মালেগড় । এক অবহেলিত রণভূমি । এক রক্তমাখা অধ্যায় । স্বর্ণাক্ষরে লিখে থাকার পরিবর্তে উপক্ষিত ইতিহাসে । আলো পড়েনি সেখানে- দেশ মাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে মহাবিদ্রোহের শহীদের স্মৃতিতে আছে নামমাত্র সমাধি । এপারে লঙ্গাই ওপারে সোনাই নদীর তীরে ভারত বাংলা আন্তর্জাতিক সীমান্তে নীরবে নিভৃতে শায়িত ২৬ বীর শহীদ । স্বাধীনতা লাভের একাত্তর বছর পূর্ত্তিতেও কিন্তু কেন্দ্র, রাজ্য সরকারের কাছের চির অবহেলিত ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমি এই লাতু মালেগড় ।
মহাবিদ্রোহের ১৬১ বছর – দেশ স্বাধীন হওয়ার একাত্তর বছর কিন্তু কম কথা নয় । কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সরকার বদল হলে এখানকার মানুষের মনে আশার আলো জেগেছিল হয়তো এখন ভারত মাতার ২৬ বীর শহীদ সন্তানদের পূর্ণ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ মিলবে, নতুন সাজে সেজে উঠবে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী শহীদভূমি, জেগে উঠবে চির অবহেলিত পুণ্য ভূমি কিন্তু সেই আশার গুঁড়ে বালি । আলোহীন সমাধির নিস্তব্ধতায় থাকা এই মালেগড়ে হবে গবেষণা কেন্দ্র, স্থান পাবে পর্যটনের মানচিত্রে এই আশা ছিল অধিকাংশের । তবে বাস্তব চিত্র তার পুরো উল্টো । ৭২তম স্বাধীনতা দিবস দেশজুড়ে আড়ম্বরপূর্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হলেও বীর শহীদদের বুকের তাজা রক্তে ভেজা এই মাটি আজও আগাছায় পরিপূর্ণ । সিপাহী বিদ্রোহের আঁচড় লাগা বরাক উপত্যকার মালেগড় টিলায় শহীদের এই মাটিতে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কোন শ্রদ্ধাঞ্জলী বা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজন বোধ করেননি জেলা প্রশাসন । মাতৃভূমির অখন্ডতা, স্বাধীনতা, ঐতিহ্য এবং সংহতির রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে অসীম সাহস এবং ত্যাগে পরাধীনতার শেকল ছেড়ে স্বাধীনতার গৌরবধ্বজ উঠাতে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে প্রাণ ত্যাগকারী শহিদ এবং বীর সেনানিরা আজ সরকারের কাছে ব্রাত্য ।
দিনটা ছিল ১৮৫৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর । শীতের সকাল, সম্পূর্ণ কুয়াশাচ্ছন্ন, বন্য পাখির কিচিরমিচির শব্দে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে পৃথিবী । পাশে ধীর গতিতে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে লঙ্গাই নদী । দিনটা রবিবার বলেই লাতুর বাজার তখনও কিন্তু তেমনটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেনি । দুই একজন কৃষক হালচাষের জন্য ধানক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়েছে সবেমাত্র । লাতু মালেগড়ের পূর্ব প্রান্তে কুয়াশায় ঢাকা আকাশে যখন সূর্যোদয় হচ্ছিল ঠিক তখনই সূর্যের লাল রঙের সঙ্গে ২৬ বীর শহীদের রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে মালেগড় টিলার ঘাস ভেজা সবুজ মাটিতে ঝরে পড়লো । ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহের যে রক্তমাখা অধ্যায় সেই অধ্যায়ের সঙ্গে মালেগড় সহ বরাক উপত্যকা জুড়ে আছে। সেই অধ্যায়টির প্রসঙ্গ আজও সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত । মালেগড়ের শহিদ দের আত্মবলিদানের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকার পরিবর্তে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসে স্মারকস্থলটি চরম অবহেলিত ।
জাতপাতকে দূরে রেখে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন মালেগড় । ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন । যার সূচনা ১৮৫৭ সালের ২৯ শে মার্চ ব্যারাকপুরে । বীর সিপাহী মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে । বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলস । উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্য ভারত গর্জে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে । দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিয়োজিত থাকা দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে । বিদ্রোহের ঢেউ আঁচড়ে পড়ে তখনকার চট্রগ্রাম ( বর্তমান বাংলাদেশ) বন্দরে । চট্রগ্রাম বন্দরে তখন নিয়োজিত ৩৪ নেটিভ ইনফেন্ট্রি । ব্যারাকে অবস্থানরত ছিল তিন শতাধিক সিপাহী । ১৮ নভেম্বর দেশীয় সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে প্রথম পদক্ষেপে বীর সিপাহীরা চট্রগ্রাম কালেক্টর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে জেলবন্দী দের মুক্ত করেন । কোষাগার থেকে লুঠ করেন ২,৭৮,২৬৭ টাকা সহ তিনটি হাতি, অস্ত্রসস্ত্র, গোলা বারুদ । কুমিল্লা হয়ে সিপাহীরা পৌঁছায় ত্রিপুরা রাজ্যে । ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্রেনটির ত্রিপুরায় অবস্থান কালে ব্রিটিশের কাছে সে খবর পৌঁছে দেয় রাজদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক । দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে দেশীয় বিদ্রোহী পদাতিক বাহিনী অবস্থান করে লঙ্গাই নদীর তীরের উঁচু টিলায় । এদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল যে, বিদ্রোহীরা প্রতাপগড়ের (পাথারকান্দি) গভীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়ে আছেন । সেই হিসাবে সৈন্য সামন্ত নিয়ে সিলেট থেকে ৩৬ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ১৭ ডিসেম্বর বিকালে এসে প্রতাপগড়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন ব্রিটিশ মেজর বিং । ব্রিটিশ গুপ্তচর দ্বারা ব্রিটিশ মেজরের কাছে খবর পৌঁছায় যে বিদ্রোহী সিপাহীরা ২৮ মাইল উত্তরে থাকা লাতু এলাকায় স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে নতুন ঠিকানায় আছেন । খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে ১৮ ডিসেম্বর ভোরে সেখানে গিয়ে পৌঁছয় মেজর বিং নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী । সঠিক ভাবে অবস্থান নেওয়ার আগেই ব্রিটিশ বাহিনীর উপরে বীর বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন দেশীয় সিপাহীরা । চার জন ইংরেজ অনুগত সেনার পাশাপাশি যুদ্ধে নিহত হন মেজর বিং ।
মালেগড়ের পবিত্র মাটিতে শহীদ হন ২৬ বীর দেশীয় সিপাহী । এদের মধ্যে জনাকয়েকের নাম জানা গেলেও বাকি তথ্য আজও অজ্ঞাত । দেশীয় সিপাহীদের সমাধিস্থ করা হয় মালেগড় টিলায় । ভয়ে আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে উঠে তখন সুরমা উপত্যকা । নিঃশব্দে নিস্তব্ধ হয়ে উঠে লাতু এলাকা । আত্মগোপন করে থাকা কোন বিদ্রোহীকে আশ্রয় বা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে, গ্রামের মানুষদের এমন ভয় দেখাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । হ্যাঁ, এটাই রক্তে রাঙানো ১৮ ডিসেম্বর ১৮৫৭ সাল- ভারত বাংলার আন্তর্জাতিক সীমান্তে লাতু গ্রামে । সেসময় অবিভক্ত শ্রীহট্ট জেলার (সিলেট) ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল লাতু । কাছাড় এবং শ্রীহট্ট জেলার সীমায় থাকা লাতুর কাছে মালেগড়ের নিচ দিয়েই বয়ে গেছে লঙ্গাই নদী, ওপারে গিয়ে নামধারণ করেছে সোনাই । লাতু বাজারের কাছেই সেই লঙ্গাই নদী । আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেই ইতিহাতিক টিলা । তখনকার জমিদার উঁচু টিলায় গড় বানিয়ে মাল মজুত রাখতেন আর বিদ্রোহী সিপাহীরা কোষাগার লুঠ করে এনে এখানেই ধন সম্পদ মজুত করে রেখেছিলেন । সেই মালঘর থেকেই মালেগড়ের নামকরণ ।
ব্রিটিশ সরকারের বহু তথ্যে মালেগড় রনের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও অসমের ইতিহাসে মালেগড়ের যুদ্ধের অধ্যায়ের কথা উল্লেখ নেই । বরাক উপত্যকার সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব সম্পর্কে আবার অনেকে গবেষণা করেছেন । লোক কথা এবং জঙ্গিয়ার গীত খ্যাত লোক গীতিতে বিদ্রোহের প্রভাব বর্ননা করা হয়েছে । বিদ্রোহের সময় কাছাড় জেলার পুলিশ অধীক্ষক হিসাবে কর্মরত থাকা রবার্ট স্ট্রিয়ার্টৈর চিঠি পত্র অনুসন্ধান করে সুদীপ চৌধুরীর সংকলন করা ‘দ্যা মিউটিনি পিরিয়ড ইন কাছাড়’ গ্রন্থ হচ্ছে প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য দলিল । তবে কিভাবে এবং সঠিক কোথায় যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ বাহিনীর সেনাদের সমাধি দেওয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য আজও জানা যায়নি । এখানকার বয়জ্যেষ্ঠ নাগরিক প্রয়াত আব্দুল মুকিত চৌধুরীর কাছ থেকে জানা গেছে যে মালেগড় টিলায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল দেশীয় সেনাদের । মালেগড় টিলায় খনন কার্যের সময়ে তিনি উদ্ধার করেছিলেন যুদ্ধে ব্যবহৃত পিস্তল, লোহার গোলা । সেখানে উদ্ধার করা হয়েছিল বুট জুতো সহ দুইখানা তরোয়াল ।
Sudip Das is a senior journalist from Barak Valley.
Comments are closed.