Also read in

"কোভিড প্রটোকল মানবো, তবে পুজো আমরা করবই," প্রশাসনের বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা সাধারণ মানুষের

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুজো-বিষয়ক যে নির্দেশনামা জারি করা হয়েছে তাতে অসন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ। শুক্রবার বিকেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্দেশনামার কপি প্রথমবার বেরোয়। এরপর প্রবল জনরোষ দেখা দেওয়ায় কাছাড় জেলা প্রশাসন শহরের পুজো কমিটিদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। বলা হয়, পূজা কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে এই প্রস্তাবগুলো উঠে আসে, এর ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তে যেসব বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে তার অনেকটাই কোভিড প্রটোকলের অংশ নয়। সাধারণ মানুষ আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তারা প্রটোকল মেনে পুজো করবেন তাই এই উদ্ভট নিয়মাবলীর প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা মনে করেন না। অনেকেই বলেছেন, “প্রটোকল মানবো, তবে পুজো হবেই।”

যে বৈঠকের দোহাই দিয়ে এসওপি গঠন করা হয়েছে, সেই বৈঠকে পুজো কমিটিদের ডাকাই হয়নি, এমনটা অভিযোগ উঠছে। এছাড়া বৈঠকে আমন্ত্রণ পাননি সাংসদ-বিধায়করাও। সাধারণ মানুষের কথা তো বাদ দিলেই চলে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না স্বয়ং জেলাশাসক কীর্তি জল্লি। অথচ বৈঠকের দোহাই দিয়ে তিনি নির্দেশনামায় স্বাক্ষর করেছেন। কেন জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পুজো কমিটির প্রত্যেককে বাদ দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন জেলাশাসক? এর উত্তরে একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেছেন, এবছর বিহু এবং ঈদ উদযাপন হয়নি তাহলে দুর্গাপুজো কেন হবে?

এবছরের পুজো নিয়ে জেলাশাসকের নির্দেশনামা প্রকাশ্যে আসার পর জেলার প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তি এর বিরোধিতা করছেন। এমনকি সাংসদ এবং বিধায়করাও এর পক্ষে নন। শনিবার বিজেপির জেলা কমিটির সদস্য সহ হিন্দু সংহতি, বজরং দল ইত্যাদি নানান সংগঠন স্মারকপত্রের মাধ্যমে জেলা শাসকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন অতিসত্বর যাতে এই সিদ্ধান্ত বদল করা হয়। এদিকে করিমগঞ্জের জেলা বিজেপির পক্ষ থেকে জেলাশাসক আনবামুথান এমপির কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, কাছাড়ের নির্দেশাবলীর অনুরূপ নির্দেশ করিমগঞ্জ জেলায় জারি করা চলবে না। আনবামুথান এমপি এতে রাজি হয়েছেন এবং বলেছেন জনগণের কথা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

শিলচরের বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল জানিয়েছেন, তাকে এই বৈঠকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ করা হয়নি। তিনি বলেন, “শিলচর শহরে জেলার সব থেকে বেশি পুজো হয়। এই শহরের জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার বৈঠকে উপস্থিত থাকার অধিকার ছিল। এটাই অন্যান্য বছরের রীতি। এবছর জেলা প্রশাসন কেন আমাদের না ডেকে বৈঠক করলো এবং এরকম সিদ্ধান্ত নিল এটা বুঝতে পারছিনা। আমি আগামীতে প্রশাসনের আধিকারিকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করব। সাধারণ মানুষের পক্ষেই থাকবো আমি।”

সোনাই রোডের তরুণ ক্লাব, মেহেরপুরের অ্যাপোলো ক্লাব, শিলচরের পাবলিক স্কুল রোড পূজা কমিটি, শিলংপট্টির শ্যামাপ্রসাদ রোড পুজো কমিটি, তারাপুরের কালীমোহন রোড পূজা কমিটি, আনন্দ পরিষদ পুজো কমিটি সহ প্রায় সবকটি বড় মাপের পুজো আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এক কথায় বলেন, জেলাশাসক বৈঠকে তাদের ডাকেননি। রামকৃষ্ণ মিশন সহ কয়েকটি মন্দির এবং হাতে গোনা দু’একটি পূজা কমিটির সদস্য হয়তো এতে অংশ নিয়েছিলেন। তবে কেউ পাঁচফুট উঁচু মূর্তি, বা ১০জনের বেশি অঞ্জলি প্রদানে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।

শিলচর রামকৃষ্ণমিশনের গণধীশানন্দ মহারাজের সঙ্গে এব্যাপারে কথা বললে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈঠক ডাকা হয়েছিল যেখানে শুধুমাত্র মতামত নেওয়া হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্বাস করে, সেনিটাইজেশন এবং সামাজিক দূরত্বের প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রেখে অন্যান্য বছরের মতো পূজা আয়োজন সম্ভব। রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে সারা পৃথিবীতে এভাবেই পূজা আয়োজন হচ্ছে। আমরা অঞ্জলি প্রদানের ক্ষেত্রে অনলাইনে এক ঘন্টার লাইভ অনুষ্ঠান করছি। ভক্তরা বাড়িতে বসেই মা দুর্গার প্রতিকৃতির সামনে অঞ্জলি প্রদান করবেন। যাতে একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষ জড়ো না হন, তার জন্যই এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুরক্ষা মেনে মায়ের আগমনকে আনন্দ-উৎসব করে তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।’

