Also read in

চেতনায় সজীব: আমার উনিশ, আমার একুশ

একুশে ফেব্রুয়ারি! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আসলে “আমারই ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি”। সৌভাগ্যের বিষয়, দিবসটি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে মাতৃভাষায় কথা বলার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কিন্তু আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু বিষয় নিয়ে মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়। প্রশ্নগুলো নিয়ে শিলচরের কয়েকজন ব্যক্তিত্বের কাছে পৌঁছে ছিলাম তাদের মতামত জানতে। প্রশ্নগুলো ছিল:

যেভাবে সবাই ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করতেই ইচ্ছুক, তাতে কি বাংলা ভাষা আজ সত্যি বিপন্ন?

বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কি উনিশ এবং একুশেই সীমাবদ্ধ?

একুশ যেভাবে সারা বিশ্বজুড়ে এবং ভারতবর্ষে উদযাপিত হয়, সেই উৎসাহ আর শ্রদ্ধায় উনিশও সারা বিশ্বে তথা বাংলাদেশে উদযাপিত হওয়া উচিত নয়? তা হচ্ছে কি?

আজকের এই সংকটময় সময়ে একুশের ইতিহাস কিভাবে বাঙালিকে সমৃদ্ধ করতে পারে বা পথ দেখাতে পারে?

বাংলা ভাষায় লিখিত ভালো লেখাগুলো পড়ার জন্য আগামীতে এ প্রজন্ম কিংবা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুবাদের আশায় বসতে হবে|। কথাটা মানেন?

বাংলা ভাষায় নেমে আসা এসব সংকট থেকে উদ্ধারের পথ কি?

একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে নিয়ে বিশেষ ভাবে কিছু বলতে চাইবেন?

কোন ভাষা শিক্ষা কোনভাবেই নিন্দনীয় নয়। বরং প্রশংসনীয়। এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।অনস্বীকার্য। কিন্তু কোনোভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়! ইংরেজি জানার মধ্যে অহেতুক অহংকার এবং বাংলা জানা কিংবা বাংলায় কথা বললে অন্যের তাচ্ছিল্য ভাব দেখানো আমাদের জন্য কি বিপদজনক নয়? শুধু বাংলা ভাষারই উল্লেখ করা হয়েছে এখানে, কারণ আমরা আমাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখাটি বরাক উপত্যকায় সীমাবদ্ধ রেখেছি। তবে আজ যেভাবে সব আঞ্চলিক ভাষা উপেক্ষিত হচ্ছে, তা নিয়ে কি আমাদের ভাববার সময় আসেনি? নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে, যত্ন না করলে, লালন না করলে আমাদের অস্তিত্বই কি সংকটের মুখে নয়?

একুশকে নিয়ে যখন কথা বলি তখন উনিশ অবলীলায় সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ উনিশতো আমাদের গর্ব। আমাদের অভিমান। আমাদের অহংকার। আমাদের অস্তিত্বের আধার। একুশ আর উনিশ যেন আমাদের দুই চোখের দুই তারা।

এই প্রশ্নগুলো নিয়ে শিলচরের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বরা কি ভাবছেন?

( সাক্ষাৎকারের জন্য ব্যক্তিত্ব নির্বাচনে কোন প্রথা বা নিয়ম মানা হয়নি)

রাজীব ক‍র

রাজীব ক‍র
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা শহিদ স্টেশন রূপায়ন কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা

না, আমি সেটা মনে করি না। বিপন্ন ব্যাপারটা আমি মনে করি না একটা কারণে, পৃথিবী যেভাবে এগোচ্ছে, আমরা তো গতিশীল এবং গতির প্রতি সম্মানজনক অবস্থায় না দাঁড়ালে শিক্ষার গ্যাপ, জেনারেশন গ্যাপ তো বটেই, বড় ব্যবধান তৈরি হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তত্ব, তথ্য যা কিছু আছে সবই যদি আমাকে আরোহন করতে হয়, জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়, পড়াশোনা করতে হয়, শিখতে হয় আমার সন্তানদের, ইংলিশ কিংবা এই বিষয়ের দরকার আছে। এতে বাংলা বা কোন মাতৃভাষা বিপন্ন হতে পারে না যদি তার বাবা-মা দায়িত্বশীল হয় অর্থাৎ সন্তানের প্রতি যত্নশীল হয় ।

