
দুর্গাপূজায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা: সাংস্কৃতিক কর্মীরা আতঙ্কিত, শিল্প এবং শিল্পীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে
বাঙালির কাছে দূর্গা পুজো মানে এক আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন। বছরের চারটে দিন উৎসবের আনন্দে মেতে উঠে পুরো শহর। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই উপভোগ করতে চায় আলোর রশ্মিতে ঝলমল করা প্যান্ডেল। সারা বছর মার হাতের সুস্বাদু রান্না খেলেও এই কটাদিন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশ ভালো মন্দ খাওয়া চলে। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে রাতভর আড্ডাতেও মশগুল হতে দেখা যায় কমবয়সী যুবক যুবতীদের।
যেকোনও উৎসব শুধু উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আয়োজন, প্রস্তুতি এবং অনেকের জীবিকা। কিন্তু ২০২০ বছরটা আরো পাঁচটা সাধারণ বছরের মতো নয়। মহামারি করোনার ফলে গভীর প্রভাব পড়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশ্বের প্রতিটি দেশে। ব্যতিক্রম হয়নি পুজোর ক্ষেত্রেও। নিয়মমাফিক এস.ও.পি তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার মধ্যে বা আসে পাশে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করে পুজোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জনে পাঁচের উপর ব্যক্তির আগমন নিষিদ্ধ হয়েছে।
একজন দাপুটে নেতা কটাক্ষ করে বলেছেন পুজোকে ঘিরে “রং তামাশা” করলে করোনা মহামারী বিপদজনক মোড় নিতে পারে। আগামী ২ অক্টোবর পুজো নিয়ে দ্বিতীয় এস.ও.পি প্রকাশ করার কথা রয়েছে। পুজোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঢাকঢোল এবং মিউজিক ও সাউন্ড সিস্টেমের সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন লোকেদের জীবিকা। তাই এগুলোকে “রং তামাশা ” বলে সম্ভোধন করলে এই বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত লোকেদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে।
বিশিষ্ট জনের এ নিয়ে কি মতামত? পুজোতে এসব কিছু নিষিদ্ধ হলে তাদের ঠিক কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে? এব্যাপারে জানতে বরাক বুলেটিন যোগাযোগ করে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের সাথে। দেখে নেওয়া যাক তাদের মতামত।
বিক্রমজিৎ বাউলিয়া, গায়ক
যারা ব্যান্ডে কাজ করে টাকা রোজগার করে তাদের কাছে দুর্গা পুজো একটা অনেক বড় উপলক্ষ। এটা প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। যদিও গতবছর সি.এ.এ বিরোধী আন্দোলনের জন্যে ক্লাবগুলোকে অনুষ্ঠান আয়োজন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারপর করোনা মহামারির আবির্ভাব এবং এখন আমাদের অনুষ্ঠান করতে দেওয়া না হলে এই শিল্প বাঁচবে কি করে? শুধু গায়কই নয়, বরং বাদ্যযন্ত্র শিল্পী, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, লাইট ডেকোরেটর আমরা সবাই আয় হীন রয়েছি বছরের শুরু থেকে। সরকার বা এই উপত্যকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তারা সবাই উদাসীন এব্যাপারে। গুয়াহাটিতে শিল্পীদের কিছু সাহায্য প্রদান করা হলেও শিলচরে আমাদের না খেয়ে ঘুমোতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রটোকল মেনে স্টেজ শো করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে তাই আমাদেরও দেওয়া হোক। একটা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে দেড়শো জন জমায়েত হতে পারে, একটা রাজনৈতিক সভায় দেড়শো জন আসতে পারে কিন্তু প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় শুধু পাঁচজন জড়ো হতে পারবে এবং সেটাও সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া। বোধহয় করোনা ভাইরাস স্থান বিশেষে ভিন্নভাবে সংক্রমণ ঘটায়, এটা সত্যিই হাস্যজনক।
দীপজয় রায়, সচিব, লাইট এন্ড অউনার্স এসোসিয়েশন
গতবারও পুজো নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব হয়েছিল। আমাদের তখন রাস্তার মধ্যে লাইটিং গেইট বানানোয় নিষেধাজ্ঞা ও সাউন্ডের ক্ষেত্রে একটা নিৰ্দিষ্ট ডিসিবেল বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এটা নিয়ে আমরা ডিসি এবং সহকারি কমিশনারের কাছে গেছিলাম। আমাদের তারপর অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। এই বছর যেহেতু মহামারি তাই অনেক পুজো কমিটিগুলোই এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না যে তারা আদৌ পুজো করবে কি না। তাই আমরা কি করবো সেটাই বুঝতে পারছিনা। আমরাও এসোসিয়েশনের তরফে লকডাউনের সময় গরিব দুঃস্থদের রিলিফ প্রদান করেছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে যে করোনার ফলে আমাদের পেশারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিগত সাত মাস ধরে আমাদের সবকিছু বন্ধ। অনেক মালিক এবং কর্মী এই পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কি তা কেউ কিছু বলতে পারছেনা এই মুহূর্তে। আমরা দেখছি পুজোর সময় কড়াভাবে প্রটোকল মেনে কাজ হবে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনেও কি এত প্রটোকল মেনেই সাউন্ড বাজাবে তারা এটাই দেখার। পুজোতে হলে নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত সরকার বলছে “আত্ম নির্ভর ভারত”, আমরাও এই আত্ম নির্ভরদের মধ্যেই পড়ি, কিন্তু আমরাই সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এখন মহামারি বলে সবাই মেনে নিচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এই শিল্পই না থাকে তাহলে সেটাকে আর কোনোদিনও পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়।
অনিন্দিতা চক্রবর্তী, গায়িকা
হ্যাঁ আমাদের অনেক অসুবিধে হচ্ছে এই পুজোর মরশুমে, যেহেতু অনেক অনুষ্ঠান থাকে এই সময়টায়। বিগত কমাস ধরেই সবরকমের অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে কোভিডের জন্যে। সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে ফেলা হয়েছে এখন, লকডাউনও তুলে ফেলা হয়েছে, মানুষ চলাফেরা করছে। তাই প্রটোকল বেঁধে অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করা উচিত। আমাদের আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাই আমরা চাই সবকিছু শুরু হোক আবার নিয়ম মেনে।
Comments are closed.