'পরের দিন সকালে আমার বাবার অবস্থাটা খারাপ হয়ে গেল, জ্বর বাড়লো, অক্সিজেনের মাত্রা ও কমে গেল' শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-যুদ্ধের কাহিনী জানালেন বৈশালী চক্রবর্তী।
কোভিড পজিটিভ! শব্দ দুটো কানে যেতেই এক মুহূর্তের জন্য পৃথিবীটা থেমে গেল! মনে হলো যেন পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে গেল! প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো এই শব্দদ্বয় মনের মধ্যে, মগজের মধ্যে। তারপর? এখন? হাসপাতাল, করোনা চিকিৎসা, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন শব্দগুলো অস্থির করে তুলল ভেতরে ভেতরে। বুঝলাম অস্থির হলে চলবে না। নিজেকে শক্ত করে ঝড়ের মোকাবিলা করতে হবে।
ঝড় শব্দটা এখানে উল্লেখের কারণ, রোগের নাম করোনা। ঝড়ের চেয়ে কম বৈকি! অসুখের মোকাবিলা! সঙ্গে জন, পরিজন আশেপাশের মানুষের সঙ্গেও যেন এক মোকাবিলা। কিন্তু বুঝলাম, আতঙ্কিত হলে চলবে না।
তারিখটা ছিলো ২০ আগস্ট। আমরা অর্থাৎ আমি, আমার বাবা, আমার কাকা কোভিড পজিটিভ হিসেবে ঘোষিত হলাম। টেস্টে একমাত্র আমার মায়ের কোভিড নেগেটিভ এল, যদিও আমরা একই বাড়িতে ছিলাম। আমার বাবার যদিও বা অল্প জ্বর এবং কাশি ছিল, কিন্তু আমার কোনো উপসর্গ ছিল না। তাই প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছিল, বাবা এবং আমার কাকার স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে থেকে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, তাদের কিছুটা উপসর্গ ছিল। আর দ্বিতীয়তঃ বয়সের দিকটা চিন্তা করেও তাদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করানোটা বিপদ মুক্ত নয় বলে মনে হল। আবার মাকে ঘরে একা রেখে সবার চলে যাওয়াটাকে ঘিরে মনের মধ্যে খুব খটকা লাগছিল। তাই আমি আমার মায়ের সঙ্গে ঘরেই থাকবো বলে ভাবলাম। কিন্তু কথাটা ভাবনা হিসেবেই রয়ে গেল। বাস্তবে পরিণত হওয়ার সুযোগ পেল না। কারণ আমি একটা চা বাগানের কোয়ার্টারে থাকি এবং বাগান কর্তৃপক্ষ ঘরে কোয়ারেন্টাইন থাকার অনুমতি দিলেন না। কাজেই আমাদের যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হলো। ব্যাগগুলো গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এবার।
ইতিমধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। আমাদের এখানের কালাইন সার্কোলে রাতাছড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাদের স্থানান্তরিত করা হবে বলে প্রথমে বলা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হলো। কিন্তু আমাদের আত্মীয় পরিজন ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার তুতো ভাইয়ের ফোন এলো। আমার বাবা আর কাকার বয়সের কথা চিন্তা করে আমাদের অবশ্যই শিলচর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যাওয়া উচিত বলে সে জানালো। শিলচর মেডিক্যাল কলেজ? মুহূর্তে মাথায় অনেক চিন্তা খেলে গেল। কিন্তু তখন বেশি চিন্তা করারও সময় ছিল না। তবে ততক্ষনে আমরা সেই অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দিলাম। শুরু হলো আরো একবার অপেক্ষার পালা। এবার মেডিক্যাল কলেজে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা!
কিন্তু শিলচর মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে মনের মধ্যে অনেক সংশয়। মেডিক্যাল কলেজের কথা মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো নোংরা ঘর, অস্বাস্থ্যকর এবং নোংরা বাথরুম, বেস্বাদ খাবার, রোগীদের প্রতি ডাক্তার-নার্সদের অবহেলা! আসলে এ ধরনের কথা মনে আসার অনেক কারণ ছিল। কারণ শিলচর মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে বরাবরই আমরা এ ধরনের কথা পড়েছি। আর আমাকে কিনা সেখানেই থাকতে হবে? আমার কাছে এর থেকে বড় দুঃস্বপ্ন আর কি হতে পারে! নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম? আগের অ্যাম্বুলেন্স থেকে ছেড়ে দিয়ে আমরা কি ভুল করলাম?
