পরাবাস্তবতার ফাঁদে আটকে পড়া বিপন্ন সময়ের এক খন্ডচিত্র
বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা নেই। তবুও হয়তো কোনো জায়গা সম্পর্কে জানার আগ্রহ হল বলে একটু গুগল সার্চ করে দেখা। ব্যাস, হয়ে গেল, – এরপর থেকে ইন্টারনেটে ফেসবুক বা অন্য যা কিছু খোলা হোক না কেন, ফ্লাইট, রিসর্ট বা সেই জায়গা সম্পর্কিত নানা তথ্য একের পর এক ভেসে আসতে থাকবে। ফোনে মেসেজ বা ইমেইলও চলে আসে কখনো কখনো।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। মাঝেমধ্যে চমকে উঠেছি, আমাদের ইমেইল আইডি বা ফোন নাম্বার এইসব কোম্পানির কাছে পৌঁছে যায় কিভাবে?
পছন্দের নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড় বা অন্য তারকাদের বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি স্যোশাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে বারবার করে ঘুরে ফিরে আসাতে আমরা এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এমনকি কারো সঙ্গে নতুন পরিচয় হবার পর ফোন নাম্বার সেভ করা মাত্রই ফেসবুকে ফ্রেন্ড সাজেসন চলে আসার বিষয়টাও নিশ্চয়ই অনেকেই লক্ষ্য করেছি। আমাদের অনেকেই হয়তো এতদিনে জেনে গেছি এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা এ আই। আমাদের আন্তর্জালের প্রতিটি মুহূর্ত যার নজরবন্দি। এই আন্তর্জালের বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন এবং স্যোশাল মিডিয়া যে সমস্ত অংকের উপর এগিয়ে চলে তার মধ্যে সর্বপ্রধান হল আ্যালগরিদম।
এই অ্যালগোরিদম কিভাবে আমাদের আজকের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে,তাই নিয়েই এবার রূপমের মঞ্চে বিবর্তন হাইলাকান্দির উপস্থাপনা ছিল নাটক ‘অসুখের উৎসব’।
নাটকের মূল চরিত্র সোনুর রোল মডেল তার প্রিয় কমিক্স এবং গেমের চরিত্র অভিযাত্রী লারা জোন্স যে কিনা সারা দুনিয়ায় স্কুটি চালিয়ে ঘুরে বেড়াত। লারার মতোই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে সোনু। স্বপ্ন দেখে ওর মত পৃথিবী ঘোরার। কিন্তু সংসারের হাল ধরতে একটি অনলাইন ফুড ডেলিভারী অ্যাপ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে স্কুটি করে অর্ডার সরবরাহ করে চলে সে।
অবসরপ্রাপ্ত বাবা ও মা ছাড়াও বাড়িতে রয়েছে দুবছর ধরে হুইলচেয়ারে বন্দি ছোটবোন ঈশা। রোজ সকালে কাজে বের হবার আগে তার সাথে খুনসুটি করে যায় দিদি সোনু। বোনের কান মুলে দিয়ে গেলে নাকি একের পর এক অর্ডার আসতেই থাকে। বোন অবশ্য তাকে বোঝায় এই অর্ডার আসার পুরোটাই নির্ভর করে অ্যালগোরিদমের উপর। অ্যালগোরিদম নিয়ে নিজের লেখা গান গেয়ে শোনায় সে দিদিকে। আর সেই গানের সূত্রেই মঞ্চে ঢুকে পড়ে এক ঝাঁক অ্যালগোরিদম। দুই বোনের পরাবাস্তবতার জগতের আসল নিয়ন্ত্রক যারা, সেই সব অ্যালগোরিদম।
বাড়িতে আছেন সারা জীবন ট্রেড ইউনিয়ন করে আসা তাদের বাবা। তিনি সোনুর কাছে জানতে চান, সে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে কিনা। সোনু জানায় এখনকার সময় পাল্টে গেছে। এখন অনলাইনে একটা বোতাম টিপেই চাকরি পাওয়া যায় এবং কারোর কাছে মাথা না ঝুঁকিয়ে নিজের কাজ করে যাওয়া যায়। অবশ্য টার্মস ও কন্ডিশন না পড়েই সেই বাটনে ক্লিক করে চাকরিতে জয়েন করে গেছে বলেও সে স্বীকার করে। সোনুর মা, বাবা -মেয়ের তর্কের ইতি টেনে দেন মধ্যস্থতা করে। সেদিন ঈশার জন্মদিন হওয়ায় আটটার মধ্যে কাজ শেষ করে কেক নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে মাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যায় সোনু।
অ্যাপের সেই চাকরির শর্তপূরণ যতটা সহজ ভেবেছিল সোনু আসলেও কি ততটাই সহজ! অর্ডার ডেলিভারি করার মুহূর্তে অ্যাপ আপডেট করতে গিয়ে কি নতুন নিয়মকানুন পড়ে অ্যাকসেপ্ট করার সময় বা ধৈর্য থাকে! নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে টার্গেট ফুলফিল করলেও কি রেটিংয়ের খেলায় পিছিয়ে পড়ে না কেউ! বাবার বলা ট্রেন্ড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা উড়িয়ে দিলেও ওর সহকর্মীদের মধ্যেও কেন শোনা যায় সংগঠন গড়ে তোলার কথা?
