পার্থসারথি চন্দের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বরাক উপত্যকা, "তার জায়গা কেউ নিতে পারবে না"
গুরুচরণ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা পার্থসারথি চন্দের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা উপত্যকা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং তার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রত্যেকেই নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।
বুধবার রাত সাড়ে আটটায় মালুগ্রামের ভাঙ্গা কালিবাড়ী রোডে নিজের বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি; মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। প্রায় ৩৬ বছর গুরুচরণ কলেজে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকতা করেছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গুরুচরণ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৯৫-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জনতা পার্টি, কাছাড় জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে দলের কাজ করেছিলেন। ২০১২ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। মৃত্যুকাল অবধি দলের রাজ্য কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
আর প্রিয়জনের মৃত্যু দেখতে ইচ্ছে করছে না: কবীন্দ্র পুরকায়স্থ
পার্থসারথি চন্দের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ হতাশার সুরে বলেন, আর এই মুহূর্তগুলো মেনে নিতে পারছিনা। সবাই তো ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বড় খালি হয়ে যাচ্ছে গোটা সমাজ। পার্থসারথি চন্দ একজন শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সুদক্ষ এবং ছাত্রদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিজেপির আদর্শের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা। কখনও নিজের জন্য কিছু পাওয়ার চেষ্টা করেননি, শুধুই দিয়ে গেছেন। শিক্ষক হিসেবে তাকে যতটা শ্রদ্ধা করতাম একজন বিজেপি সদস্য হিসেবেও ততটাই শ্রদ্ধা ছিল তার প্রতি। অত্যন্ত সুবক্তা ছিলেন এবং প্রত্যেক বিষয়ে পড়াশোনা করতেন, চর্চা করতেন। এমন একজন ব্যক্তি চলে যাওয়া শুধুমাত্র বিজেপি নয়, সারা সমাজের জন্য একটা বড় ক্ষতি।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে স্যার আর নেই: পরিমল শুক্লবৈদ্য
আমি তার ছাত্র, তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে অন্যদের মতো আমিও গর্বিত। এই বছর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তার আশীর্বাদ নিতে বাড়িতে গেছিলাম, স্যার অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তখন তার শরীর কিছুটা দুর্বল ছিল তবে তিনি চলে যাবেন এটা ভাবতেও পারিনি। আজ বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, স্যার আর নেই। একজন মেধাবী শিক্ষাবিদ এবং ভারতীয় আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আমার জীবনের পথ প্রদর্শক এবং আলোর দিশারী ছিলেন। তার মৃত্যুতে শিলচর গুরুচরণ কলেজ সহ গোটা বরাক উপত্যকা একজন মহান শিক্ষাবিদকে হারালো। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
এই জায়গা আর পূরণ হবে না, তিনি ছিলেন সৎসাহসী: সুস্মিতা
তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির ভালো কাজের প্রশংসা করতে জানতেন, আবার খুব সুন্দরভাবে ভুলটাও ধরিয়ে দিতেন। যখন তার সঙ্গে দেখা হতো আমাদের ভালো কাজ গুলো মনে করিয়ে দিতেন। তার একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল এবং সেটা কখনও কারোর অজানা ছিলনা। তবু তিনি ছিলেন সব রাজনৈতিক আদর্শের ঊর্ধ্বে, একজন সত্যিকারের শিক্ষাবিদ। প্রত্যেক রাজনৈতিক চিন্তাধারার ব্যক্তিরা তাকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তার মত ব্যক্তিত্বের বিকল্প হয় না। এমন একজন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়ে একেবারে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। তিনি চলে যাওয়ায় যে জায়গা খালি হয়ে গেছে সেটা আর কখনোই পূরণ হবে না।
তাঁর মতো সুতার্কিক আমি চর্মচোক্ষে দেখি নি: জয়দীপ বিশ্বাস
পার্থসারথি চন্দ আমার দেখা সবথেকে বড় তর্কবিদ। অসাধারণ ছিল তার কৌতুকবোধ, তীক্ষ্ম বাচনভঙ্গি, আঁটোসাটো যুক্তিজাল। প্রথম বাক্যেই ধরাশায়ী করে দেবেন বিপক্ষকে। এমন সুতার্কিক আমি চর্মচোক্ষে দেখি নি। আমি যখন কোন তর্কের অনুষ্ঠানে তার বিপক্ষে বসে আছি, তিনি বলতেন, ‘মিস্টার স্পিকার স্যার, জয়দীপ নেভার টেলস অ্যা লাই। হি লাইজ অনলি হোয়েন হি স্পিকস!’
গুরুচরণ কলেজে ১৯৮৬-৮৮ এই দুই বছর আমি উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে ছিলাম। পার্থ স্যার ছিলেন আমার শিক্ষক। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নন, ডিবেটর পার্থ স্যার আমাকে আকর্ষণ করতেন বরাবর। অসংখ্য তর্কসভায় আমরা প্রস্তাবের দুইদিকে গলা ফাটিয়েছি। মতাদর্শগত পার্থক্যের জন্য স্যারের সঙ্গে কখনও এক বেঞ্চে বসা হয় নি। আমার কিছু সহপাঠীদের সঙ্গে আজ স্মৃতি ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে। আদ্যন্ত উদার ছিলেন তিনি। বিরুদ্ধ মত শ্রদ্ধার সঙ্গে ধৈর্য ধরে শোনার মত ঐদার্যে ভরা ছিলেন তিনি। বিজেপি দলের সক্রিয় সদস্য হয়েও নেহেরু ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখকদের একজন।
সুভদ্র, অকৃতদার, নিরহঙ্কারী, সহজ এই মানুষটির এই আকস্মিক প্রয়াণ বড় কষ্টের। চলে গেলেন আমাদের এক ভালবাসার মানুষ। আপনাকে মিস করছি, স্যার। শেষ প্রণাম।
তার অবদানের মূল্যায়ন হয়নি: দীপায়ন চক্রবর্তী
পার্থ স্যারের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রত্যেকের মত আমিও আমি মর্মাহত, এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন ভাবিনি। কাছাড় জেলা বিজেপির জন্য তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। দলকে তিনি শুধু দিয়েই গেছেন, কিছুই পাননি। দলের জন্য তিনি যা করেছেন, হয়তো তাকে তার যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি এবং তার অবদানের মূল্যায়ন হয়নি। যুব সমাজের কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান ব্যক্তি। আমি তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী মনে করতো স্যার তাকেই বেশি ভালোবাসেন: অপ্রতিম নাগ
প্রায় ৩৬ বছর গুরুচরণ কলেজে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকতা করেছিলেন পার্থসারথি চন্দ। ২০০৭ সালে আগস্ট মাস থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গুরুচরণ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হলেও বাংলা, ইতিহাস সহ অন্যান্য বিষয়ে ছিল তার অগাধ জ্ঞান। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বরাক উপত্যকার একজন প্রথম সারির তর্কবিদ ছিলেন। আমরা তাঁর কাছে এই বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। তার এতো স্মরণ শক্তি ছিল, প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর নাম জানতেন, তারা কি করে সেটা জানতেন। স্যারের এভাবে চলে যাওয়ায় গোটা সমাজের ক্ষতি হয়েছে।
Comments are closed.