"৬-নম্বর ধারা বাস্তবায়ন কমিটির রিপোর্ট না আসুর নির্বাচনী ইস্তেহার? কোভিডকালে ভাষা নিয়ে নোংরা রাজনীতি একাংশ স্বার্থলোভীর," অভিমত
মঙ্গলবার গুয়াহাটিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থার প্রতিনিধি এবং তাদের কয়েকজন মিলে অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা বাস্তবায়ন কমিটির প্রস্তাবিত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। বরাক উপত্যকার বাঙালি সমাজসহ বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
আমরা গতকাল অনেকের সঙ্গে এব্যাপারে কথা বলেছি, আজও অনেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মঙ্গলবার প্রস্তাবের শুধুমাত্র একটা অংশ প্রকাশ পেয়েছিল। বুধবার বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে উঠে আসে কমিটির বিভিন্ন প্রস্তাব। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল হাসপাতাল, ঐতিহ্যবাহী শিলচর রেলস্টেশন, সদরঘাট সেতু এবং মহিলা মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিটি।
এছাড়া কাছাড় জেলায় একটি মনিপুরি মিউজিয়াম গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। কমিটিতে বরাক উপত্যকার প্রতিনিধিত্ব না থাকায় আগেই সমালোচনা হয়েছিল। এবার যে রিপোর্ট জনসমক্ষে এসেছে এতে দেখা যাচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপত্যকার বাঙালি সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার মত প্রস্তাব রয়েছে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই রিপোর্ট জনসমক্ষে তুলে ধরার পিছনে আসল উদ্দেশ্য কি? সরকারপক্ষের নেতারা বলছেন এখনই এটা নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নয়, যদি এটা কমিটির রিপোর্টের কপিও হয়, তবে এটা প্রস্তাব মাত্র। এর বাস্তবায়নের বিষয়ে সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করবে। এছাড়া আদৌ এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন এটা আশুর রাজনৈতিক চাল।
দেখা যাক উপত্যাকার বুদ্ধিজীবীরা কি বলছেন:
দিলীপ কুমার পাল, শিলচরের বিধায়ক তথা সমাজ সচেতন ব্যক্তি
প্রস্তাব থাকতেই পারে, কমিটি প্রস্তাব দিলেই যে সরকার সেটা মেনে নেবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এটা অনেক জটিল ব্যাপার; অনেক কথা রয়েছে, অনেক মত অভিমত রয়েছে। কমিটি বানানো হয়েছে, কমিটিকে সম্মান করি, তবে শেষ কথা কমিটি বলবে না। তাই এটা নিয়ে আমি এই মুহূর্তে খুব একটা চিন্তিত নই । আমাদেরও মতামত থাকবে, সময় আসলে দেখা যাবে
ডাঃ রাজিব কর, চিকিৎসক তথা সংগঠক:
উনারা বলছেন নাম পরিবর্তন করে কোনও এক রাজার নামে এটা করবেন, কোনও এক রানীর নামে সেটা করবেন। সবার জন্য সবকিছু হবে; কিন্তু এগারোটা শবদেহকে অশ্রদ্ধা করে কেন হবে ? কেন আসাম সরকার কিংবা এই সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যরা এত অশ্রদ্ধা করেন বাঙালি মানুষকে! আমি খুব উদ্বিগ্ন, বিষয়টা নিয়ে আমি প্রতিবাদ করি। যদি এই প্রস্তাব আদৌ পাস হয় তাহলে আমার এলাকার নির্বাচিত সাংসদ জনপ্রতিনিধিরা হয়তো আগামীতে নির্বাচনে শুধুমাত্র ভোটদাতা হিসেবে থেকে যাবেন, ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। তাই যদি হয়, তারা এখনও পদত্যাগ করছেন না কেন। বরাক উপত্যকার মানুষ এই অঞ্চলে নিজের স্বাধীনতা নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচবে, এই পরিস্থিতি গড়ে তুলতে হলে হয়তো অসম থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। কেউ কেউ বলবেন বরাক আলাদা হলে মুসলমান জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বেশি হবে। আমি বলব, যদি নিজেদের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে হয় তবে এই ধর্মের অন্ধ লড়াই থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাঙালির নিজস্ব রাজত্বে কোন্ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক ক্ষমতায় এলো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। প্রস্তাবিত চুক্তি পাস হলে, আমাদের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা থাকছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরাধীনতার অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে আমরা চলে যাব। অথচ আমরা এখনও শনি-রবি লকডাউন থাকবে কিনা, এসব নিয়েই বেশি চিন্তিত। আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্তে, বরাক উপত্যকার সাধারণ জনগণের সারা জীবনের জন্য বরাক উপত্যকায় লকডাউন হয়ে যাচ্ছে।