ঠিক পরমুহুর্তেই আমার মনের ভেতরের মন বলে উঠলো, এই মুহুর্তের এক চুল ভুলও অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমাদের যে রোগটি ধরা পড়েছে সেই রোগে তছনছ হয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। এই ছোট্ট একটা ভাইরাস এখন পর্যন্ত ভারতে ছয়ষট্টি হাজারেরও বেশি লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। কাজেই এই ভাইরাস কিংবা আমাদের রোগটাতো যে সেই নয়! কিন্তু আশ্চর্য, এই মুহূর্তে আমি মোটেই চিকিৎসা সম্পর্কে ভাবছিলাম না। আমার ভেতরে তখন অন্য এক ভয় কাজ করছে। মনের মধ্যে প্রচন্ড এক অস্বস্তি। যতবার ভাবছিলাম শিলচর মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে থাকতে হবে ততবারই ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম।
এরই মধ্যে আমার ভাই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করল। অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছালো। এবার বেরুতে হবে। পিছন ফিরে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। গালে চুমু খেয়ে বলি, মা এবার আসি। কিন্তু কেউ যেন আমার পায়ে বাঁধন পরিয়ে দিয়েছে। ছুটতে গিয়েও ছুটতে পারছিনা। বাঁধনটার নাম করোনা। চোখে জল এলেও নিজেকে সামলে নিলাম। পিছে মা না ভেঙ্গে পড়ে।
অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে। মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন। কিন্তু হঠাৎ দেখি আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ভুল করে বড়খলার কোনও একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে। আসলে ড্রাইভার জানত না যে আমাদের শিলচর মেডিক্যাল কলেজে যেতে হবে। আমার মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। খুশি হয়ে গেলাম, কারণ আমরা যেখানে পৌঁছেছি সেটা শিলচর মেডিক্যাল কলেজ নয়। কিন্তু খবরটা পৌঁছে গেল আমার ভাইয়ের কাছে। সে আরও কয়েকটা ফোন করলো এবং অ্যাম্বুলেন্সটি ইউ টার্ন নিল। আমার খুশিতে কে যেন জল ঢেলে দিল। শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছালো শিলচর মেডিক্যাল কলেজে।
মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে যেখানে আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হলো, সেখানে আমার বাবা এবং আমার কাকার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ বসার মত জায়গা ছিল না। আমাদের আগে এসেছেন এমন অনেক লোক সেখানে তখনও অপেক্ষা করছিলেন। মনে মনে ভাবছিলাম এ কোন জায়গায় এসে উঠলাম। আর তখনই আবিষ্কার করলাম আমাদের সামনেই রয়েছে দুটি মৃত দেহ।প্যাক করা, বলা ভালো সিল করে দেওয়া হয়েছে। ভয়ে আঁতকে উঠলাম, সিঁটিয়ে গেলাম মনের মধ্যে। মনের ভেতরে জোর আনার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। ওই অবস্থায় আমরা আরও এক ঘন্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। কোমরটা টনটন করছিল। যখন বসার জায়গা পেলাম মনে হলো প্রাণটা জুড়ালো। আরো একঘন্টা গেল রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে সহ আনুষঙ্গিক পর্ব সারতে। শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের বিছানা পেলাম। তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল, তাই তিন জনের পরিবর্তে খাবারের একটা প্যাকেট দেওয়া হল। এর কিছুক্ষণ পর অন্য এক মহিলা এসে আমাদেরকে ফলের রস এবং লস্যি দিয়ে যান। সারাদিনের ধকল সামলে আমরা দিনের শেষে তখন পুরোপুরি ক্লান্ত। আমার ২২ বছরের জীবনের একটা ঘন্টাও যেখানে কাটাইনি, সেই শিলচর মেডিক্যাল কলেজের বিছানায় শুয়ে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না, মুহূর্তে চোখে ঘুম এসে গেল।
পরের দিন সকালে আমার বাবার অবস্থাটা খারাপ হয়ে গেল, জ্বর বাড়লো, অক্সিজেনের লেভেল কমে গেল। আমাদের যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল সেটা মূল হাসপাতাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এজন্যই একে আইসোলেশন ওয়ার্ড বলে। আর এজন্যই ডাক্তার আর নার্সদের খুঁজতে আমাকে বড্ড বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। আর তাছাড়া প্রথম দুটো দিন আমার জন্য খুবই মুশকিলের ছিল। কারণ প্রথম প্রথম আমি বুঝতেই পারছিলাম না, কে ডাক্তার আর কে নার্স! পিপিই কিটের আড়ালে ডাক্তার নার্স সবাই যেন এক!
