হুবাই না ইতালি! নিক্তিতে মাপার দায় ঘরমুখো ভিড়ের
বিভিন্ন রাজ্য থেকে আতঙ্কিত প্রবাসী শ্রমিকদের বাড়িমুখো ঢল যে কোনও মুহূর্তে লকডাউনের প্রাচীর ভেঙে দিতে পারে। পরিস্থিতি তাতে কী হবে, তা ভাবতেও ভয় লাগে। নিরুপায় প্রধানমন্ত্রী মানুষের কাছে এই মারাত্মক অসুবিধার জন্য মার্জনা চেয়েছেন। তবে একই সঙ্গে এটাও বলে রেখেছেন যে, এই কঠিন সময়ে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কঠিনতম সিদ্ধান্ত মানে লকডাউন। একুশ দিনের লকডাউন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি অন্য কোনও বিকল্প নেই সরকারের কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন লকডাউন চলবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো সুবিশাল একশ ত্রিশ কোটির দেশে লকডাউন কি সম্ভব?
বাগডোগরা থেকে আমার মামা ড: দেব প্রসাদ কর সেদিন ফোন করে বললেন, ‘করোনা ভাইরাস: হ্যামার আন্ড ড্যান্স’ লেখাটা পড়ো। আজ গুগল সার্চ করে পুরোটা পড়লাম। এটি লিখেছেন থমাস পুউয়ো বলে এক মার্কিন লেখক-গবেষক। তবে প্রায় কুড়ি পঁচিশজনের একটি টিম সারা বিশ্ব থেকে তথ্য জোগাড় করে দিয়েছেন। থমাস এর ভিত্তিতে নিবন্ধটি লিখেছেন। তবে এটি দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব ‘Corona virus : Why we must Act’ ৪০ মিলিয়ন মানুষ পড়েছেন, ত্রিশটি ভাষায় অনুবাদও হয়েছে। থমাস দ্বিতীয় পর্বটি লিখেছেন ২০ মার্চ, করোনা আতঙ্ক ততদিনে সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
গতকালই ফেসবুকে পড়ছিলাম ইতালির লেখক ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রির চিঠি। তিন সপ্তাহ ধরে লকডাউনে আছেন ফ্রান্সেস্কা। অন্তরীণ লেখক তাঁর ভিন দেশী বন্ধুদের লিখছেন, “আমি ইতালি থেকে বলছি, অর্থাৎ আমি এখন ‘তোমাদের ভবিষ্যতে’। আমরা তোমাদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে আছি, ঠিক যেভাবে উহান আমাদের থেকে কয়েক দিন এগিয়ে ছিল। আমরা তখন যে আচরণ করছিলাম, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরাও একই আচরণ করছো। ‘ ও কিছু না, এটা ঠান্ডা-জ্বরের মতো, সেরে যাবে আপনাতেই’।”
থমাসের বিশ্লেষণ ঠিক এই বিন্দু থেকেই শুরু হচ্ছে। চিনেট উহানে যত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর ইতালি লকডাউনে গেছে। এবং ওই সময় ইতালিতে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, চিনের হুবাইয়ে যত আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি হওয়ার পর ষোলোটি দেশ লকডাউনে গেছে। কারণটা ফ্রান্সেস্কার চিঠিতেই স্পষ্ট। এই ষোলোটির মধ্যে ব্রাজিল আর মালয়েশিয়া ছাড়া বাকি সব ক’টি দেশই ধনী।
করোনা-কাউন্টডাউন – ডে-১: “তা হলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে আমার মায়ের প্রেশারের ওষুধ”
সম্পদ, প্রযুক্তি, চিকিৎসা পরিকাঠামোর দিক থেকে ট্রাম্পের দেশ তো নিঃসন্দেহে নম্বর ওয়ান। তো সেই আমেরিকাও কম গড়িমসি করেনি। তিন মার্চ আমেরিকা প্রথমে ট্রাভেল ব্যান বা পরিবহন বন্ধ করেছে। এর দুদিন পর এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করলেও সোশ্যাল ডিস্টান্সিঙে লাগাম টানা হয়নি। আট মার্চ রেস্তোরাঁ বার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আসলে প্রথম বিশ্বের এই দেশগুলোর সংস্কৃতি আমাদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। সুইডেনের গোথেনবার্গ থেকে আমার ভাইঝি দিয়া জানালো, ওদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা দু লক্ষ ও মৃতের সংখ্যা কুড়ি ছাড়ালেও সুইডিশ সরকার লকডাউন ঘোষণা করেনি। নাগরিকদের দায়িত্ববোধ নিয়ে সরকার পুরোপুরি নিশ্চিত। তাই করোনার ক্ষেত্রে ডোন্টস এন্ড ডু’জ বেঁধে দিয়েছে সরকার। এবং মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলছে। খুব প্রয়োজন না পড়লে কেউ ঘর থেকে বেরোচ্ছে না।
“লকডাউনের জাবড়ামি”: অরিজিৎ আদিত্য
থমাস দেখিয়েছেন, চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ইতালি ইরাকের মতো দেশ সেভাবে গা লাগায়নি। হুবাইয়ে রাতারাতি দুটো করোনা হাসপাতাল গড়ে তোলে চিন।
দেখা গেছে, হুবাইয়ে ২৩ জানুয়ারি অবধি প্রতি দিন সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর দু সপ্তাহ পর দেখা গেছে, রোগীর সংখ্যা কমছে। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে হুবাই মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে।
থমাস দেখাচ্ছেন, এর একটাই কারণ। কঠোর লকডাউন। চিনে কড়া নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় যে, একটি বাড়ি থেকে অতাবশ্যক সামগ্রী আনতে একজন শুধু বেরতে পারবে। এবং আর তিনদিন ওই বাড়ির কেউ বেরবে না।মৃত্যু মিছিল চললেও ইতালি বা ফ্রান্সে এখনও মানুষের চলাফেরায় কড়াকড়ি আনা হয়নি।
