Also read in

বাবা, জেপিসি কি? মানুষ এটা নিয়ে এত কথা কেন বলছে?

কদিন ধরে বরাক উপত্যকায় জে পি সি অর্থাৎ যৌথ সংসদীয় কমিটির কথা সবার মুখে মুখে ঘুরছে এবং এই উপত্যকা তথা সমগ্র আসামে বিতর্ক / আলোচনার একটি বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।এর মূল কারন হচ্ছে যৌথ সংসদীয় কমিটির সদস্যদের আসামে আগমন । গত কয়েক বছর ধরে এনআরসি (রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি) নিয়ে সমগ্র আসামে চর্চা চলছিল আর এখন এই মুহূর্তে জেপিসি নিয়ে। জেপিসি বিভিন্ন সংস্থা/বুদ্ধিজীবি  ও স্বাধীন সংস্থার মতামত নিতে এসেছে ; এই কমিটির রিপোর্টের উপরই ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব বিলের সংশোধনের ভবিষ্যত নির্ভর করছে ।এই কমিটি আজ এবং আগামীকাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এন আই টি) একটি অডিটোরিয়ামে পরামর্শ/মতামত গ্রহন করবে।
একটি ১৩ বছর বয়সী স্কুল ছাত্র, বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে এই JPC শব্দটি অনেক বার শুনেছে, তাই সন্ধ্যাবেলায় ডাইনিং টেবিলে খাবার খাওয়ার সময় তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “এই জেপিসিটি কি যে প্রত্যেকে আজ এই নিয়ে কথা বলছে, কিছু লোক গালাগাল  করছে আর কিছু উত্তেজিত হচ্ছে …” বাবা তখন ইলিশের কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন , “নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনের প্রস্ততি হিসেবে জনগনেরপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করার জন্য এই কমিটি আসছে,যা নাগরিকত্ব আইনে নতুন ধারা সংযোজনের ব্যাপারে সুপারিশ  করবে …” ছেলেটি এবার তার বাবাকে আরেকটা প্রশ্ন করল, “সিটিজেনশিপ অ্যাক্টটা কি?” ইলিশ খুব সুস্বাদু হলেও কাঁটাগুলোকে ছাড়াতেই বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় হয়ে যায়। বাবা বলেন, “এটি একটি বিল যার সাহায্যে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায় । ”

যদিও বাবা ভুল বলেননি, তবে তা অবশ্যই অসম্পূর্ণ ছিল। ভারতীয় সংবিধানের ১১অনুচ্ছেদে   সংসদকে স্থায়ী নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল । ১৯৫৫ সালে সংসদ নাগরিকত্ব আইন পাস করে, যা নাগরিকত্ব গ্রহণ তথা সংজ্ঞা নির্ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনটির মাপকাঠিগুলিই একজনকে  ভারতীয় নাগরিক বা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে নির্ধারিত করে। এই আইনটি এখন পর্যন্ত পাঁচবার সংশোধিত হয়েছে, এবং ষষ্ঠ সংশোধনী ২০১৬ সালে প্রস্তাবিত হয়েছে।

এদিকে বাচ্চা ছেলেটি এবার তার প্রিয় খাবার পনির এক টুকরো মুখে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে, “নতুন সংযোজনগুলি কি সংশোধন করতে চায়?” বাবা তাকে একটি গ্লাস জল ঢেলে দিতে দিতে উত্তর দেন, “এই বিল পাস হলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন,বৌদ্ধ ও পারসীরা ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারবেন।”

হ্যাঁ, বাবা এবার কিছু বিস্তারিত ভাবে বললেন কিন্তু আবারো কিছু কথা রয়ে গেল… নতুন বিলে মুসলিম দেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আশ্রয়ের এবং পরবর্তীতে নাগরিকত্ব লাভের একটি সুযোগ তৈরি করবে। বিলটিতে ধারনা আছে যে উপরে বর্ণিত সম্প্রদায়গুলি ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিল, এবং সেইজন্য তাদের এই দেশের মূল স্রোতে মিশে যেতে  খুব বেশী সময় লাগবে না।

