Also read in

মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল খেতাব জিতলেন মেঘালয়ের গার্গী নন্দী, "আমার ৯০ শতাংশ সমর্থক খাসিয়া, তারা আমাকে নিয়ে গর্বিত"

২০১৬ সালে অসমের বাঙালি মেয়ে প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি মিস ইণ্ডিয়া খেতাব জিতেছিলেন। তিনি সেই বছর মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে সেরা-১০ প্রতিযোগিদের মধ্যে একজন ছিলেন। সেই রাস্তা ধরেই এবার উত্তর-পূর্বের নাম উজ্জ্বল করেছেন আরেক বঙ্গতনয়া গার্গী নন্দী। মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল প্রতিযোগিতায় মেঘালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সিলেটি মেয়ে গার্গী। গত সপ্তাহে গোয়ায় প্রতিযোগিতার ফাইনালে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল তাদের বিজয়ীদের আন্তর্জাতিক পেজেন্টে পাঠায়, সেটা ২০২১ সালে হবে। গার্গী নন্দী শুধু এখানেই থেমে থাকতে চান না, ভবিষ্যতে মিস ইউনিভার্স হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তার। ইতিমধ্যে দক্ষিণী সিনেমার অফার আসতে শুরু করেছে, কিন্তু তিনি পেজেন্টে আরেকটু সময় কাটিয়ে তারপর কোনও সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছুক। শিলংয়ের বাঙালি পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতীয় স্তরে, তিনি যোগ্য প্রার্থী ছিলেন এটা প্রমাণ করে খেতাব জিতে বাড়ি ফিরেছেন। বরাক বুলেটিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তার অনুভূতি তুলে ধরেন গার্গী নন্দী।

যখন মেঘালয়ে বাঙালি নির্যাতনের ঘটনার খবর বারবার আসছে, খাসি ছাত্র সংগঠন রাজ্যে বসবাসকারী প্রত্যেক বাঙালিকে বাংলাদেশি আখ্যা দিচ্ছে। সেইসময় জাতীয় স্তরের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মেঘালয়ের মুখ এক সিলেটি বাঙালি মেয়ে। শিলংয়ের গার্গী নন্দী মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল খেতাব জিতেছেন। আগামী বছর আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন। কেমন লাগছে তার? এই প্রশ্নের উত্তরে গার্গী বলেন, “জন্ম থেকেই শিলংয়ে রয়েছি এখানেই বড় হয়েছি, আমার বেশিরভাগ বন্ধুরাই খাসিয়া সম্প্রদায়ের। কোনওদিন তাদের কাছ থেকে একবারের জন্যও বাঙালি হওয়ার দায়ে কোনও দুর্ব্যবহার পাইনি। যদি তারা আমাকে গ্রহণ করতেন না, তাহলে এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আমার মেন্টর থেকে শুরু করে প্রত্যেক সহযোগী খাসিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ, তারা বরং আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি পপুলার ক্যাটাগরিতে যে ভোট পেয়েছি তার ৯৫ শতাংশ এসেছে আমার রাজ্য থেকে, অর্থাৎ খাসিয়ারা আমাকে ভোট দিতে পিছিয়ে থাকেননি। আমি ফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার পর যখন গোয়া যাচ্ছিলাম, আমার সঙ্গে যতজন বন্ধু সম্ভব হয়েছে গেছে, পুরো যাত্রায় আমার সহায়তা করেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই খাসিয়া সম্প্রদায়ের। তাহলে কি করে বলবো বাঙালিরা এখানে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন না? দু’একটা ঘটনা ঘটেছে এবং কিছু কথাবার্তা উঠে এসেছে, তবে অপরাধীর কোনও জাত হয়না-ধর্ম হয়না, সে শুধুমাত্র অপরাধী। এই ঘটনাকে নিয়ে যারা ভুল কথা বলেছে তাদের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাইনা। তবে আমি মেঘালয়ের একজন নাগরিক যাকে রাজ্যের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষ সমর্থন করেছে বলেই এত বড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পেরেছি। জয়ী হয়ে বাড়ি ফেরার আগে থেকেই প্রত্যেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, স্থানীয় মিডিয়া আমাকে নিয়ে অত্যন্ত উৎফুল্ল। পরিচিতরা আমার সাফল্যে আমার থেকেও বেশি আনন্দিত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই খাসিয়া সম্প্রদায়ের, কই কেউ তো বলেনি আমি বাঙালি বলে আমার সাফল্য তাদের কাছে আনন্দের ব্যাপার নয়।”

 

Gargi Nandi’s big winning moment.

মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল প্রতিযোগিতার বিজয়ী আন্তর্জাতিক পেজেন্টে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। মেঘালয় থেকে গার্গী নন্দীই প্রথম এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এই বছর করোনাভাইরাসের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে সব ধরনের কম্পিটিশন প্রায় বন্ধ রাখা হয়েছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতার মধ্যে শুধুমাত্র মিস আর্থ এবছর সম্পন্ন হয়েছে, বাকি মিস ইউনিভার্স, মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইন্টারন্যাশনালের মত প্রতিযোগিতা এই বছর হচ্ছে না। তবে প্রত্যেক দেশেই নিজেদের প্রতিযোগী ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। ভারতবর্ষেও কয়েকটি কম্পিটিশন এখন পর্যন্ত হয়ে গেছে, শুধুমাত্র মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড বাকি রয়েছে। এর মধ্যে থেকে মিস ইন্ডিয়া গ্লোবাল জিতেছেন মেঘালয়ের গার্গী নন্দী। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অনুভূতি নিয়ে তিনি বলেন, “জাতীয় স্তরের কমপিটিশনে একটা সেকশনে নিজের রাজ্যের কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরতে হয়, যাকে ‘ন্যাশনাল কস্টিউম কম্পিটিশন’ বলা হয়। সেখানে আমি মেঘালয়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যের সংস্কৃতির পোশাক পড়েছি। বিচারকরা এতে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এছাড়া ‘বিউটি উইথ দা পারপাস’ সেকশনে প্রতিযোগিদের সামাজিক দায়িত্ব যাচাই করা হয়। সেখানে আমি মেয়েদের শিক্ষা এবং তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারে একটি পদক্ষেপ নিয়েছি। পাহাড়ি মেয়েরা আর্থিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে তার অন্যতম কারণ শিক্ষার অভাব। এরই সঙ্গে রয়েছে তাদের হাইজিন নিয়ে সমস্যা। এতেও বিচারকরা আমার প্রশংসা করেছেন। ফাইনাল রাউণ্ডে মেয়েদের উপর অত্যাচার নিয়ে কথা উঠে, দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আমাদের রাজ্যের মেয়েদের অবস্থার ফারাক রয়েছে। মেঘালয় নারীপ্রধান রাজ্য, ফলে এখানে মেয়েদের আলাদা চোখে দেখা হয়। তাই আমার উত্তর অন্যদের থেকে একটু আলাদাই ছিল। সব মিলিয়ে বিচারকরা আমাকে বিজয়ী হিসেবে গণ্য করেছেন, এটাই জীবনের সেরা মুহূর্ত। তবে সব সময় বলা হয় সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুকুট শুধুমাত্র একটি খেতাব নয়, দায়িত্ব। স্টেজে যে কথাগুলো দিয়েছি সেটা রাখতে এবার অনেক বেশি কাজ করতে হবে। আশা করছি এই খেতাবের সহায়তায় আমার রাজ্যের মহিলাদের আরও কাছাকাছি পৌঁছে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারব।”

