Also read in

শহুরে প্রজন্ম ক্রিকেট-পাগল ও সৌখিন, হিমা দাসের মতো প্রতিভা গ্রাম থেকে উঠে আসে, বললেন কোচ নিপন দাস

সারা বিশ্বে অসমের মুখ উজ্জ্বল করেছেন স্প্রিন্টার হিমা দাস। তাকে দিহিং জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মূলস্রোতে তুলে আনতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তার কোচ নিপন দাশ। আজ ‘দিহিং এক্সপ্রেস’ নামে খ্যাত হিমা বিশ্ববিখ্যাত কৌচদের সান্নিধ্য পাচ্ছেন, তাকে নিয়ে অলিম্পিক গোল্ডের স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ। তাকে সামনে রেখে আরও নতুন প্রতিভার সন্ধান চলছে। তবে হিমার প্রথম গুরু নিপন দাশ মনে করেন, ক্রিকেট-পাগল শহুরে ছেলেমেয়েরা অ্যাথলেটিক্স নিয়ে স্বপ্ন দেখেনা, যদি হিমার মতো প্রতিভা খুঁজতে হয় তাহলে গ্রামে যেতে হবে।

এক সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্প্রতি শিলচর আসেন হিমা দাসের কোচ নিপন দাশ। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার আগে বরাক বুলেটিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন হিমার জীবনের বিভিন্ন দিক। পাশাপাশি অলিম্পিকের ক্ষেত্রে রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তাধারাও উঠে আসে আলোচনায়। তার কথাবার্তা এবং চিন্তাধারা কোথাও যেন ‘চক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমার মহিলা হকি দলের কোচ কবির খানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। সকালে অনুষ্ঠান শেষ করে দুপুরের বিমান ধরবেন, কাছাড় ক্লাবে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে অনেক কথা তুলে ধরেন তিনি।

হিমা দাস একসময় ফুটবল খেলতেন, নিপন দাস তাকে অ্যাথলেটিক্সে আসতে অনুরোধ করেন। তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের বোঝান। শেষমেষ রাজি হন হিমা। এব্যাপারে নিপন বলেন, ‘গ্রামেগঞ্জে খেলাধুলোয় ক্রিকেটের বাইরে সবথেকে জনপ্রিয় হচ্ছে ফুটবল। তবে সেখানে স্থানীয় অনেক খেলা রয়েছে যেগুলো শিশুদের অ্যাথলেটিক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তারা জানেইনা আরও কত ধরনের খেলার সুযোগ রয়েছে এবং এর মাধ্যমে বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের কাছে পৌঁছে আমাদের প্রথমে প্রতিভাগুলো বুঝে নিতে হবে, এরপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একজন খেলোয়াড় হঠাৎ করে বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে যায় না, দীর্ঘদিন ধরে তার শরীরের উন্নতি প্রয়োজন, অবশ্যই ক্রিকেট খেলে হঠাৎ করে অ্যাথলিট হওয়া প্রায় অসম্ভব। এর বাইরেও অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে, সুযোগ পাওয়া এবং সেই মুহূর্তে ভাগ্যের সহায়তা, সব মিলে গেলে সফলতা আসে। হিমা ফুটবল খেলতেন, গ্রামের বিভিন্ন খেলায় যোগ দিয়েছেন, এতে তার শারীরিক গঠন একজন অ্যাথলিটের মত হয়েছে।”

অসমের দিহিং জেলায় খেলাধুলার পরিকাঠামোগত তেমন উন্নতি হয়নি, তবে সরকারি স্তরে বিভিন্ন খেলাধুলা হয়েছে, এতেই হিমা দাসের প্রতিভার দিকে নজর পড়ে কোচ নিপন দাসের। তিনি নিজে হিমা দাসের বাড়িতে যান এবং অনেক বোঝানোর পর হিমা বাড়ি ছেড়ে কোচিংয়ের জন্য গুয়াহাটি আসতে রাজি হন। এরপর এথলেটিক্স বিশ্বে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন হিমা দাস। নিপন দাস মনে করেন, আসল প্রতিভা লুকিয়ে আছে গ্রামেই। তিনি বলেন, “ভারতবর্ষ এত বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা অলিম্পিকে হাতেগোনা মেডেল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। এর কারণ হচ্ছে গ্রামের প্রতিভার দিকে নজর পড়েনি সরকারের। তবে গত কিছু বছর ধরে রাজ্যে এই ধারা পাল্টাতে শুরু করেছে, খেলো ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হয়েছে, এতে চোখে পড়েছে আমাদের আশেপাশে থাকা অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের দিকে। এছাড়া সরকার খেলোয়াড়দের উন্নতির জন্য এখন খরচ করতে রাজি আছেন, তারা এব্যাপারে কার্পণ্য করছেন না। এতে রাজ্য থেকে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। হিমা দাস আমাদের কাছে অনেক বড় নাম, কিন্তু আগামীতে আরও এমন অনেক নাম উঠে আসবে যারা এখন নিজেদের তৈরি করছেন।”

