Also read in

একটি স্বপ্ন, মন্দির এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল ভিডিও; হাজারো মানুষের সমাগম এওলাবাড়িতে

একাত্তর বছর আগের কথা; পুরোহিত রণবিজয় ভট্টাচার্য যিনি ভুতন ঠাকুর নামে সমধিক পরিচিত, করিমগঞ্জের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশকুট গ্রামের কাছে এওলাবাড়িতে ২৯ বিঘা জমি কিনেছিলেন। বাড়ি বানিয়ে ঘর গেরস্থালি পেতে বসে ছিলেন। উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই উঁচু-নিচু জমিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত কৃষি এবং বাগান করার । এক রাতে, রণবিজয় ভট্টাচার্যের স্বপ্নে মা মনসার আবির্ভাব ঘটে এবং সূচনা হয় এওলাবাড়ি মন্দিরের ।

প্রয়াত রণবিজয় ভট্টাচার্যের পুত্র সিতু ভট্টাচার্য স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বলেন, “পাহাড়ের চূড়ায় আমাদের বাড়ির পাশে একটি টিলার উপরে একটা বড়সড় পাথর আছে। সেই পাথরটি স্বপ্নে মা মনসারূপে (সাপের দেবী) আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং আমার পিতা অর্থাৎ ভুতন ঠাকুরকে প্রতিদিন মনসা পূজা করার জন্য বলেন। অন্যথায়, অচিরেই একটি দুর্ঘটনা ঘটার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তখন দিন-দুপুরে এতদঞ্চলে বাঘ এবং অন্যান্য হিংস্র প্রাণী ঘুরে বেড়াতো। এখনকার বেশ কয়েকজন এই বন্য জন্তুর আক্রমণে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে ছিল।”

পাহাড়ের চূড়ায় সিঁড়ি নেই, নিরাপদ পথও নেই। তাই, রণবিজয় ভট্টাচার্য তাঁর নিজের বাড়িতে একটি মন্দির তৈরি করেন এবং মা মনসার পূজা শুরু করেন। শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে বেশ বড় করে মনসা পূজা হয়। তাছাড়া ‘পঞ্চমী’ তিথিগুলোতে মন্দিরে বিশেষভাবে পুজো হয়। “আমরা দেখেছি বাঘ আমাদের নিজেদের আঙ্গিনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু তারা কখনো আমাদের আক্রমণ করেনি। আমরা নিয়মিত পূজা চালিয়ে যাচ্ছি এবং প্রতি পঞ্চমীতে কয়েকশো ভক্তদেরকে খিচুড়ি প্রসাদ দেওয়া হয়। তিনি শুধু আমাদের বলেছিলেন যে, আমরা চাঁদা হিসাবে কোন অর্থ চাইতে পারবনা। আমরা এখনো কারোর কাছে চাঁদা চাই না। তবে স্বেচ্ছায় অনেকেই ভক্তিভরে অনেক কিছু দিয়ে যান”, জানান সিতু ভট্টাচার্য।

গত ৭১ বছর ধরে সেই মন্দিরে মা মনসার পূজা করা হচ্ছে। যাইহোক, দ্বিতীয় লকডাউনের পরে পরেই মন্দিরে হাজার হাজার পর্যটক আসতে শুরু করে। “আট বছর আগে, আমি একাই মন্দিরের সিঁড়ি নির্মাণ শুরু করেছিলাম। যখন আমরা সবেমাত্র শুরু করেছি, তখন দুজন ভক্ত বলেন যে, সিড়ির পরিবর্তে একটি ফ্লাইওভার টাইপ ফুট-ওভারব্রিজ তৈরি করতে হবে। যখন আমি বললাম, আমার কাছে টাকা নেই, তারা সাথে সাথে আমাকে সহযোগিতা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে আরো ১৭ জন এই কাজে সহায়তা করেছিল । তাই, টিলার উপরে এই সুন্দর ফুট-ওভারব্রিজ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, ”ভট্টাচার্য জানান।

 

 

কিন্তু তারপরও, খুব বেশি লোক আসতনা- দিনে দুতিন শ। হঠাৎ করে এক বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেল। “লকডাউনের সময় কয়েকজন এসে ফটো ও ভিডিও তুলে নিয়ে যায় এবং খুব সম্ভবত তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্দিরের একটি ভিডিও আপলোড করে। হঠাৎ করে, দৈনিক হাজার হাজার লোক মন্দির দর্শন করতে শুরু করে। এই ভিড় দেখে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকেও খবরা-খবর নেওয়া হয় দুই তিন বার”, ভট্টাচার্য জানান।

যদিও এটা খুবই ভালো যে মন্দিরটি এখন বরাক উপত্যকার মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে, কিন্তু এটি পুরোহিত সিতু ভট্টাচার্যকে একটি নতুন সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। “তারা ধরে নিয়েছে যে এটি একটি পিকনিক স্পট। তারা মদ খায়, তাদের শার্ট খুলে পবিত্র পাথর স্পর্শ করে এবং ছবির জন্য পোজ দেয়। মা মনসার পবিত্র মন্দিরের প্রতি এই অসম্মান আমাদের চিন্তিত করছে এবং তাই, আমরা মন্দিরটি তালাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ”ভট্টাচার্য জানান।

 

 

যাই হোক, একটি স্বপ্ন, মা মনসার পূজা, আশীর্বাদের উপাখ্যান এবং সামাজিক মাধ্যমে বহুল প্রচারে পূর্বের স্বল্প পরিচিত এওলাবাড়ি এখন একটি ব্যস্ত জায়গা। কিন্তু ভক্তির বদলে ভ্রমণের জায়গা হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় ব্যাপারটি ভট্টাচার্যদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Comments are closed.