আমার বাবাকে রেমডেসিভির এবং প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। তবে এন্টিভাইরাল সহ কোনকিছু আমাদের কিনতে হয়নি। মেডিক্যাল কলেজ থেকে সবকিছু দেওয়া হয়। আমাদের ওয়ার্ডের সবার ক্ষেত্রেই একই ব্যবস্থা ছিল।
রেমডেসিভির ও প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার পর আমার বাবার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়। অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। বমির ভাব কমে যায়, জ্বরও কমতে শুরু করে।
আমি এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যত সবকিছু পড়েছি সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি। মেডিক্যাল কলেজে অসহায় অবস্থায় অনেক রোগীদের মারা যাওয়ার দুঃখজনক কাহিনী যখন পড়েছি তখন একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আমার চোখের সামনে দেখেছি এই ডাক্তার এবং নার্সদের। যারা রোগীদের ভালো করে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। একজন নার্স আমার বাবার হাতে সুঁচ ফোটাতে সঠিক জায়গা বের করার চেষ্টা করছিলেন। আমি দেখলাম তার গাল, গলা বেয়ে ঝর ঝর করে ঘাম পড়ছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না পিপিই কিট পরে ওদের কতটা অসুবিধে হচ্ছে। অথচ এই অবস্থায় হাসিমুখে রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন।
আরো একটা কথা খুব মনে পড়ছে। একজন চিকিৎসক যখন আমাদের ওয়ার্ডে এসে ঢুকলেন এবং জানালেন আমরা একজন প্লাজমা ডোনার পেয়েছি। তখন কথা গুলো আমার কানে সংগীতের সুরের মত বাঁধছিল। ওই ডাক্তারকে বড় আপন মনে হয়েছিল। মনে মনে ওই প্লাজমা ডোনারকে ধন্যবাদ জানালাম। সঙ্গে সঙ্গেই মনের ভেতরের মন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, সুস্থ হয়ে আমিও কারোর সুস্থতার কারণ হব, খুশির কারণ হব।
প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার পর আমার বাবার অনেক পরিবর্তন হলো। বুঝলাম সুস্থ হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু হঠাৎ করে আমি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমার বাবা ডাক্তারদের ডেকে আনলেন। যারা আমাকে প্রায়শই একজন অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে খ্যাপাতো (কারণ আমার মধ্যে এই রোগের কোন উপসর্গ ছিল না), তারাই আমার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। এখানে আরো একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, হ্যাঁ শিলচর মেডিক্যাল কলেজের কোভিড ওয়ার্ডের ভেতরে অ্যাটেনডেন্টদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। উপস্থিত ডাক্তাররা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন ফোনের মাধ্যমে। আমার ইসিজি করা হলো। বলল যে অতিরিক্ত টেনশনের থেকে এমনটা হয়েছে। ওই মুহুর্তে করোনা রোগের ভয়ংকর রূপটা যেন আমার সামনে ফুটে উঠল।পর মুহূর্তে কি হবে সেই ভরসা যেন হারিয়ে ফেললাম।ভয়ে কুঁকড়ে উঠলাম। ঠিক তখনই মাথায় কারো হাতের স্নেহ মাখা স্পর্শ।ডাক্তারের কন্ঠ কানে এল, “ভয় পেয়ো না। আমরা তো আছি।” ছোট্ট দুটো বাক্য। কিন্তু এর অদ্ভুত ক্ষমতা।” আমরা তো আছি” কথাটার মূল্য অনেক।বুঝলাম। বাক্য দুটোই আমার মনকে শান্ত করল। পায়ের নিচের ভরসার মাটিটা আবার ফিরে পেলাম। ডাক্তাররা যে ভগবানের অন্য রূপ, অসহায় মুহূর্তে আমরা সেটা বুঝতে পারি।সেই ডাক্তার-নার্সরা সেদিন রাতে এবং তার পরের দিন সকালেও আমার স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখতে বারবার আমার ওয়ার্ড পরিদর্শন করেছেন।