হ্যাঁ, এটা একটা সমস্যা যে বাংলা বিষয় হিসাবে না থাকলে কিভাবে করবে? তবে ইংলিশ মাধ্যমে পড়াশোনা করার জন্য এটা হচ্ছে, সেটা আমি মনে করি না। এই বিষয়টা পারিবারিক সভ্যতার এক ক্রম পরিবর্তন। যে মানুষটা নিজের ভাষাকে সম্মান করে না, শুধুমাত্র উচ্চাকাঙ্খার জন্য সেই ভাষাটাকে নিজের সন্তান থেকে দূরে রাখে, এর জন্য নিশ্চিতভাবে তার পরিবারই দায়ী। আমি যে কোনও ভাষাভাষীর সম্বন্ধে কথাগুলো বলছি। শুধু বাংলা ভাষা না, যে কোনও মাতৃভাষা।

একটা পরব যেমন নববর্ষ বা বিজয়া দশমীকে মাথায় রেখেই তো আমাদের প্রচলিত শৃঙ্খলা তৈরি হয়। কেউ কেউ নববর্ষে বা বিজয়া দশমীতে গুরুজনদের প্রণাম করেন। কিন্তু সারা বছর তো করেন না। তবু ভেতরে ভেতরে সবারইতো গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। একুশ এবং উনিশ দুটোই মাতৃভাষা শহিদ দিবস। এটা শুধু বাংলা ভাষা শহিদ দিবস বলে আমি মনে করি না। আসাম সরকারের ভাষা আইনের বিরুদ্ধে এই ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর সমর্থন ছিল। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি নন্দকিশোর সিংহ বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন; হিন্দি ভাষী দ্বারকানাথ তেওয়ারি উনিশের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন। শুধু বাংলা নিয়ে ভাবলে এক ধরনের আধিপত্যবাদ হয়ে যায়। আমি ভালবাসি বাংলা, আমি ভালোবাসি বিশ্ব জনের মাতৃভাষা।

হ্যাঁ, এটা মেনে নিতে হচ্ছে, নেপালি ভাষার একটি কবিতা নেপালের সেই ছেলেটা আর জীবনে পড়তে পারবে না, কারণ সে তো নেপালি জানে না। ভালোবাসো, অধ্যায়ন করো, স্মরণ রাখ এই তিনটি শব্দই মূল্যবান। এটা খেয়াল না রাখলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত হবে না।

উনিশ সর্বত্র ছড়িয়ে যাক।
স্বপ্ন দেখছি বলেই এই লড়াইটা, শহিদের নামে স্টেশনের নামকরণ করলেই অর্থনীতির উন্নয়ন, বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে না। কিন্তু সরকার সম্মান করলে আমাদের পৌঁছানোর জায়গাটা, মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জায়গাটা শক্তিশালী হবে। এতদিন ধরে লড়াই চলছে আমাদের পক্ষে, বিভিন্ন তরফ থেকে প্রয়াস চলছে। এই প্রথম সরকার ঘোষণা করল স্মারক তৈরি করবে। এতদিন পরে সরকার এদেরকে শহিদ বলে মেনে নিল, এরা আমাদের আত্মপরিচয়, এটারই স্বীকৃতি মিলল।
বিগত ছয় তারিখে ভাষা শহিদদের স্বীকৃতি প্রদান করে যে ঘোষণা আসাম সরকার করেছে, তার জন্য আমি সরকারকে কুর্নিশ জানাই। আমরা বিশ্বাস করি যে, খুবই কম সময়ের মধ্যে ভাষা শহিদ স্টেশনের ব্যাপারেও স্বীকৃতি মিলবে।
পরিশেষে বলব, একুশের জায়গাটা হচ্ছে উত্তরণের পথ। একুশ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ। একুশের কথা বলতে গিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের পক্ষ থেকে বলছি, মানবিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হোক। বছরে একদিন একুশ নয়, বছরে একদিন উনিশ নয়। উনিশ প্রতিদিন।

 

দীপক সেনগুপ্ত, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

দীপক সেনগুপ্ত

অস্বীকার করার উপায় নেই ইংরেজি মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করছে, তবে শুধু বাংলা নয় সব ভারতীয় এমনকি উপমহাদেশের ভাষাকেই বিপন্ন করছে। সমান্তরাল ভাবে সামাজিক মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত যোগাযোগের ভাষার আমদানি হচ্ছে যা ইংরেজি ভাষাকেই বিপন্ন করছে,যেমন you হয়ে গেছে u কিংবা great হয়ে গেছে Gr8 . আমরা ক্রমশ ভাষাহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

