শিলচর থেকে গুয়াহাটি, রাষ্ট্রীয় রাজপথে ৪০ ঘন্টার এই যাত্রার আরেক নাম আতঙ্ক
‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন” । হ্যা, আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ হাতে নিয়ে এভাবেই এগিয়ে চলেছে বরাকবাসী অনির্দিষ্টকাল ধরে। চিত্তে অনেক ভাবনা থাকলেও তা প্রকাশ করার জো নেই।
দুজন যাচ্ছিলাম গুয়াহাটি, আমি ডাক্তার দেখাতে এবং আমার এক আত্মীয় অফিসের জরুরি কাজে। কদিন ধরেই প্রকৃতির খেয়ালে ঝড়-বৃষ্টি তুফান চলছিল সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে। ১৫ তারিখ, বুধবার সকালে ছোট একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে।
সকালেই জয়ন্তিয়া পুলিশ সূত্রে জানতে পারি যে, সোনাপুরে ছোটখাট ধ্বস নেমেছে; কয়েক ঘন্টা লাগতে পারে রাস্তা খুলতে। ভাবলাম আমরা পৌঁছতে পৌঁছতে রাস্তা খুলে যাবে একটু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। তবু বাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে আসলেও দিগরখাল পেরিয়ে মা কালী হোটেল এবং রেস্টুরেন্টে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। সাথে খাবার জল, বিস্কুট এবং কিছু চকলেট নিলাম, যদি একটু বেশি সময় রাস্তায় আটকা পড়ি। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, কিছুদিন আগে বানানো রাস্তার পাশের ড্রেন গুলো কাজই করছে না, পাহাড় থেকে নামা জলস্রোত রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে স্থানে স্থানে। জলের ধারা স্রোত ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে পিচ, পাথর; সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্তের। স্থানে স্থানে ছোট ছোট ধ্বস; জেসিবি দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তেমনি কয়েকটা ধ্বস পেরিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ সোনাপুর দুর্গা মন্দিরে মাকে ভক্তিভরে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চললাম। কিন্তু টানেলের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই গাড়ির লম্বা লাইন চোখে পড়ল, পাশেই লোভা নদী প্রচন্ড স্রোতে, শব্দে বয়ে চলেছে।
পরিস্থিতি বুঝতে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে টানেল পেরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে জানতে পারলাম সোনাপুরের সেতুর পরে পরেই বেশ বড় ধরনের ধ্বস, তবে সরানোর কাজ চলছে । এরই ফাঁকে মেঘালয় প্রশাসনের তরফ থেকে একজন এসে আমাদের গাড়ির চালকের কাছে ছোট এক প্যাকেট সবিস্কো বিস্কুট এবং একটা ছোট জলের বোতল দিয়ে গেল- জিনিসগুলো ছোট হলেও এরকম সময়ে কেউ আমাদের খেয়াল রাখছে এই অনুভূতিটাই বড়। বৃষ্টি একটু কমায় প্রকৃতির এমন রূপ দেখতে আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম, শিলচরের অনেক চেনাজানা লোকের সাথেও দেখা হল, আলোচনায় প্রায়শঃই অসমাপ্ত মহাসড়কের কথা উঠে আসছিল।
আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সন্ধ্যার পর আশার আলো দেখা গেল; সবগুলো গাড়ি সচল হলো। ‘এখানে ট্রাফিক পুলিশ নেই, তাই ট্রাফিক আইন মানার কোনো প্রশ্নই নেই’ এমন মনোভাব নিয়ে সবগুলো গাড়ি একসাথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আরো তালগোল পাকিয়ে গেল। যাইহোক, এই বৃষ্টিতে ভিজেও কয়েকটা খাসিয়া ছেলে (সম্ভবত গ্রামীণ সুরক্ষা দলের) গাড়িগুলোকে সারিবদ্ধ করার চেষ্টা করছিল। প্রায় এক ঘন্টা লাগলো জায়গাটা পেরোতে, বেশ বিপদজনক ছিল, ধ্বসের ফলে রাস্তা অনেক ছোট হয়ে গেছিল , জলও গড়িয়ে চলছিল রাস্তার উপর দিয়ে।
