মেঘালয়ে বাঙালি বিদ্বেষের আরেকটি নিদর্শন, এবার শিলং রামকৃষ্ণ মিশনে তালা ঝুলিয়ে দিল খাসি ছাত্র সংগঠন
গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে মেঘালয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নানান পদক্ষেপ নিয়েছে স্থানীয় সংগঠনগুলো। গত মাসে খাসি ছাত্র সংগঠন মেঘালয়ে বসবাসকারী প্রত্যেক বাঙালিকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে পোস্টার লাগিয়ে ছিল। এবার তারাই শিলং রামকৃষ্ণ মিশনে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে একই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এই প্রতিরোধ বেশি সময় টিকেনি, রামকৃষ্ণ মিশনের মত সংগঠন অন্যায়ভাবে কোন কাজ করে না, তাই তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় প্রতিবাদ টেকেনা।
আমেরিকার থ্যাংকস গিভিং উৎসবের আদলে মেঘালয়ের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটি উৎসব রয়েছে যার নাম সাদ পমলাঙ। এটি মূলত ফসল কাটার উৎসব, যা গ্রামেগঞ্জে হয়ে থাকে। তবে খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন সম্প্রতি এই উৎসবকে সামনে রেখে শিলংয়ের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, স্কুল, ইত্যাদিতে তালা লাগিয়ে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শিলংয়ের রামকৃষ্ণ মিশন। তবে রামকৃষ্ণ মিশনের তরফ থেকে তাদের কথা মেনে বিদ্যালয় বন্ধ করতে রাজি হওয়ার পরেও তারা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই জোর করে তালা লাগিয়ে দেয়। যদিও পরে সেই প্রতিরোধ বেশি সময় টেকেনি, রামকৃষ্ণ মিশন আবার নিজের মতই সেখানে কাজ করছে। তবে এর মাধ্যমে আবারও সেখানে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি বার্তা দিয়েছে খাসি ছাত্র সংগঠন।
রামকৃষ্ণ মিশনের অবদান মেঘালয়ে যেকোনও সামাজিক সংগঠন থেকে অনেক বেশি। এমনকি যারা সরকারি সাহায্য পান না তাদের কাছে পৌঁছে রামকৃষ্ণ মিশন কাজ করছে এবং সেটা ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য। শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য নয়, রাজ্যে বসবাসকারী খাসিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের পাশেও সমানভাবে দাঁড়িয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের পরিষেবা অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়, প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা খরচ করে দুস্থ মানুষের মধ্যে খাদ্য এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে শিলং রামকৃষ্ণ মিশন। লকডাউন পরবর্তী সময়ে সরকারের নিয়ম মেনে ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে শুরু করে। এই ধারা মেনেই রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। তবে খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের চারজন সদস্য এসে রামকৃষ্ণ মিশনের ভেতরে ঢুকে অত্যন্ত হুমকিমূলক কথাবার্তা শুরু করে। তাদের অভিযোগ, সাদ পমলাঙ উৎসবকে অপমান করে বিদ্যালয় খোলা রাখা হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা কোনভাবেই স্থানীয় উৎসবকে অপমান করছেন না এবং স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দাবি মেনেই এক ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেবেন। সেটা মানতে রাজি হয়নি খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সদস্যরা, তারা বারবার হুমকি দিতে থাকে এবং শেষমেষ গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। পরে এব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা হয় রামকৃষ্ণ মিশনের কর্তৃপক্ষের এবং সময়মতো সেই তালাটি খুলে দেওয়া হয়।
করোনা পরবর্তী সময়ে এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে অংশ নিতে অনুমতি দিয়েছিল শিলং রামকৃষ্ণ মিশন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি খোলা হয়নি, শুধুমাত্র একটি অংশই খোলা ছিল। কোনওভাবেই কোভিড প্রটোকল ভাঙ্গা হয়নি। এছাড়া ক্লাস রুম থেকে অনলাইনে ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল। চেরাপুঞ্জির প্রায় ১০-১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী যারা ঘরে বসে পড়াশোনা করছে, তাদের সহায়তা করছিল প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্যই এতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রী ছিল। অনেকের পরের দিন পরীক্ষা ছিল, ফলে প্রতিষ্ঠানটি খোলা রেখে তাদের সহায়তা করছিলেন শিক্ষকরা।
খাসি-জয়ন্তিয়া হিলস এলাকায় রামকৃষ্ণ মিশন নতুন নয়। ১৯২৬ সাল থেকে পাহাড়ে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন মিশনের মহারাজরা। যখন সরকার সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি পরিষেবা পৌঁছে দিতে পারেনি, রামকৃষ্ণ মিশন কাজটি করেছে। তারা সেখানে শুধুমাত্র বাঙালিদের বা হিন্দুদের জন্য কাজটি করেনি। খাসিয়া সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান মানুষের জন্য সমানভাবে সেবা দিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্যরা। হাজার হাজার দুস্থ পরিবার তাদের সহায়তা পেয়ে সাধারণ জীবন যাপন করতে পেরেছে। অথচ এর অনেক পরে জন্ম নেওয়া একটি ছাত্র সংগঠন রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে এধরনের ব্যবহার করছে। খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৮ সালে, তাদের অবদান অন্য ক্ষেত্রে থাকলেও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে রামকৃষ্ণ মিশন তাদের থেকে অনেক এগিয়ে। তবু রাজনৈতিক কারণে সাধারণ বাঙালিদের উপর অত্যাচার করতে করতে এবার তারা রামকৃষ্ণ মিশনের মত প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেছে।
যেখানে সৌদি আরবের মত দেশ রামকৃষ্ণ মিশনকে মন্দির বানাতে সাহায্য করে এবং তাদের কাজের প্রশংসা করে। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেকে আদ্যোপান্ত রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত হিসেবে প্রচার করেন, সেই রামকৃষ্ণ মিশনের গেটে তালা লাগিয়ে দেয় মেঘালয়ের একটি ছাত্র সংগঠন। এর মাধ্যমে অবশ্যই একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এবার শিলং রামকৃষ্ণ মিশনে প্রতিমা ছাড়াই দুর্গাপূজা হয়েছে। সেই পুজোয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এসে প্রসাদ খেয়েছেন, তার সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যসচিব সহ অন্যান্য আধিকারিকরাও ছিলেন। অথচ এই ঘটনার পর তারা কেউ রামকৃষ্ণ মিশনের সমর্থনে এগিয়ে এসে কোনও কথা বলেননি। স্থানীয় এক সংবাদপত্র শিলং রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে লিখেছে।
মিশনের মহারাজ হিতকামানন্দজি জানান, শিলংয়ের সব থেকে বড় বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শিবির হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ সেন্টারটি। স্বামী বিবেকানন্দ নিজে এখানে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিল্ডিংটি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেন মালিক। সেখানেই বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ শিবির করে তোলা হয়েছে। এই শিবিরে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল কিছু ছাত্ররা।
মেঘালয়ের এখন সব থেকে বড় আর্থিক দিক হচ্ছে ট্যুরিজম। যেহেতু এই রাজ্যে বাঙালিদের একটি ইতিহাস রয়েছে এবং দর্শনীয় স্থানগুলোর সঙ্গে সেগুলোর যোগসূত্র রয়েছে, বেশিরভাগ বাঙালিরাই সেখানে ঘুরতে যান। তবে মেঘালয়ের বর্তমান সরকার মিজোরামের মত মেঘালয় ইনার লাইন পার্মিট চালু করার কথা বলছে। এতে রাজ্যের কতটুকু লাভ হচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।
Comments are closed.