"ডিটেনশন ক্যাম্পে ৮৫ শতাংশই হিন্দু-বাঙালি, অনেকে আত্মহত্যা করেছেন, এটাই বাঙালির প্রতি বিজেপির প্রতিদান," বললেন প্রদ্যুৎ বরদলৈ
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সারা রাজ্যে ‘জনহুংকার র্যালি’ আয়োজন করছে প্রদেশ কংগ্রেস। যেহেতু কাছাড় জেলার একমাত্র মন্ত্রীর সমষ্টি হচ্ছে ধলাই, ফলে প্রথম অনুষ্ঠানটি সেখানে আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি রিপুন বরা, নগাঁওয়ের সাংসদ তথা প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি প্রদ্যুৎ বরদলৈ, শিলচরের প্রাক্তন সাংসদ তথা জাতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুস্মিতা দেব সহ অন্যান্যরা। তারা সরাসরি বিজেপি সরকারের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ তোলেন। সুস্মিতা দেব বলেন, “বিজেপির মিশন ১০০ প্লাসের অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মুল্য ১০০ টাকার বেশি করে তোলা।” রিপুন বরা বলেন, “বিজেপি কোনওভাবেই চায়না নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান হোক, কারণ এটি জিইয়ে রাখলে জনমনে ভয় বজায় রাখা সহজ,এতে তাদের নির্বাচনী প্রচারে সুবিধা হয়।” প্রদ্যুৎ বরদলৈ বলেন, “অসমে বসবাসকারী হিন্দুবাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে তুলতে চাইছে বিজেপি।” অনেকদিন পর কংগ্রেসের সভায় এতটা উচ্ছাস এবং জনসমাগম চোখে পড়ে। তবে নির্বাচনে উপত্যকার কোন্ কোন্ আসনে কংগ্রেস প্রার্থী দেবে এবং প্রার্থী কারা হচ্ছেন এব্যাপারে এখনও গোপনীয়তা রাখছে প্রদেশ কংগ্রেস।
রিপুন বরা তার ভাষণে বলেন, “দশকের পর দশক ধরে অসমে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অকারণে বাংলাদেশি তকমা গায়ে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালিরা বারবার অপমানিত হয়েছেন। এই সমস্যা মেটাতে এনআরসির মত একটি প্রক্রিয়া প্রয়োজন ছিল, যেটা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ শুরু করেছিলেন। সফল ভাবে এনআরসি হলে এতে নাম থাকা কোন ব্যক্তিকে আর বাংলাদেশি বলা যেত না। তবে বিজেপি ক্ষমতায় এসে এনআরসি প্রক্রিয়াকে তাদের রাজনীতির স্বার্থে দুর্ব্যবহার করেছে। নিরীহ মানুষকে ভয় দেখানোর কাজে এটি ব্যবহার করেছে, মানুষ বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়েও ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছেন। বরাকের মানুষকে ভেরিফিকেশনের জন্য কোকরাঝাড় সহ অসমের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। তারা গেছেন এবং নিজেদের সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন। এখন বিজেপি বলছে এটা তারা মানে না, অর্থাৎ সমস্যা জিইয়ে রাখতে চায়, এতে নিরীহ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভোট নেওয়া সহজ হবে তাই। তারা কংগ্রেস আমলের প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিয়ে একই ধরনের প্রকল্প নিজেদের নামে চালু করে এবং লোক ঠকায়। কাগজকল বন্ধ করে সেগুলো কর্পোরেটদের হাতে বিক্রির চক্রান্ত চলছে। আমরা আগামী নির্বাচনের জন্য এমন কিছু দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছি যারা বিজেপির কুশাসনের বিরোধিতা করে। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়, আমরা সরকারে ফিরলে কৃষি ঋণ মাপ করব, মহিলাদের বিভিন্ন ঋণ মুকুব করব, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি কমিয়ে আনব।”
নগাঁওয়ের সাংসদ তথা প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি প্রদ্যুৎ বরদলৈ বলেন, “বিজেপি বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার একটি বড়সড় পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা অসম চুক্তিকে পুরোপুরিভাবে মানছে না, শুধুমাত্র যেসব পয়েন্টের মাধ্যমে বাঙালিদের অধিকার খর্ব করা যায়, সেটা নিয়ে কথা বলছে। অসম চুক্তিতে নাগরিকত্বের বৃত্তিবর্ষ ১৯৭১ সাল, সেটা পাল্টে ভিত্তি বর্ষকে ১৯৫১ সাল করতে চায় বিজেপি। অতীতে আসু চেয়েছিল ১৯৫১ সালকে ভিত্তি বর্ষ করতে, এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা সন্তোষ মোহন