‘যাক বাবা, আসল বিপদ পেরিয়ে গেছি’ এমন একটা মনোভাব নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। তবে জোরে চলার প্রশ্নই উঠে না, খুবই ধীরে ধীরে যেতে হচ্ছিল কারণ সর্বত্রই রাস্তার উপর দিয়ে জলের স্রোত বয়ে চলেছে। রাত বাড়ছে, খিদেও পাচ্ছে; সাথে থাকা জল, বিস্কুট, চকলেট প্রায় শেষের পথে – তখন আশায় আশায় ‘লাটুমবাই’ (লাড্রিমবাই) পৌঁছে খাবো ।
থামতে হলো ,এবার নির্জন স্থানে অসংখ্য গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে আছে । গাড়ি থেকে নামা তো দূরে থাক, জানালাটা ও খোলা যাচ্ছে না- আকাশ ভেঙে পড়ছে। অনেক কসরত করে জানতে পারলাম জায়গাটার নাম থাঙসাঙ (লোংসুলুংয়ের কাছে), একটু সামনে বিপদজনক ধ্বস এবং জলস্রোত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা – এদিকে খাবার খেয়ে রাত্তিরের ওষুধগুলো খেতে হবে। শেষ সম্বল ছিল নিউট্রিচয়েসের এক পেকেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট। তাই ভাগ করে খেয়ে নিলাম, তারপর রুটিনের ওষুধগুলো খাওয়া।
রাত দুটো নাগাদ আবার চাকা গড়াতে শুরু করলো, তবে এবারে রাস্তার অবস্থা এবং রাস্তার ওপর জলস্রোত দেখে চালক নিজেই ভয় পাচ্ছিল, যাত্রীরা যে যার ঠাকুরের নাম স্মরণ করছিলাম; এই বোধহয় জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। জলের ধারায় খাদের দিকের রাস্তার শুধু উপরের অংশই আছে নিচ ফাঁকা। রাস্তার উপরে বহমান জলস্রোতে যেকোনো সময় চাকা পিছলে গাড়ি খাদে চলে যেতে পারে। এই অবস্থায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে কোনোক্রমে এই বিপদজনক স্থান পেরিয়ে এলাম আমরা। সবগুলো গাড়ি একই অবস্থায় আস্তে আস্তে বেরোচ্ছে। এই রাস্তায় দক্ষ চালকের কেন প্রয়োজন, সেটা বুঝতে পারলাম।
চরৈবেতি ! আবার এগিয়ে চলা। লোংসুলুংয টোল গেট পেরিয়ে এলাম – শুনশান টোল গেট , লোকজন নেই। ধরে নিলাম এবার বোধহয় বিপদ পেরিয়ে এসেছি। প্রায় পাঁচ- ছয় কিলোমিটার এগিয়ে আবার বিপত্তি। সবগুলো গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে পড়ল. রাত তখন প্রায় তিনটা। অঝোর ধারায় বৃষ্টি, মেঘালয়ে এর আগেও বেশ কয়েকবার বর্ষা ঋতুতে ভ্রমণ করেছি, কিন্তু এমন বৃষ্টি আমি জীবনে দেখিনি। উত্তরাখণ্ডে বাদল ফেটে যাওয়ার ঘটনা খবরের কাগজে পড়েছিলাম, এ যেন তেমনই। ধীরে ধীরে সকাল হচ্ছে, আমরা ঘন জঙ্গলের পাশে গাড়িতে বসে। একজন দুজন করে গাড়ী থেকে নামছে, কেউ ছাতা নিয়ে কেউবা মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে জঙ্গলের ভেতরে যাচ্ছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হবে তো। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে মা, বোনেদের অবস্থা চিন্তা করুন। বরাকের জনগণের এমন দুর্গতির জন্য শুধু কি প্রকৃতির রুদ্র রোষ দায়ী !
সকাল প্রায় আটটা নাগাদ ধ্বস, উপরে পড়া গাছ সরিয়ে রাস্তা আবার চলাচলের উপযোগী করে দিল মেঘালয় প্রশাসন। এবার আর বড় ধরনের বিপর্যয় নেই, ধ্বস প্রবণ এলাকা মোটামুটি পেরিয়ে এসেছি। লাড্রিমবাই পৌঁছলাম সকাল ১০ টা নাগাদ; প্রচন্ড খিদে থাকলেও হালকা কিছু খেয়ে নিলাম, কারন ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে গিয়ে না ‘প্রকৃতির বড় ডাক’ পেয়ে যায়।
প্রায় ৩০ ঘন্টা শারীরিক এবং মানসিক ধকল সয়ে বিকেলে গুয়াহাটি এসে পৌঁছলাম, এক জেলা সদর থেকে রাজধানীতে আসার এমন অভিজ্ঞতা মনের মনিকোঠায় চিরদিন অম্লান থাকবে ।
Comments are closed.