বাচ্চাটি খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বাবাকে চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করে, “যদি হঠাৎ করে বাইরে থেকে আসা এক বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতীয় নাগরিক হয়ে যায়, আমরা কোথায় যাব?” এটা একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন এবং শুধু এই শিশুটিই নয়, এই প্রশ্ন মাথায় রেখেই এই বিলের সমালোচনা করছেন অনেকেই। বিলটিতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সুস্থ নাগরিক জীবনের সুযোগ দেওয়া হবে তা তুলে ধরা হয়নি ।

সদুত্তর খুজে না পেয়ে বাবা কিছুটা সমাজবিজ্ঞানের  পাঠ পড়ালেন , “সব কিছুই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে হয়, তোমরা ক্লাসে এটা পড়েছ,  আমরা সবাই একসঙ্গে একে অপরকে সাহায্য করে বেঁচে থাকব। ” শিশুটি খুবই ছোট তাই ধর্মীয় বিবাদ-বৈষম্য তার বোঝার কথা না, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই বুঝতে পারছেন ।

বিলটিতে আহমেদিয়া, রোহিঙ্গিয়াদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা ভারতে প্রবেশ করার জন্য উন্মুখ তাদের ব্যাপারে কোন কিছু বলা হয়নি।

বাবা সফলতার সঙ্গে ইলিশ খাওয়া শেষ করেছেন এবং এতে উৎসাহিত হয়েই বোধহয় এবার তিনিই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তুমি আমাকে এইসব জিজ্ঞাসা করছ। তুমি কি আবার অর্ণবের বিতর্কটি দেখেছ ?” বাচ্চা উত্তর দেবার আগেই ওর দাদু আহারের পর বজ্রাসন করতে করতে বললেন ,”আসাম নিয়ে চিৎকার করার মত এত সময় অর্ণবের নেই…”

দাদুভাই বাস্তবে নিয়ে এলেন।বাচ্চা বলল, “শিক্ষক, বড় দাদারা এবং এমনকি অটো আঙ্কল, সবাই জেপিসি সম্পর্কে কথা বলছে, তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম,কেন সবাই আসামে জেপিসি নিয়ে এত কথা বলছে?” বাবা এখন বুঝতে পারছেন যে তার বাবা ও সবকিছু শুনছেন। এক বুক শ্বাস নিয়ে এবার বললেন, “আসামে এটা ছয় বছর আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালে হওয়া আসাম চুক্তিকে বিরোধিতা করছে” দাদুভাই এই উত্তরে খুব একটা খুশি হলেন না এবং কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। আসাম চুক্তি হিসেবে যেটা উল্লেখ করা হয়েছে তা ভারত সরকার এবং আসাম আন্দোলন নেতাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি চুক্তি (MoS)। “এটি প্রফুল্ল কুমার মহন্তের আসাম থেকে বাঙালিকে বহিষ্কার করার কৌশল ছিল” দাদুভাই নিজেকে আর প্রতিহত করতে পারলেন না।

বাচ্চাটা ইতিমধ্যে বিভ্রান্ত হয়। আসলে এই জায়গাতেই বিরোধ। সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ (AAGSP) এবং সারা  আসাম ছাত্র সংগঠন (AASU) একরাজ্যব্যাপি আন্দোলন শুরু করেছিল, দাবি ছিল বিদেশি সনাক্তকরণ এবং ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে অবৈধ(বেশিরভাগই বাংলাদেশী) অভিবাসীদের নির্বাসন। তাদের যুক্তি ছিল আসামে বাংলাদেশীদের আধিপত্যে খিলঞ্জিয়া আদিবাসীদের সংস্কৃতি,জীবিকা এবং সব ধরনের সুযোগ সুবিধা হুমকির সম্মুখীন।বিক্ষোভ, আন্দোলনের পর আসাম গন পরিষদ নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হয় এবং প্রফুল্ল কুমার মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হন। সেই চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদনপত্র ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ বা এই নির্দিষ্ট তারিখের আগে এই দেশে আসা ব্যক্তিই করতে পারবেন। নতুন বিল ২০১৬ এর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বৃদ্ধি করে,এবং এটিই এই বিরোধীতার উৎস।