শিলচর মেডিক্যাল কলেজে জরুরি অবস্থায় ডাক্তাররা রোগীদের স্পর্শ করেন না বলে অনেকবার আমরা অনেক জায়গায় গত কয়েক মাসে পড়েছি। তাই হতে পারে আমি ভাগ্যবান কিংবা সেই ঘটনাগুলো ছিল একতরফা কিংবা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু যেভাবে এই ঘটনাগুলোকে বারবার লেখা হয়েছে, তাই আমার মনে হয় আমার দেখা এই ঘটনাগুলোও তুলে ধরা উচিত।
এখানে কিন্তু আমাকে আরো একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হবে সেটা হচ্ছে, শিলচর মেডিক্যাল কলেজের খাবার। এক্ষেত্র আমার ধারণা ফুল প্রতিপন্ন হয়। আমি, আমার বাবা এবং আমার কাকা যেমন শিলচর মেডিক্যাল কলেজে ছিলাম, অন্যদিকে আমার মামা কোভিড পজিটিভ হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমরা চারজনে একই ধরনের চিকিৎসা পেয়েছি। কিন্তু আমার মামার বিল এসেছে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। উল্টোদিকে আমাদের খরচের তালিকায় রয়েছে একটি গরম জল করার কেটলির দাম। যা বাবাকে গরম জল খাওয়ানোর জন্য আমি একজন রোগীর অ্যাটেনডেন্টকে দিয়ে আনিয়েছিলাম। এখানে আরো একটা ব্যাপার না বললেই নয়, আমাদের ওয়ার্ডের রোগীরা কিন্তু একে অন্যের মানসিক বল দিতে সমর্থ হয়েছি। আবার অন্য রোগীদের অ্যাটেনডেন্টরাও খুব সাহায্য করেছেন। তবে হ্যা, যা বলছিলাম খাবারের কথা। অনেক কথা শুনলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারি শিলচর মেডিক্যাল কলেজের খাবারগুলো একদিকে যেমন ছিল পুষ্টিকর, তেমনি ছিল সুস্বাদু। অন্যদিকে আমার মামাকে পরিবেশন করা খাবার গুলোর ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল। তুলনা করারও সুযোগ হয়েছিল। আমরা পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ গঠন করেছিলাম। সেই গ্রুপে কোনো সময় ছবি বিনিময়, কোনো সময় ভিডিও কল করে সবাই খবরাখবর নিতেন। মানসিকভাবে আমাকে সাহস যোগাতেন। বলতে পারি, সময়টা খুব ভালো কাটত।
শিলচর মেডিক্যাল কলেজে কাটানো এই কটা দিনের দৌলতে আমার অনেক বড় শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখন যখন দিনগুলোর কথা মনে করি তখন মনে হয় শিলচর মেডিক্যাল কলেজকে আরো পরিচ্ছন্ন এবং পরিষ্কার রাখার দায়দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরও। আমাদের সামান্য প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারে। হাসপাতালে যেতে কেউই পছন্দ করেন না। রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই যেতে হয়। তবে আমি শিলচর মেডিক্যাল কলেজে যেতে আর ভয় করিনা এবং এটিকে নরক বলেও মনে করিনা। তাই স্বইচ্ছায় প্লাজমা দান করতে অবশ্যই আবার হাসপাতালে যাব এবং কাউকে কোভিড মুক্ত করে সুস্থ হয়ে উঠতে অবশ্যই সাহায্য করব।
২৯ আগস্ট আমাদের ছেড়ে দেওয়া হল হাসপাতাল থেকে। মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে আমাদের গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হল। বাড়ি পৌঁছে মনে হল এক যুদ্ধ জয় করে মায়ের কাছে ফিরে এলাম। আমার আর আমার বাবা, কাকার সেই যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার যেমন ছিল ওষুধ, প্লাজমা থেরাপি,রেমডেসিভির, তেমনি সহায়কের ভূমিকায় ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার নার্স সহ অন্যান্য কর্মীরা।
আজ যখন বাড়িতে বসে আমার অভিজ্ঞতাগুলো সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিচ্ছি, তখন এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের দিনগুলো যা আগে ভেবেছিলাম এক দুঃস্বপ্নময় অধ্যায় হবে, সেটি জীবনরক্ষাকারী অধ্যায় হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
(এই নিবন্ধের লেখিকা বৈশালী চক্রবর্তী করিমগঞ্জ কলেজের ছাত্রী এবং কাছাড় জেলার বাসিন্দা; লেখাটিতে তার ব্যক্তিগত মতামত প্রতিফলিত হয়েছে।)
Comments are closed.