হিমা দাসের সাফল্যের পিছনে কোন বিষয় বেশি কাজ করে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সাধারণত অ্যাথলিটদের সাফল্যের ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তি ৬০ শতাংশ এবং মানসিক শক্তি ৪০ শতাংশ কাজ করে। তবে হিমার ক্ষেত্রে এটা উল্টো, সে মানসিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী মেয়ে। লক্ষ্য স্থির করে নিলে সেটা অর্জন করা পর্যন্ত কিছুতেই থেমে থাকতে চায় না, এতটাই জেদ তার। অন্যরা যতটুকু পরিশ্রম করে তার থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম করে হিমা, অনেক বেশি সময় ট্র্যাকে কাটায় এবং নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করে এবং প্রতিযোগিতায় নিজের সেরাটা তুলে ধরে, এতেই তার সাফল্য আসে। নতুন প্রজন্মের কাছে সে আজ একটি আদর্শ। কোচ হিসেবে আমরা নিজেদের যতটুকু নিংড়ে দিই, হিমা তার থেকে অনেক বেশি চেয়ে নেয়। আমরা অনেক সময় তার কাছ থেকে শিখি।”

গতবছর জাপানের টোকিওতে অলিম্পিকের আসর বসার কথা ছিল, এতে ভারতবর্ষের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ ছিলেন হিমা দাস। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে অলিম্পিকের আসর এক বছর পিছিয়ে গেছে। জাপানে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, হয়তো পুরো অলিম্পিকের আসর শেষমেষ বাতিল হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই হবে অলিম্পিক বাতিল হওয়ার ঘটনা। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ খেলোয়ার চারবছর ধরে অলিম্পিকের জন্য নিজেদের তৈরি করেন। অসমের হিমা দাস এভাবেই নিজেকে তৈরি করছেন। অলিম্পিক বাতিল হলে হিমার অনুভুতি কেমন হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অলিম্পিকে গোল্ড-মেডেল পাওয়া একজন অ্যাথলিটের জীবনের সেরা স্বপ্ন, সারা বিশ্বের প্রত্যেক অ্যাথলিট এই লক্ষ্যে নিজেদের তৈরি করেন, হিমাও করছেন। কিন্তু যদি করোনার জন্য অলিম্পিক বাতিল হয়, সেক্ষেত্রেও হতাশ হবেন না হিমা। আগামীতে এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমস রয়েছে। এগুলো আসরে মেডেল পাওয়াও কম সম্মানের নয়। আপাতত অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার জন্য নিজেকে তৈরি করছেন হিমা। চোটের জন্য হয়তো সবগুলো ক্যাটাগরিতে তিনি খেলবেন না। প্রথম লক্ষ্য ২০০ মিটার ক্যাটাগরিতে অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করা। তার পেটের পেশিতে ব্যথা রয়েছে, ফলে ৪০০ মিটার দৌড়ে অসুবিধা হবে। তবে একেবারে খেলার সম্ভাবনাই নেই, এটা বলছি না আমরা। এছাড়া রয়েছে মেয়েদের এবং মিক্স ক্যাটাগরিতে রেলি। ভারতীয় দল ইতিমধ্যে দলীয় ক্যাটাগরিতে অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করেছে। হিমা ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে যদি খুব ভালো প্রদর্শন করেন তাহলে তিনি দলগত প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। আপাতত তার ফোকাস ২০০ মিটার ক্যাটাগরিতে ভালো প্রদর্শন করা এবং অলিম্পিকের যোগ্যতা ছিনিয়ে নেওয়া। ১৫ থেকে ১৯ মার্চ পঞ্জাবের পাতিয়ালায় অনুষ্ঠিত হবে অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন প্রতিযোগিতা। এই বছর যোগ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে এমন, ১০০ মিটার ক্যাটাগরিতে মেয়েদের সময়সীমা ১১.১৫ সেকেন্ড, এর থেকে কম সময়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হবে। একইভাবে ২০০ মিটারের সময়সীমা ২২.৮০ সেকেন্ড এবং ৪০০ মিটারের সময়সীমা ৫১.৩৫ সেকেন্ড।‌ আমরা আশা করছি হিমা যোগ্যতা অর্জন করবে।”

অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল একসময় কেন্দ্র সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন। রাজ্যে এখন সরকারের উদ্যোগে ক্রীড়া মূলক অনুষ্ঠান অনেক বেশি হচ্ছে। এর একটা সুফল ধীরে ধীরে চোখে পড়তে শুরু করেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধুমাত্র গুয়াহাটিতে নয়, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখন বড় মাপের ক্রীড়ার আসর বসছে, বাড়ির কাছাকাছি এমন অনুষ্ঠান হলে প্রতিভাবান যুবক-যুবতীরা সহজে অংশ নিতে পারেন। প্রতিযোগিতায় মাঠে নামলে নিজেদের খামতিগুলো ধরা পড়ে এবং ভালো প্রদর্শন করলে প্রত্যেকের চোখে পড়েন তারা। ঠিকঠাক ভাবে প্রতিভাবান যুবক যুবতীর খোঁজ করলে ভবিষ্যতে আরও অনেক হিমা দাস আমাদের বাড়ির কাছে থেকে উঠে আসবেন না, এমনটা বলা যায়না।’

 

Comments are closed.