অরিজিৎ আদিত্য, যুগশঙ্খ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক, বিশিষ্ট লেখক এবং চিন্তাবিদ
সারা আসাম ছাত্র সংগঠন (আসু) আগেই বলেছিল একটা রাজনৈতিক দল করবে। রাজনৈতিকভাবে সফল হতে গেলে একটা বিশেষ জনমত গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। আমার ধারণা আশু সুযোগ বুঝে এই রিপোর্টের প্রতিলিপি ফাঁস করেছে। আমার কাছে এটা শুধুমাত্র তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো বলেই মনে হয়। এটাকে সামনে রেখেই ওরা নির্বাচনে দাঁড়াবার কসরত শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তারা শাসক দল বিজেপিকে চাপে ফেলতে চাইছে।
এখন আসামে অসমিয়াদের মধ্যে লড়াইটা চলছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রবাদ এবং অসমিয়া প্রভুত্ববাদী আঞ্চলিকতাবাদ নিয়ে। এই লড়াইয়ে বাঙালিরা উলুখাগড়া হয়ে দাঁড়াবে। বাঙালি মুক্ত আসাম গড়ার এটা একটা বড় পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা বলা যেতে পারে।
বিজেপি যেভাবে হিন্দুত্বের সূত্র ধরে বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন টেনে রাজনৈতিকভাবে এই রাজ্যে সফল হয়েছে। ঠিক একইভাবে একাংশ অসমিয়া ভাষা ভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম তোষণ করে বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন আনতে চাইছে। নাহলে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাম এই মুহূর্তে মইনুল হক চৌধুরী হাসপাতাল করার প্রস্তাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা সেটা নিয়ে ভাববার বিষয়। মেডিক্যাল কলেজের উন্নতির ব্যাপারে কোনও কথা নেই, নামকরণ দিয়ে কি হবে। রেল স্টেশনের নাম পাল্টে দিয়ে ডিমাসা একজনের নাম করা, এটা হচ্ছে একমাত্র একটাই এজেণ্ডা চাণক্যের বিভাজনের নীতি।
এর বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিম সবাই যদি একজোট হয়ে না দাঁড়ায় তাহলে দুই পক্ষেরই সর্বনাশ হবে।
বিবেক পোদ্দার, নেলেক
এটাতো একটা প্রস্তাব মাত্র, তাও সরকার পক্ষের নয়, একটি কমিটির। তারা প্রস্তাবটি নিয়ে রাজ্যের প্রায় প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাদের অভিমত গ্রহণ করেছেন এবং এর উপরে একটি বয়ান তৈরি করেছেন। খিলঞ্জিয়া মানে শুধু অসমিয়া নয়, এটা আমাদের স্পষ্ট করে ওরা বলেছে। কমিটির বরাক সফরকালে নেলেকের সঙ্গে বৈঠকে এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।তারা সেইসময়েই জানিয়েছিলেন বাঙালি, অসমিয়া, ডিমাসা সবাইকেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কমিটি সরকারিভাবে রিপোর্ট পেশ করার পর এবিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই কোভিড আবহে আমাদের এমন কিছু নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত নয়, যা ১০০ শতাংশ সুনিশ্চিত নয়।
নামকরণের ব্যাপারে দশজন হয়ত দশ রকমের প্রস্তাব দিয়েছে, এখন কমিটি কোন্ প্রস্তাবে সায় দিয়েছে আমরা জানি না। জনগণের কাছে আমি আবেদন রাখছি, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো তথ্য আমাদের হাতে না আসবে ততক্ষন পর্যন্ত এটা নিয়ে যাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়। কেন্দ্র সরকার বাংলাদেশ থেকে আসা জনগনকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে স্পষ্ট নিশ্চয়তা দিচ্ছে।
Comments are closed.