
'করোনা'কে হারিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন ৯৭-বছরের জ্যোৎস্না রানী দেব; "চিকিৎসকদের সম্মান করতে শিখুন" বললেন তার ছেলে
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং রোগীর বেঁচে ওঠার উদ্দমে অনেক দুর্বল এবং কঠিন পরিস্থিতিতে থাকা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। গত সপ্তাহে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক ৯৪ বছরের রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন এবার সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৯৭ বছরের এক মহিলা সুস্থ হলেন। শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইতিহাসে তিনি সব থেকে বয়স্ক করোনা আক্রান্ত রোগী যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এতে চিকিৎসকদের মধ্যে তৃপ্তি এবং আনন্দ দেখা গেছে। বাড়ি ফেরার আগে তারা রোগীকে সংবর্ধনা দিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন।
সোমবার দুপুরে শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডের বাইরে চিকিৎসকরা জড়ো হন। সুস্থ হওয়া রোগীকে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবারের লোকেরা স্ট্রেচারে বসিয়ে বাইরে নিয়ে আসেন। প্রত্যেকের মনেই এক অদ্ভুত তৃপ্তি এবং আনন্দের ছোঁয়া লাগে। ৯৭ বছরের সুস্থ হওয়া মহিলা বেরিয়ে এসে সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রত্যেকের সুস্বাস্থ্যের কামনা করেন।
চিকিৎসক ঋতুরাগ ঠাকুরিয়া জানান, ৮ জুলাই শ্বাসকষ্ট, হাড়ের সমস্যা সহ বার্ধক্যজনিত বেশকিছু রোগে আক্রান্ত হয়ে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন উধারবন্দের বাসিন্দা জ্যোৎস্না রানী দেব। হাসপাতালে রেপিড এন্টিজেন টেস্টে তার শরীরে থাকা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে এবং তাকে সঙ্গে সঙ্গে কোভিড ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই তার বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা হয়েছে এবং অক্সিজেনের সাহায্যে তাকে রাখতে হয়েছে। ১২ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর রবিবার তিনি করোনা ভাইরাস মুক্ত হন। পাশাপাশি তাঁর অন্যান্য রোগের দিকগুলোও স্বাভাবিক হয়ে আসে, অক্সিজেন সেচুরেশনও উন্নত হয়। রবিবার তাকে কোভিড ওয়ার্ড থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সোমবার বাড়ি যেতে অনুমতি দেন চিকিৎসকরা।
ঋতুরাগ ঠাকুরিয়া বলেন, “তিনি যে বয়সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানে চিকিৎসা প্রদান করা অত্যন্ত কঠিন ব্যপার ছিল। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এতটাই দুর্বল ছিল, যে তাকে খুব বেশি অক্সিজেন পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এছাড়া তিনি ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন, ফলে অনেক কিছুই মনে থাকছেনা এবং অনেককে চিনতে পারছিলেন না। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও তাকে চাঙ্গা রাখতে হয়েছে আমাদের। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পুরো টিম নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন এবং তাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে। এতে আমরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত আনন্দিত এবং আস্বস্ত। চিকিৎসকদের কাছে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা কতটুকু তৃপ্তির, এটা হয়তো মুখে বলে বোঝানো যাবে না। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি এবং তিনি যেন সুস্থ থাকেন এটাই আমাদের ইচ্ছে।”
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তেজপুরে ১০০ বছরের এক মহিলা করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েছিলেন এবং তখন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নিজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে জ্যোৎস্না রানী দেব সম্ভবত রাজ্যের সব থেকে বয়স্ক রোগী যিনি করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হলেন এবং বাড়ি ফিরে গেলেন। এদিন জ্যোৎস্না রানী দেবকে বাড়ি পাঠানোর আগে ছোটখাটো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ডাঃ ঋতুরাগ ঠাকুরিয়া ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক ডাঃ বিকাশ শান্ডিল্য, ডাঃ প্রসেনজিৎ ঘোষ, ডাঃ অমিত কালোয়ার, ডাঃ নবারুণা পাল সহ অন্যান্যরা।
জ্যোৎস্না রানী দেবের ছেলে এদিন তার মাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগিক হয়ে পড়েন। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “বরাক উপত্যকায় শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মত চিকিৎসা আর কোথাও হয় বলে আমি মনে করি না। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে যত্ন নিয়ে আমার মায়ের চিকিৎসা করেছেন, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাদের কাছে আমি ঋণী এবং নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার ভাষা নেই। চিকিৎসকরা দুঃসময়ে রোগীর জন্য কতটুকু খাটেন সেটা যে দেখে হয়তো সেই উপলব্ধি করতে পারে। আমি সমাজের কাছে বলব, এই দুঃসময়ে চিকিৎসকের স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মান করতে শিখুন।”
শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বরাক উপত্যকার বেশিরভাগ ক্রিটিক্যাল অবস্থায় থাকা রোগীর চিকিৎসা হয়েছে এবং অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। একসময় মৃত্যুর হার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, যে চিকিৎসকরা অনেকটা আতঙ্কিত ছিলেন। দ্বিতীয় ঢেউ হঠাৎ করে আছড়ে পড়ার পর সরকারের তরফে তড়িঘড়ি শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১০০ শয্যার মধ্যেও একসময় জায়গা ছিল না এবং সরকারের তরফে পরিকল্পনা করা হয় আরও ৪০টি আইসিইউ শয্যা বৃদ্ধি করা হবে। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এখন প্রায়ই এমন দিন যাচ্ছে, যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে না। সারাদেশে তৃতীয় ঢেউ আছে পড়ার একটি সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞরা দেখছেন এবং তার জন্য শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা আগে থেকেই নিজেদের মানসিক ভাবে তৈরি রাখছেন। এত পরিশ্রমের মধ্যেও যখন এভাবে ক্রিটিক্যাল রোগী যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন, চিকিৎসকরা কাজের ক্ষেত্রে আর একটু উৎসাহ পান।
Comments are closed.