দাদুভাই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন, “হিন্দুরা কোথায় যাবে, পৃথিবীতে হিন্দুদের জন্য কোন স্থান আছে, আমরা কি ডিটেনশন কেম্পেই মারা যাব?” ষাট অতিক্রম করার পরেই মৃত্যুভয় একটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। বাবা এখন উৎকণ্ঠার  মধ্যে রয়েছেন কারণ তার ছেলে আশা-আশংকা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, দাদুভাইয়ের কথার কি উত্তর দেন তা শুনার জন্য ।

বাবা দার্শনিকের  ভান করে বললেন, “যা হয় হোক …” এবং খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন… তিনটি প্রজন্ম নিজেদের মধ্যে এই ভাবেই একটা সমঝোতায় এসে গেল।কিন্তু বরাক উপত্যকাবাসীদের জন্য আগামীকাল থেকে একটি নতুন যুগের সূচনা হতে পারে …

ভারত ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা থেকেই বিভক্ত হয়েছিল এবং এই বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই যে আজ মাত্র ১.৬% হিন্দু পাকিস্তানে রয়েছে এবং ১৯৫১ সালে তৎকালীন পাকিস্থানে ১২.৯% (পূর্ব ও পশ্চিমে) ছিল, বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ১৯৭১ সালের ১০% থেকে কমে এখন ৬.৭%। এটা  স্পষ্ট যে বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতার কারণে বিপুল সংখ্যক হিন্দু হয় ধর্মান্তরিত হয়েছে নতুবা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। এই বিল হিন্দুদের জন্য একটি স্বস্তির কারন হতে পারে এবং এটি নরেন্দ্র মোদির ২০১৪র ঘোষণাপত্রের একটি বড় অংশ। পাশাপাশি, বিলটি ‘আসাম অ্যাকর্ড’-এর বিরোধিতা করছে এমন ধারনাও ঠিক নয় কারন আসাম অ্যাকর্ড  ৮ এপ্রিল, ১৯৫০ তারিখে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধী । নেহরু-লিয়াকত চুক্তিটি প্রাথমিকভাবে দুই দেশেরই সংখ্যালঘুদের প্রতি একটি রাষ্ট্রীয় আশ্বাস ছিল এবং তাতে স্পষ্টতই  উল্লেখ করা ছিল যে উভয় দেশই নির্যাতিত সংখ্যালঘু অভিবাসীদের জন্য স্থান দেবে। কংগ্রেস আজ এই বিল নিয়ে বিতর্ক করছে আবার কিছু কংগ্রেসি সাংসদ এবং  নেতা এই বিলকে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন করছেন।

এই দুদিনে কি হয় এটার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। প্রসঙ্গক্রমে এই যৌথ সংসদীয় সমিতিটি দশম এবং এতে ২০ জন লোকসভার ও ১০ জন রাজ্যসভার সদস্য আছেন, নেতৃত্বে আছেন রাজেন্দ্র আগর ওয়াল ।

যাই হোক, বাচ্চা ছেলেটি এখন শুতে যাচ্ছে আর বলছে, “আমি যাই সকালে উঠেই আমাকে স্কুলে যেতে হবে, পরীক্ষা আছে ; বিকেলে আবার রবীন্দ্র জয়ন্তিতে আবৃত্তি করব, কলকাতার দিদি সোনার কি মজা স্কুল বন্ধ, সারা দিন রবীন্দ্র জয়ন্তিতে কাঁটাতে পারবে।”

Comments are closed.