শিলংয়ে সরকারি চাকরি করেন তার বাবা, চাকরির খাতিরে একবছর পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন, পরে আবার রাজ্যে ফিরেছেন। বাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ছোটবেলা থেকে ঘোরার সুযোগ পেয়েছেন গার্গী নন্দী। মা ছোট্ট একটি ব্যবসা করেন, এর মাধ্যমে মহিলাদের সাহায্য করেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর মাস কমিউনিকেশন পড়ার জন্য ব্যাঙ্গালোর চলে যান গার্গী নন্দী। সেখানে ফ্যাশন জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়, তবে পেজেন্ট একেবারেই আলাদা জিনিস। এই যাত্রার ব্যাপারে তিনি বলেন, “যেহেতু মা ছোটবেলা থেকেই আমাদের খুব পরিপাটি করে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে শিখিয়েছেন, সেই অভ্যাস এখনও রয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে ফ্যাশন-শো দেখেছি, অংশ নিয়েছি, এমনকি আমার রাজ্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য মডেলিং করেছি। তবে পেজেন্ট একেবারেই আলাদা ব্যাপার। লকডাউনে বাড়ি ফেরার পর এখানেই অনেকে বলেছিলেন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। রাজ্য স্তরের সেলফি কনটেস্টে ফার্স্ট রানারস-আপ হয়েছিলাম। এরপর ফেমিনা মিস ইন্ডিয়ায় চেষ্টা করি কিন্তু সেখানে বেশি সময় দিতে পারিনি। পরে আমার মেন্টর জানালেন মিস ইন্ডিয়া গ্লোবাল প্রতিযোগিতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তারাই জোর করে আমাকে পাঠালেন। শুধু পাঠানো নয় পুরো প্রক্রিয়ায় আমাকে গাইড করে গেছেন। যেটা আমি দেখতে পারিনি তারা পেরেছিলেন, ঘর থেকে বেরিয়ে মিস মেঘালয় হয়ে এবার মিস ইণ্ডিয়া গ্লোবাল খেতাব। এত তাড়াতাড়ি এতটা সম্ভব হবে ভাবতেই পারিনি।”

Gargi Nandi strikes a pose.

ইতিমধ্যে দক্ষিণী সিনেমার অফার পেয়েছেন গার্গী নন্দী, তবে এখনই অভিনয়ের জগতে যেতে চাইছেন না তিনি, বরং পেজেন্ট জগতে আরও কিছু সময় থেকে আরেকটু সফলতার স্বাদ নিতে চান। তিনি বলেন, “প্রথম থেকে মিস ইন্ডিয়া হওয়ার স্বপ্ন ছিলনা, কিন্তু যত বেশি জানতে পেরেছি স্বপ্ন ততটাই বড় হয়েছে। এবার একটি জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছি, আশা করছি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মেও সাফল্য পাব। তবে এখানেই শেষ নয়, পরবর্তীতে ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া বা মিস ডিভা প্রতিযোগিতায় গিয়ে মিস ইউনিভার্স বা মিস ওয়ার্ল্ড হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে চাই। শুধু ক্যারিয়ার গড়তে নয় মানুষ হিসেবে নিজেকে আরও অনেক বেশি প্রমাণ করতে এসব প্রতিযোগিতায় যেতে চাই। মিস ইউনিভার্স বা মিস ওয়ার্ল্ড হতে পারলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে, সেই উপলব্ধি পাওয়ার ইচ্ছা মনে রয়েছে। এছাড়া অভিনয় সহজ জিনিস নয়, তার জন্য অনেক কিছু শিখতে হয়। আমি বিশ্বাস করি জীবনে কিছু পেতে হলে নিজেকে আগে তার জন্য তৈরি করতে হয়, পেজেন্টে যাওয়ার জন্য আমি পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি তাই হয়তো সাফল্য এসেছে। অভিনয়ে যেতে হলে সেভাবেই নিজেকে আগে তৈরি করব, তারপরে কোনও অফার গ্রহণ করব।”

পড়াশোনার পাশাপাশি টেনিস খেলতে ভালোবাসেন গার্গী, সোমদেব দেববর্মনের ভাইয়ের সঙ্গে ত্রিপুরায় রাজ্য স্তরের মিক্স ডাবলস্ খেলেছেন। এব্যাপারে তিনি বলেন, “আমার মা-বাবা কখনই আমাদের কোনও কিছু শিখতে বাধা দেননি বরং পাশে থেকে সাহায্য করেছেন। আমাদের রাজ্যে মেয়েরা অনেক বেশি সুযোগ পায় নিজেকে গড়ে তোলার। পড়াশোনার সঙ্গে একদিকে যেমন ফ্যাশনের প্রতি মনোযোগ ছিল, অন্যদিকে টেনিস খেলায়ও আকৃষ্ট ছিলাম। এই খেলার প্রতি আলাদা টান রয়েছে। আগামীতে আমার আশেপাশে কোনও মেয়ে যদি টেনিস খেলোয়াড় বা বিশ্বসুন্দরী হওয়ার স্বপ্ন দেখে আমি তার পাশে থাকবো।”

 

Comments are closed.