নিউরোলজি বিভাগ না থাকায় চিকিৎসাই হলো না, অকালে চলে গেলেন চারুকলা শিল্পী মানস সিনহা
শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোলজি বিভাগ না থাকায় আবারও হারাতে হলো এক প্রতিভাবান শিল্পীকে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র তথা বলিউডের নামকরা সেট ডিজাইনার মানসকুমার সিনহা বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছিলেন। ন্যাশনাল হাইওয়ে রোডে অটোতে বসে বাড়ি যাবার সময়ে দ্রুতগামী লরির ধাক্কায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত হন তিনি। গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা বলেন অতিসত্বর নিউরোলজি বিভাগে চিকিৎসার প্রয়োজন। মাথায় চোট পেয়েছিলেন, কিন্তু শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটিস্ক্যান যন্ত্র খারাপ থাকায় তার পরীক্ষাই হয়নি। তার বন্ধুবান্ধব দেরি না করে তাকে নিয়ে গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, গুয়াহাটি পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় মৃত্যু হয় শিল্পী মানস সিনহার।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৮ বছর, লকডাউনের পর থেকে শিলচরের পাশে ভকতপুরে ভাড়া করে থাকতেন; তার মূল বাড়ি হাইলাকান্দির লালাবাজারে। দীর্ঘদিন ধরে মুম্বাইয়ের বালাজি স্টুডিও সহ বিভিন্ন নামকরা সেটে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন। গত বছর ২৫ জানুয়ারি সোনাই অঞ্চলে অটল বিহারী বাজপেয়ীর একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল, ফাইবারের মূর্তিটি তিনি বানিয়েছিলেন। তখন বরাক বুলেটিনের সঙ্গে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন মানস সিনহা।
আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছেলে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা সৌখিনতা। তবে স্বপ্ন তাকে তাড়া করে এবং আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তিনি মুম্বই পাড়ি দেন। সেখানে অনেক বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু কখনো সেব্যাপারে প্রচারে আসেননি। একসময় মা-বাবা অসুস্থ থাকায় সিদ্ধান্ত নেন কিছুদিন বাড়িতেই থাকবেন। এদিকে লকডাউন শুরু হয়ে গেছে, মুম্বাইতে শুটিং প্রায় বন্ধ, এই সুযোগে মা-বাবার পাশে থেকে সেবা করতে চেয়ে ছিলেন।
বাজপেয়ির মূর্তি বানানো নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “ব্যক্তি হিসেবে অটল বিহারি বাজপেয়ি আমার কাছে নমস্য। তার মূর্তি বানানোর সুযোগটা হাতছাড়া করি নি, অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে বানাতে হয়েছে এবং আমি আনন্দিত যে কাজটি শেষ করতে পেরেছি।”
সক্ষম সামাজিক সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মানস সিনহা। তিনি দিব্যাঙ্গদের মূর্তি বানানাে শেখাতেন। সােনাইয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীর মূর্তি নির্মাণেও তিনি দুই দিব্যাঙ্গকে সঙ্গে রেখেছিলেন। বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনার পর সক্ষমের সদস্যরা পাশে ছিলেন। সংস্থার সদস্য মিঠুন রায় জানিয়েছেন, এদিন দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর জানানো হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউরোলজি বিভাগে নিয়ে যেতে হবে। যেহেতু শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগ নেই, চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়েছিলেন মানস সিনহা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটিস্ক্যান যন্ত্র খারাপ থাকায় তার পরীক্ষাই সম্ভব হয়নি। দেরি না করে এম্বুলেন্সে মানস সিনহাকে নিয়ে রওনা হন বন্ধুরা। কিন্তু গুয়াহাটি পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়। শুক্রবার সকালে তার মৃতদেহ শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে ময়নাতদন্ত সহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হলে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তরফে অধ্যাপক নির্মল কান্তি রায় বলেন, “মানস সিনহা অন্যতম সেরা শিল্পী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আমরা দুজনে একসঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছিলাম। একদিকে যেমন অত্যন্ত ভালো শিল্পী ছিলেন, পাশাপাশি খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। পেইন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে মুম্বাইয়ে ভাস্কর্য নিয়ে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। মূলত টিভি সিরিয়ালগুলােতে সেট ডিজাইনের কাজ করেছেন। এমনকি রামানন্দ সাগরের রামায়ণ সিরিয়ালের রিমেকের সেট ডিজাইনেও ছিলেন। সােনি টিভির বেশকিছু সিরিয়ালেও কাজ করেছেন তিনি। বহুদিন ধরে বলিউডের বড় বড় সেটে লাগাতার কাজ করা অবশ্যই চাট্টিখানি কথা নয়। তার মৃত্যুতে আমরা প্রত্যেকে শোকাহত, এবার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছি।”
Comments are closed.