মেহেরপুরের অ্যাপোলো ক্লাবের পক্ষ থেকে জয়দীপ চক্রবর্তী বলেছেন, “আমাদের না জানিয়ে নির্দেশ জারি করা হয়েছে, এই নির্দেশ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা আগেই পূজার প্রতিমা নির্মাণ শুরু করে দিয়েছি ফলে এখন কেটে ছোট করা যাবে না। কোভিড প্রটোকল মেনে পুজো হবে, আমরা মাইক বাজাবো, মায়ের আগমনকে আনন্দ উৎসব হিসেবে পালন করব। জেলা প্রশাসনের অন্যায় চোখরাঙানি মেনে নিচ্ছিনা।”

কালীমোহনরোড দূর্গা পূজা কমিটির তরফে চিকিৎসক রাজিব কর জানিয়েছেন, তারা বিশেষ বৈঠক আয়োজন করে পুজোর পরিকল্পনা করছেন। করোনা সংক্রমণ আটকাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো নেওয়া হবে কিন্তু দুর্গাপুজোর জৌলুস কিছুতেই কমবে না।

পাবলিক স্কুল রোডের পূজা কমিটির পক্ষ থেকে বিধান রায় বলেছেন, “শহরের কোন ঐতিহ্যবাহী পুজো কমিটিকে না ডেকে একটি বৈঠক করলেন জেলাশাসক, এতে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এবং জনসমক্ষে তুলে ধরলেন। এটা আমাদের অঞ্চলের রীতি নয়। যদি আমাদের ডেকে পরামর্শ নেওয়া হতো আমরা বলতাম এই নিয়মগুলো কোনভাবেই স্বাভাবিক নয়। আমরা পুজোর আয়োজন করে নিয়েছি, ছয়মাস দূঃসময় কাটিয়ে সাধারন মানুষ মায়ের আগমনে একটু ভালো মুহূর্ত কাটাবেন। এতে যদি প্রশাসনের অসুবিধা হয় আমরা তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করতে রাজি আছি। তবে পুজো বাতিল করব না।”

শিলংপট্টির শ্যামাপ্রসাদ রোড পুজো কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেহেতু জেলা প্রশাসন তাদের মতামত ছাড়াই নির্দেশ জারি করেছেন, এই নির্দেশ বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। যেটুকু সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, এর ভিত্তিতে বলা যায় নির্দেশগুলো অত্যন্ত উদ্ভট। তাই সরাসরি সবগুলো নির্দেশ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যেভাবে পুজো হচ্ছে, সেভাবেই হবে। অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব, সেনিটাইজেশন ইত্যাদি প্রটোকল মেনে উৎসব পালন হবে। এই পুজোতে বাঙালি সম্প্রদায় সহ হিন্দিভাষীরাও সমান ভাবে জড়িত। মায়ের পুজো প্রত্যেকের কাছে সমান প্রিয় তাই এটি কোনোভাবেই বাতিল হচ্ছেনা।

এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এই নির্দেশের বিরোধিতা করে জেলা শাসকের কাছে সরাসরি স্মারকপত্র প্রদান করেছে। হিন্দু সংগতির পক্ষ থেকে ইমেইল ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়েছে। হিন্দু সংগতির পক্ষ থেকে মিঠুন নাথ জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে শতাধিক ইমেইল পাঠানো হয়েছে। প্রত্যেকে অনুরোধ করছেন এই নির্দেশ বিবেচনা করে পরিবর্তন করতে। সুরক্ষা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত রেখে সাধারণ মানুষের আনন্দ এবং ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের রোজগারের সম্ভাবনাগুলো যাতে কেড়ে নেওয়া না হয় এই দাবি রাখা হয়েছে।

বজরং দলের পক্ষ থেকেও জেলা শাসকের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে যাতে এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করা হয়। জেলার মৃৎশিল্পীরা এদিন দুপুরে জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে ধর্না প্রদর্শন করেছেন। তাদের বয়ান, ‘আশি শতাংশ মূর্তি বানানোর কাজ শেষ হয়ে গেছে, এই সময়ে নতুন করে নির্দেশ জারির কোনো যৌক্তিকতা নেই। যদি পাঁচ ফুটের মূর্তি করতে হয় তাহলে অনেক মূর্তি ভেঙ্গে নতুন করে বানাতে হবে যা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।’

এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই বলছেন, ‘কোভিড প্রটোকল মেনে পুজো আমরা করবোই, যদি এতে জেলা প্রশাসন আমাদের ওপর চড়াও হয় সেটাও দেখে নেব। প্রয়োজনে শাস্তি পেতে রাজি আছি, কিন্তু মায়ের পুজোর জৌলুস কমবে না। পুজোয় মাইক বাজালে বা আলোকসজ্জা সাজালে করোনা সংক্রমণ হয়, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এছাড়া শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী পুজোর বেশ কিছু রীতি রয়েছে যা এই নির্দেশে পালন করা যাবে না। এটা সরাসরি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। যেখানে রাজ্য সরকার বলছেন তারা নির্দেশ দেননি তাহলে কেন জেলাশাসক এই স্বৈরাচারী মনোভাব দেখাচ্ছেন? তাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পাশাপাশি এলাকার জনপ্রতিনিধিদেরও এ ব্যাপারে উত্তর দিতে হবে। তাদের না জানিয়ে একজন জেলাশাসক এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অথচ তারা জোর গলায় এর বিরোধিতা করছেন না, এর পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা কোথায়?’

Comments are closed.