Also read in

"বাড়ির ভাড়া দিতে পারছিনা, স্কুলে এডমিশন হচ্ছে না, বই কিনতে পারিনি," মলিন শর্মার মৃত্যুর এক বছর পর অসহায় কন্যা ও স্ত্রী

গতবছর ২৮ জুলাই রাত সোয়া এগারটা নাগাদ হঠাৎ খবর আসে, বিটিএনের বরিষ্ঠ চিত্রসাংবাদিক মলিন শর্মা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। সহকর্মীরা শোনামাত্রই তারাপুর পয়েন্টের দিকে ছুটেন, সেখানে পৌঁছে দেখা যায় তাকে কোনও একটা গাড়ি পিষে মেরে চলে গেছে। ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সেই গাড়িও খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর তার পরিবারের কাছে যারা আশ্বাস দিয়েছিলেন তারাও ধীরে ধীরে প্রায় প্রত্যেকেই দূরে সরে গেছেন। তার ছোট্ট মেয়ে এখন অনেক গম্ভীর স্বরে কথা বলে। খুব ঠান্ডা মাথায় জানায়, তারা ঘর ভাড়া দিয়ে থাকার মতো পরিস্থিতিতে নেই, স্কুলে এডমিশন নিতে পারছে না, পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি থাকলেও বই নেই। প্রাক্তন জেলাশাসক লায়া মাদ্দুরি আশ্বাস দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন হবে, সেটাও হয়নি। কিছুটা আক্ষেপ এবং অভিমানের সুরে এই বলে, “বাবা থাকলে এমনটা অসহায় হতাম না আমরা।”

চিত্রসাংবাদিক মলিন শর্মা শিলচর শহরের প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে একটি প্রিয় নাম ছিল। তার মৃত্যুর পর সাধারণ জনমনে যে তীব্র রোষ দেখা দিয়েছিল, এটাই প্রমাণ করে তিনি কতটুকু জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পর অনেকেই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কিছু আর্থিক সাহায্য পাওয়া গেছিল। সরকারি তরফে যে টাকা পরিবারকে দেওয়া হয়েছে, সেটা মেয়ের নামে ফিক্স ডিপোজিট করা হয়েছে, সে ১৮ বছর হলে পরে সেই টাকা ব্যবহার করার যোগ্য হবে। মলিন শর্মার মৃত্যুর দেড় মাসের মাথায় তার পরিবারের আরেক পুরুষ সদস্যের মৃত্যু হয়। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ব্যক্তিত্ব তার পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সাহায্য করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকা ফুরিয়ে আসতে থাকে। এক সময় পরিবারের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকার মতো সম্বলটুকু ফুরিয়ে যায়।

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পর পরিবারের মনে একটা আশা ছিল, প্রাক্তন জেলাশাসক লায়া মাদ্দুরির আশ্বাস, মিনাক্ষী শর্মা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে। তবে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের নতুন বছর শুরু হওয়ার পর আরেকবার স্বপ্নভঙ্গ হয় পরিবারের। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যেহেতু লায়া মাদ্দুরি বর্তমানে জেলাশাসক হিসেবে নিযুক্ত নন, সেহেতু তার লিখিত আশ্বাস এখন আর কোনো কাজে আসবে না। বর্তমান জেলাশাসক কীর্তি জাল্লি যদি আবার লিখিতভাবে মিনাক্ষী শর্মার নামে সুপারিশ করেন, তবেই তার এডমিশন সম্ভব। প্রায় দুই মাস ধরে জেলাশাসক কার্যালয়ে বিভিন্ন টেবিলে ঘুরছেন প্রয়াত মলিন শর্মার পরিবারের সদস্যরা, এখনও কোন কাজ হয়নি।

মলিন শর্মার স্ত্রীকে চাকরি পাইয়ে দেবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রাক্তন জেলাশাসক। এদিকে, মলিন শর্মার মৃত্যুর দেড় মাসের মাথায় তার নিজের ছোট ভাই মারা যায়। সবমিলিয়ে মানসিকভাবে তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে অনেক দৌড়ঝাপ করেও যখন কোনো সফলতা আসছে না, ধীরে ধীরে নিরাশা তাকে আরও গ্রাস করছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া মিনাক্ষী শর্মা এখন মায়ের চিন্তায় ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।

মলিন শর্মার মৃত্যুর পর শিলচর শহরে বনধ ডেকেছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা। বন্ধের সময় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। একজন আন্দোলনকারীকে কয়েক মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে আটক করেছিল কাছাড় পুলিশ। একই পুলিশের দায়িত্ব ছিল কোন গাড়িটি মলির শর্মাকে পিষে মেরেছিল, সেটা খুঁজে বের করার। সেটা কোনও ট্রাক ছিল বা অন্য গাড়ি, এই প্রশ্নের উত্তরটুকুও পুলিশের কাছে এখন পর্যন্ত নেই। অথচ আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে পুলিশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল।

এছাড়া জেলার প্রশাসন এবং পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই শহরের প্রয়োজনীয় পয়েন্টে সিসিটিভি বসানোর কাজ সম্পন্ন হবে। পাশাপাশি শহরের প্রত্যেক বড় দোকানে সিসিটিভি বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এক বছর পরও এই আশ্বাস অধরা এবং ব্যর্থ। শহরে রাতের বেলা টিপার এর তান্ডব একেবারেই থেমে যায়নি। শহরের কোনও পয়েন্টে নতুন সিসিটিভি বসানো হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর নেই। এরপর হয়ত আরও কোনো এক মলিন শর্মা এভাবেই শিলচর শহরের রাস্তায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর বৈঠক হবে, আশ্বাসের পর আশ্বাস দেওয়া হবে, বছর ঘুরলে দেখা যাবে ‘কেউ কথা রাখেনি’।

Comments are closed.