দেব, ফলে ইন্দিরা গান্ধী এতে রাজি হননি। অসম চুক্তিকে উপেক্ষা করলেও এর ৬-নম্বর ধারার অজুহাতে বাঙালিদের সব অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে বর্তমান সরকার। তাদের পরিকল্পনার একটা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বিজেপির আমলে রাজ্যের ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। ডি’ভোটারের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সেই ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়েছি এবং তালিকা দেখে জানতে পেরেছি, ৮৫ শতাংশ আটক হওয়া ব্যক্তিই হিন্দু বাঙালি। অবশ্যই তারা ২০১৬ সালের পরে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৫৬ জন সন্দেহজনক ভারতীয় নাগরিক যারা হিন্দু বাঙালি, মারা গেছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার অভাবে অথবা কেউ আতঙ্কে হার্টফেল করে মারা গেছেন। প্রত্যেক মৃত্যুর জন্য দায়ী বর্তমান সরকার। তবে এর থেকে বড় কথা হচ্ছে, এসব ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুর প্রতি বিজেপির মনোভাব স্পষ্ট হয়। তারা বারবার বলেন কংগ্রেস বাঙালি বিদ্বেষী, আমরা একটু শুধরে দিয়ে বলতে চাই, রাজ্যে সব থেকে বেশি বাঙালি বিদ্বেষ হয়েছে অসম গণপরিষদের আমলে, যারা এখন বিজেপির মিত্র। আর এখন একেবারে জড় থেকে বাঙালির অধিকার উপড়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে খোদ বিজেপি।”
প্রদ্যুৎ বরদলৈ মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল সমন্বয়ের বার্তার মাধ্যমে আদতে সিন্ডিকেট রাজ চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “কংগ্রেস দলের নেতা হলেও প্রথম প্রথম সর্বানন্দ সোনোয়ালের মুখে বরাক-ব্রহ্মপুত্র সমন্বয়ের বার্তা শুনলে ভালো লাগতো, মনে হতো সত্যিই তারা কিছু একটা আলাদা ভাবছেন। তবে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, তিনি আসলে দুই উপত্যকার সব ধরনের সিন্ডিকেটের সমন্বয় চেয়েছেন, আর সেটা সম্ভবও হয়েছে। কয়লা থেকে শুরু করে সুপারি, ডিম, মাছ, পোস্তু, এমনকি গরু পাচারের সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তাকে সহায়তা করছেন বরাকের কৌশিক রাইয়ের মতো লোক। মাঝে মাঝে আশ্চর্য হই, কোন বিষয়ে সিন্ডিকেট হয় না? সর্বানন্দ সোনোয়াল নিজের সুবিধার্তে দুর্নীতিবাজ পুলিশ আধিকারিকদের বরাক উপত্যকা সহ তার প্রিয় জায়গায় পাঠিয়ে দেন এবং তারাও মুখ্যমন্ত্রীর সিন্ডিকেট যজ্ঞে সাহায্য করে।”
অনুষ্ঠানে কড়া ভাষায় মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্যের সমালোচনা করেন সুস্মিতা দেব। তিনি বলেন, “বরাক উপত্যকার একমাত্র মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্যের সমষ্টি থেকে বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে মিজোরামের দুষ্কৃতিরা, অথচ তিনি নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া কোন কাজ করতে পারেননি। এমন আরও অনেক ব্যর্থতার খতিয়ান আমি এখানে দাড়িয়ে তুলে ধরতে পারব। তারা বারবার চিৎকার করে বলছেন এই বছর তাদের লক্ষ্য ১০০+ প্লাস। আর এখানেই জনগণ আবার বোকা বনছেন, বিজেপির ১০০+ স্লোগানের অর্থ হচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ১০০ টাকার উপরে নিয়ে যাওয়া। সেটা পেট্রোল হোক, দুধ হোক বা মশলাপাতি, দাম ১০০+ হওয়া চাই, এতে কর্পোরেটদের সুবিধা হয়। কয়েকমাসের মধ্যেই নির্বাচন রয়েছে, আমি ভোট দাতাদের বলতে চাইছি, আপনাদের ভবিষ্যৎ কি হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন, এবার ভুল ব্যক্তিকে ভোট দিলে আগামী পাঁচ বছরে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা হয়তো কল্পনা করতে পারবেন না।”
এদিন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন মন্ত্রী রকিবুল হোসেন, বিহার থেকে আসা কংগ্রেস নেতা শাকিল আহমেদ খান, কংগ্রেসের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ, জেলা কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ দে সহ অনেকেই অংশ নেন এবং নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন।
Comments are closed.