কেউ কেউ পরিহাস করে এটাকে গণতন্ত্রের দুর্বলতাও বলে ফেলছেন।
সরকার তিনটি কারণে লকডাউনে অনাগ্রহী। মানুষের ভোটে জয়ী সরকারের ভয়, লকডাউনের কড়াকড়ি মানুষকে অসন্তুষ্ট করবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। আরও একটা কারণও রয়েছে; লকডাউন স্থায়ী সমাধান নয়, সাময়িক ঠেকিয়ে রাখা মাত্র। পরে রোগ আবার ছড়ালে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে।
থেকে সাইরাং/ প্রবাসে দৈবের বশে – লিখছেন অরিজিৎ আদিত্য
সম্ভবত এসব কারণেই ব্রিটেন ‘Herd immunity’ – বা যূথ প্রতিরোধকের ওপর জোর দেয়। ব্রিটিশ সরকার ঠিক করে, ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়ালেও মানুষের শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এন্টিবডি তৈরি হবে। ফলে সরকারও কোনও ব্যবস্থা সেভাবে নেয়নি। একইভাবে গা লাগায়নি আমেরিকাও।
আক্রান্তের সংখ্যা ততদিনে বাড়ছে। এই সময় লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিশেষজ্ঞদের একটি পেপার বেরোয় যেখানে এখনই পদক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে স্পষ্ট লিখে দেওয়া হয়।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে সবাই যে করোনাতেই মারা যাবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় করোনায় মৃতের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু ভয়টা অন্য জায়গায়। আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়বে তত ভেঙে পড়বে চিকিৎসা পরিষেবা। টিম থমাস দেখাচ্ছে, হুবাইয়ে যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে আমেরিকায় সেই হারে ছড়ালে পাঁচ শতাংশকেও আইসিইউ- তে রাখা যাবে না। কারণ এতো আইসিইউ নেই আমেরিকার মতো দেশে। এমনকি এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত মাস্কও নেই। ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও অপ্রতুল। আমেরিকায় প্রতি বছর চার মিলিয়ন রোগীকে আইসিইউ-তে রাখা হয়। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ মারা যায়।
এ অবস্থায় করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়লে অন্য রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যাবে। পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে থমাসের অনুমান, আমেরিকায় মৃত্যুর হার বছরে চল্লিশ শতাংশ বেড়ে যাবে, মৃতের সংখ্যা বছরে দুই মিলিয়ন হবে। আর করোনা মহামারী হলে মৃতের সংখ্যা দশ মিলিয়ন ছাড়াবে।
থেকে সাইরাং/ প্রবাসে দৈবের বশে – লিখছেন অরিজিৎ আদিত্য
সংক্রমণ ছড়ানোর একটি ইউনিট ধরেছেন থমাস। এই ইউনিটের নিক্তিতে একজন করোনা আক্রান্ত থেকে দিনে দু থেকে তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে। হুবাইয়ে প্রথম দিকে একজন আক্রান্ত থেকে গড়ে ৩.৯ জনের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছিল। কোয়ারান্টাইন ও লকডাউন শুরু করার পর এই হার দ্রুত কমতে শুরু করে। এখন তা ০.৩২-তে নেমে এসেছে৷
লকডাউন কত দিন চলবে, মূলত আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এ নিয়েই। ইম্পেরিয়াল কলেজের ওই পেপারে বলা হয়েছে, মার্চ থেকে আগস্ট অবধি সোশ্যাল ডিস্টান্সিং বজায় রাখতে হবে। কিন্তু থমাস পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাচ্ছেন, মাস নয়, কয়েক মাস লকডাউন থাকলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে হ্যাঁ, লকডাউন হতে হবে নিশ্ছিদ্র। কঠোর। হুবাইয়ের মতো। সাউথ কোরিয়ার মতো, যেখানে suppression strategy-র সুবাদে করোনায় মৃত্যুর হা ০.৯ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে।
থমাস পুয়েয়োর সোজা কথা, জীবনের পুরনো ছন্দ ফিরে পেতে হলে কড়া হাতুড়ি মেরে নিশ্ছিদ্র করে রাখতে হবে লকডাউন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ।
মৃত্যুকে ছাপিয়ে জন্মে জয়গান জীবনের: লিখেছেন অরিজিৎ আদিত্য
দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমান্তে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের ঘরমুখো অবুঝ ভিড়। মুম্বাই থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে চাইছে বিহার ইউপি বাংলার আতঙ্কগ্রস্ত শ্রমিকরা। তারা নাছোড়। প্রধানমন্ত্রী মানুষের অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন। কিন্তু আন্তঃরাজ্য সীমান্তে আটকে দেওয়া হবে ওদের। জীবনের ভয় মানুষের বোধবুদ্ধি কেড়ে নেয়, ভয় মানুষকে মারমুখো করে তোলে।
তখন? তখন?
মানুষকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একদিকে হুবাই-উহান অন্যদিকে ইতালি-ফ্রান্স। এই সংকটকালে আমাদেরই নিক্তিতে মাপতে হবে—— হুবাই না ইতালি——কী চাই।
Comments are closed.