দিনের শেষ ডেলিভারি করতে গিয়ে সোনু মুখোমুখি হয় এক রূঢ় বাস্তবের। সামাজিক ভাবে একা হয়ে যাওয়া এক অসুস্থ তরুণের স্যোসাল মিডিয়া নির্ভর জীবন ও তার সঙ্গে ঘটা অ্যালগোরিদমের প্রভাবের নির্মম নিষ্ঠুরতা সোনুকে বিপর্যস্ত করে তোলে। মানবিক মূল্যবোধ থেকে সে ছেলেটিকে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে আ্যালগরিদমের খেলায় সে বিভ্রান্ত হয়ে বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে এ আই সিস্টেমের উপর। কিন্তু এই জাল কেটে কি সে বেড়িয়ে আসতে পারবে? ছোট বোনের জন্মদিনের কেক নিয়ে ফেরার সময় যে পেরিয়ে গেছে। এই জায়গায় এসে নাট্যকার পরাবাস্তবতায় ভরা অ্যালগোরিদমদের সেই চক্রব্যুহের মধ্যে ছেড়ে দেন সোনু, নীলাভ, সোনুর জন্য অপেক্ষারত বাবা মা এবং – ঈশা সকলকেই। বিপন্ন সময়ের একটি স্থির চিত্র হয়ে ওঠে পরাবাস্তবতার শিকার সেই জটিল মুহূর্তটি।
রূপমের মঞ্চে এই নাটক উপস্থাপিত হবার কদিন আগেই ভারতের এক নাম্বার ফুড ভেলিভারি কোম্পানির কর্মচারীদের স্ট্রাইকের খবর এসেছে হেডলাইনে। নাটকটি প্রথমবার পৌষ পার্বণে মঞ্চস্থ হবার পর সেই খবর কাগজে ও স্যোশাল মিডিয়াতেও দেখতে পাওয়া গেছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের নজরদারি থেকে শুরু করে অ্যালগোরিদমের যান্ত্রিক খেলার পরিণাম, রেটিংয়ের সুতোয় ঝোলা কর্মচারীদের অস্তিত্ব, বাবা মায়ের দূরে চলে যাওয়ায় সন্তানের একাকিত্বের অসহায়তা, স্যোশাল মিডিয়া নির্ভর ভার্চুয়াল জগতের একাকিত্ব-সবকটা সমস্যাকে এক চালা কাঠামোয় কোনো বাড়তি বক্তব্য ছাড়াই নিপুণ ভাবে টানটান করে গেঁথেছেন নাট্যকার ইন্দ্রনীল দে। শ্রেষ্ঠ পান্ডুলিপির বিবেচনায় প্রথম হওয়া তাঁরই ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’কে কঠিন চ্যালেঞ্জে জানায় এই নাটকের পান্ডুলিপিই। ইন্দ্রনীলের প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্রনীল।
অভিনয়ের ক্ষেত্রেও প্রতিটি চরিত্র নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করে করে তুলেছে। আজকের প্রজন্ম বা বিবর্তনের নাটকে কোরাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোথাও কোথাও ওরাই মূল চরিত্র হয়ে ওঠে। অসুখের উৎসবেও আ্যালগরিদম চরিত্রে কোরাস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকের গতিকে টেনে নিয়ে গেছে। সোনুর আত্মবিশ্বাস, বিষ্ময়, অবিশ্বাস আর অসহায়তার দ্বিধার নিখুঁত প্রতিফলন ঘটিয়েছেন শ্বেতা দাস। নীলাভর একাকিত্ব, অসুস্থতা ও বন্ধু পাবার আকাঙ্খায় ‘জন্মদিন পাতানো’ দর্শকদের বিষন্ন করেছে। তার অসুস্থতাকে উৎসবের রূপ দেওয়া আ্যালগরিদমের খেলায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন দর্শকরাও। বাবা মায়ের চরিত্রে অরিত্র ধর ও মধুমিতা সাহা পুরোপুরি মানানসই ছিলেন। সহকর্মী বন্ধু রণির চরিত্রে পার্থ পাল নিজের ভূমিকা যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছেন। কোরাসের চরিত্রে সপ্তদীপ বিশ্বাস, শুভ্রা দাস, রিয়া দেব, রত্নজয় নাথ, শালিনী মিশ্র এবং মাধুর্য চৌধুরীও প্রশংসার দাবি রাখেন।
নাটকেটতে যারা অভিনয় করেছেন তাদের সবাই কমবয়সী তরুণ তরুণী কিংবা সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা কিশোর কিশোরী। তাদের নিজেদের সময় ও সমস্যাকে তাই অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপনা করেছেন তারা। আন্তর্জালের জগতের যান্ত্রিক যাপন কিভাবে আমদের সংবেদনশীলতা কেড়ে নিয়ে অমানবিক করে তুলছে, ট্রোলিংয়ের নিষ্ঠুরতাকে উৎসবে পরিনত করছে, তারও বাস্তব প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে এই নাটকটিতে।
ঈশার চরিত্রায়নের জন্য শুকতারা সংকল্প দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সহ অভিনেত্রীর পুরষ্কার এবং নীলাভর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অনির্বাণ রায় বিশেষ পুরষ্কার পেয়েছেন। কিন্তু পুরো টিমের পারফরম্যান্স ও টিমওয়ার্ককে অভিনন্দন জানাতে হয় এমন একটি সময়োপযোগী নাটক দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করার জন্য। ইন্দ্রনীল দে এবং সায়ন বিশ্বাস জুটির কাছে দর্শকদের চাহিদাও দিনদিন বেড়েই চলেছে।
নাটক – অসুখের উৎসব
নির্দেশক – সপ্তদীপ বিশ্বাস
পান্ডুলিপি – ইন্দ্রনীল দে
প্রজোজনা – বিবর্তন, হাইলাকান্দি
আলোকসজ্জা – রূপরাজ দেব
Comments are closed.