হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো: স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বেলুনওয়ালা
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। উপমাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত টান রয়েছে। রিনিঝিনি স্বরে একটা মিষ্টি সুর রয়েছে। ভালোলাগার ছোঁয়া আছে। আর আছে কল্পনার ঘেরাটোপ। আরও অনেক উপমাই ব্যবহৃত হতে পারত। এমনকি এ উপমা হয়ত আগেও ব্যবহৃত হয়েছে, তবু এটাই পছন্দ, কারণ আমার মত হাজার শিশুমনের রঙিন স্বপ্নগুলো বড় যত্ন করে ফেরি করে বেড়িয়েছে যে লোকটা তাকে আর কি বলা উচিৎ? শুধু লাল হলুদ, সবুজ বেলুন বিক্রি করে কেউ সবার মনে কয়েক যুগ ধরে এমন এক ভালোবাসার স্থান দখল করতে পারে তা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। এতক্ষণে সবাই বুঝে নিয়েছেন, কাকে নিয়ে এত উপমার ঘনঘটা।আমাদের সবার প্রিয় সেই বেলুনওয়ালা। যার কাছ থেকে ছোটবেলায় বেলুন কেনার জন্য আমরা পাগল থাকতাম।
বিচিত্র সুরে আর ভিন্ন ভিন্ন স্বরে যখন সেই ফেরিওয়ালা বেলুন বিক্রির ফন্দি আটত তখন বাচ্চাদের ঘরে থাকার জো ছিল?”বেলুনওয়ালা এসছে” বলে দে ছুট্। এক দৌড়ে বেলুনওয়ালার কাছে হাজির।পেছন থেকে মায়ের ডাকও কানে পৌঁছোত না।এতটাই আকর্ষণ ছিল সেই বিচিত্র সুরে।কতবার বেলুন কিনব না জেনেও খালি পায়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেছি।খুব সম্ভব সবাই ওকে বেলুনওয়ালাই ডাকত।বেলুনওয়ালার আবার নাম কি? অনেক অনেক পরে এই সেদিন যখন ওর নাম “লক্ষী নাথ” বলে জেনেছি তখন নামের মধ্যে যেন অচেনা ভাব ছিল, কেমন একটা পর পর ভাব।তার চাইতে অনেক আপন লাগে কিংবা আন্তরিকতা ছুঁয়ে যায় ‘বেলুনওয়ালা’শব্দ উচ্চারণে।আসলে ওর নামের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক ছিল ওর বিচিত্র স্বরের সঙ্গে, শিস্ দিয়ে গাওয়া ওর গানের সঙ্গে, ওর লাল নীল হলুদ বেলুনের সঙ্গে।তাই আমার মত অনেকের কাছেই তাঁর পরিচয়, সে আমাদের ছোট বেলার সেই বেলুনওয়ালা।আসলে বেলুনের সঙ্গে সঙ্গে এক রাশ ভাললাগাও উপহার হিসেবে থাকত বাচ্চাদের জন্য।
ক্লান্ত দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে পাড়ার মোড়ে ভেসে আসা “ভুবন পাহাড়ের ময়না রে বাপ রে বাপ,ময়না কথা তো কয়না বাপ রে বাপ ,ও দাঁত ভাঙা বুড়ি খায় কড়াই মুড়ি বাপ রে বাপ…….” কথাগুলো কি প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করেই মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়না আজও। আজও কি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আমাদের সেই অতি প্রিয় আর অতি পরিচিত বেলুনওয়ালার ফটো দেখে সন্তর্পণে পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করে না শৈশবের সেই রঙিন দিনগুলোতে?বেলুনওয়ালার ওই বিচিত্র শিসের সুরটা যেন আজও কানে বাজে। মেয়েকে বেলুন কিনে দিতে গিয়ে কতবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বেলুনওয়ালার বেলুন দিয়ে বানানো কত লাল হলুদ সবুজ নীল পাখি আর জন্তু।
আমার সঙ্গে আশা করি অনেকেই একমত হবেন, বেলুনওয়ালার গলার স্বরে কিংবা বিচিত্র সুরে যেমন ছিল তীব্র টান তেমনি কাঁধের ঝোলাটা ছিল বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কতভাবে জানতে চাইতাম কিংবা চাক্ষুস দেখতে চাইতাম ওই ঝোলাতে কি আছে। মুচকি হেসে চোখ বড় করে ইশারায় বুঝিয়ে দিত এতে না জানি কত ধন লুকিয়ে আছে! আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠত জানার আগ্রহটা। ভেতরে লাল নীল হলুদ বেলুনই হবে জেনেও মন আরও কিছু খুঁজে বেড়াত ঐ ব্যাগের ভেতরে। আসলে আমাদের ছোটবেলার স্বপ্নে ঢাসা ছিল বেলুনওয়ালা তোমার ওই ব্যাগটা। আর আমাদের ওই স্বপ্নগুলো ফেরি করে ফিরতে বলেই তো আজও তুমি আমাদেরই একজন হয়ে রয়ে গেছ।আজও যখন কোনও এক মন কেমন করা বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় মন ছুটে যায় শৈশবের দিনগুলোতে মন ভালো করার কারণ কুড়োতে,তখন সে কারণে তুমিও ভাগীদার হও।
যুগ চলে গেলেও আজও বেলুনওয়ালা আমাদের মনে, আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাইতো বেলুনওয়ালাকে নিয়ে গান বাঁধে গানের ব্যাণ্ড (দলছুট)। ইউ টিউবে সে গান আপলোড করে নিজেদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আসলে বেলুনওয়ালা আজও বেঁচে আছে আমাদের মনের গভীরে,আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের ভালোলাগায় আর আমাদের ভালোবাসায়। এভাবেই আমরা বাঁচিয়ে রাখব তাঁকে আমাদের চিন্তায়, আমাদের লেখায়, আমাদের গানে, আর আমাদের হৃদয়ে।
Comments are closed.