এসেছে বলেই আমি ছেলেকে বাড়িতে রেখে গেছি। না হলে ছেলেকে আমি স্কুল ছুটি থাকলে সব সময় অফিসেই নিয়ে যাই। আমার পাশে একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে রাখতাম। সে বসে মোবাইলে খেলা করতো।
এটা তো সত্যি আশ্চর্যের, মুহূর্তে আগুনটা এত ছড়িয়ে পড়ল যে ঘর থেকে ওরা বেরোতে পারল না, এমনকি ফায়ার ব্রিগেড আগুন নেভাতেও পারল না!
আমার ঘর বাড়ি সব জ্বলে পুড়ে গেলে আমার কোন অনুতাপ ছিল না , শুধু যদি আমার ছেলেটাকে ও বাঁচিয়ে দিত। দুই ঘরের মাঝখানে আমাদের বাথরুম। জলের তো অভাব ছিল না। যদি দু মগ জল ওর গায়ে ঢেলে দিত! আমার ছেলেটাকে নিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল না কেন? কিংবা অন্য ঘরে চলে যেতে পারত। ও কেন ওই ঘর থেকে আমার ছেলেকে বের করে আনলো না বুঝতে পারলাম না।ও নিজে তো বাঁচল। তাহলে কেন আমার ছেলেটাকে বাঁচালো না?
আপনার ননদকে কি আপনি এই প্রশ্নটা করেছেন? আপনার সঙ্গে কি আপনার ননদের ঘটনার পর সরাসরি কথা হয়েছে?
না, আমি ওর সামনে যেতে পারিনি। তাছাড়া ও এখন কথা বলতে পারছে না।
আপনার ননদের সঙ্গে আপনার কি কোন বিবাদ চলছিল?আপনাদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল ছিলনা?
না, এরকম কিছু নয়। আমার ছেলে ওকে পিশি বলে ডাকতো। খুব মিল ছিল। আমার সঙ্গেও সম্পর্ক ভাল ছিল। আমি ওকে অনেক জামাকাপড় কিনে দিয়েছি। আমার সঙ্গে ওকে বেড়াতে নিয়ে যেতাম। আত্মীয় পরিজনদের সামাজিক অনুষ্ঠানেও ওকে নিয়ে যেতাম।
ঘটনার দিন আপনি কি আপনার ঘর তালা বন্ধ করে গিয়েছিলেন?
না, মোটেই নয়। তালা বন্ধ করে কেন যাব বলুন তো? কোন মা কি এ কাজ করতে পারে? আমি যখন যাই তখন আমার ছেলে লিফট্ অবধি আসে। আমাকে টাটা করে। আর দু-তিন মাস হয়েছে আমার ননদ এখানে রয়েছে। তার আগে আমি ওকে অফিসেই নিয়ে যেতাম। কিছুদিন ধরে আমি অফিসে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ওরা একা থাকে। তারপর দেড়টার সময় ওর বাবা ঘরে এসে যায়।
তার আগে কি ওর বড় বোন থাকতো আপনাদের সঙ্গে? ওর সঙ্গেও সম্পর্ক ভাল ছিলনা?
হ্যাঁ, ওর বড় বোন আমাদের সঙ্গে থাকতো। এখন ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আসলে ও নিজেই বিয়ে করেছে। কিছুদিন আগেও ওর বর নিয়ে আমাদের ঘরে বেড়াতে এসেছিল।তাহলে ভাবুন, যদি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের ঘরে আসতো না বিয়ের পর।
এই যে প্রথমে বড় বোন থাকতো, তারপর ওর বিয়ের পর ছোট বোনকে নিয়ে এসেছেন, সেটা কি ওদেরকে সাহায্য করার জন্য, না আপনাদের ছেলের দেখাশুনার জন্য?
না ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়, কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন বড়বোন নিজের ছেলে এবং ছোট বোনকে নিয়ে এসে হাজির হয়। ওর ছেলে অসুস্থ ছিল।তারপর ছোটবোনটাও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি নিজে ওর চিকিৎসা করাই।সিটি স্ক্যান থেকে আরম্ভ করে প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা করিয়ে ওকে সুস্থ করে তুলি।আমাদের নিজের স্বার্থে নয়, বরং ওদের সাহায্য করতেই ওকে এখানে রেখেছিলাম। ও খুব ভালো মেয়ে, ওর মা-বাবাও ভীষণ ভালো মানুষ।
মেয়েটির পক্ষ থেকে আরও কিছু কথা উঠছে যে আপনারা কোন টাকা কড়ি না দিয়েই ওকে রেখেছেন।
ও আমাদের আত্মীয়। তাই ওকে তো টাকা কড়ি দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা ওর ভরণপোষণ দিচ্ছি। জামাকাপড় কিনে দিচ্ছি। আত্মীয়-স্বজন যাদের বাড়িতে যাচ্ছি, ওকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। এমনকি আমার বাবার বাড়িতেও ওকে নিয়ে গেছি।
আপনার স্বামী এখন কোথায়? আপনার সঙ্গে রয়েছেন?
না, উনি বাড়িতে ছিলেন। এখন শিলচর মেডিক্যাল কলেজে রয়েছেন। আমার ননদের যাতে ঠিকমত চিকিৎসা হয় তার ব্যবস্থা করতে। চতুর্থ দিনে আমার শ্বশুরবাড়িতে ছেলের কাজ হয়েছে। সেখানে আমার দাদা জামাইবাবু সবাই গিয়েছিলেন। আসার পথে ওরা আমার ননদের চিকিৎসা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় সেই ব্যবস্থা করতে শিলচর মেডিকেল কলেজে যান। কারণ শিলচর মেডিক্যাল কলেজে আমার ননদকে ‘অজানা ব্যক্তি’ হিসেবে এমনি ফেলে রেখেছিল। ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছিল না। ওরা নাম ধাম দিয়ে কার্ড বানিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এসেছেন।
আগুনটা কি ঠাকুর ঘর থেকে লেগেছিল?
সেটা তো আমি বলতে পারব না। তবে আমার ননদ বলছে প্রদীপ থেকে লেগেছে।সেদিন ঠাকুর দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার অসুবিধা থাকার কারণে ওকে বলেছিলাম। প্রদীপটা অামি সব সময় ওকে দিয়ে নিভিয়ে নেওয়াই। শুধু তাই নয়, আমার ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে রাখার জন্য সব সময় আমি বলতাম। ওর চোখের আড়াল না করার জন্য বিশেষভাবে বলে আসতাম।
আপনার কি আর কিছু বলার আছে?
হ্যাঁ। প্রচার মাধ্যমগুলোতে অনেক কথাই লেখা হচ্ছে। যারা দেখা করতে আসেন ওরা ও অনেক ধরনের কথা বলছেন। এগুলো শুনে খুব খারাপ লাগে। এমনিতেই তো আমার কোল উজার হয়ে গেছে। তার ওপর এসব কথা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। কেউ কি কারো ছেলেকে তালা বন্ধ করে রেখে যেতে পারে? আমি তো বেশি কিছু চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম আমার ছেলে ভালো থাকুক। অনেকে বলছে, আমার ননদের সঙ্গে আমার ঝগড়া ঝাটি ছিল। কিন্তু একথাটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওর বড় বোন কিছুটা উশৃংখল স্বভাবের ছিল বটে। নিজে পাত্র পছন্দ করে বিয়ে করে চলে যায়। কিন্তু আমার এই ননদের স্বভাব চরিত্র খুব ভালো। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। এগুলো মিথ্যে রটনা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার পরও আমি আমার স্বামীকে শিলচর মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়েছি, যে বেঁচে আছে তার চিকিৎসা যেন ঠিকমতো হয় বলে। কারণ সেও তো কারোর মেয়ে!
Comments are closed.