উনিশ এবং একুশের মধ্যে পার্থক্যকে মেনে নিতেই হবে, উনিশ আবেগিক স্তরে থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ অন্যদিকে একুশের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। উনিশ একটা রাজ্যের জন্মদিতে পারলনা একুশ একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম দিল। এবং সেই রাষ্ট্রে প্রতি নিয়ত ভাষা চর্চা হয়। বাংলাদেশে ইউনিকোড কম্পিউটার ভাষার জন্মদিল, এখন বাংলা সার্চ ইঞ্জিন তৈরির প্রস্তুতি চলছে। উনিশ এবং একুশের যাত্রার অভিমুখ এক হলেও বাস্তবিক অনেক যোজন দূরে একের থেকে অন্যের অবস্থান।

উনিশ কলকাতা সহ বাংলাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়, কিন্তু উনিশ এবং একুশকে এককরে ভাবতে যাওয়া উচিত নয়। এতে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের প্রতি অন্যায় বিচার করা হবে।

আজকের এই সংকটময় মূহুর্তে একুশ স্মরণের তাৎপর্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিমুখে ঠেলে দিতে একুশে স্মরণ খুব প্রয়োজন।

শেষ প্রশ্নের উত্তরে বলব,
কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা গুরুত্ব হারালেও সৃজনশীল সাহিত্যপাঠের অনুরাগী মন কিন্তু কমবে না। জীবনধারার সাথে সম্পর্ক রেখে ইতিমধ্যে অণুগল্প জনপ্রিয় হয়েছে। সময় কোথাও থমকে দাঁড়ায় না, মৈথেলী ভাষার বুক থেকে বাংলা বেরিয়ে এসেছে কোন এক সন্ধিক্ষণে বাংলার বুক থেকে আরো কোন এক নূতন ভাষা বেরিয়ে আসবে সময়ের দাবি মেনে।

বাপী দত্ত রায়, লেখক, গীতিকার

বাপী দত্ত রায়

২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষা হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। ১৯ শে মে’র পরও কেন আজ বরাকে মাতৃভাষা বাংলা শেষ যাত্রার পথে। খেলাঘর নাম দিয়ে বাঙালির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয় কী জন্য? প্রতিটি ডিজিটাল সিনেমা হলে ভিন্ন ভাষায় বিজ্ঞাপন দেখায় কিম্তু বাংলা বা আমাদের মাতৃভাষায় দেখায় না কেন? বিগবাজার, বিশাল, মেট্রো মার্কেট সহ সব শপিং মলে সকাল থেকে রাত অব্দি হিন্দি গান বাজায়, বাংলা গান বাজায় না কেন? দুর্গাপূজা প্রতিমা নিরঞ্জনে হিন্দি চটুল গান, বাংলা গান নয় কেন? বরাকে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের দৈন্য দশা কেন?
২১ – ১৯ এক সারিতে বাসানো যায়?

শতাব্দী প্রাচীন বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ে আজও এগার শহিদের নাম বলতে পারে না। আমার ক্যামেরা ল্যান্সে ক্লাস নাইনের ছাত্রী বলেছে.. ১৯ শে মে কারগিল দিবস।….. কেন?

জানি না। ১৮৬১র মে মাসে বাংলা ভাষায় নবেল জয়ের জন্য রবিঠাকুরের জন্ম.. ১০০ বছর পর ১৯৬১ মে মাসেই বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য ১১ জন বঙ্গ-সন্তানের আত্ম বলিদান।।….২০৬১ বাংলা ভাষা বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকবে কি????? বিশাল প্রশ্ন।

দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
প্রধান শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মী

আমার মনে হয় যত দিন এগিয়ে আসবে ততই বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাবে একদল বাংলাভাষাভাষী মানুষেরা।করপোরেট দুনিয়াতে ঢোকার আগ্রহ সবার মধ্যে বেড়েই
চলেছে। বাংলাভাষা সত্যিই আজ বিপন্ন নিজ দেশে।আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা বাংলা ভাষার চর্চা বেশিরভাগই করতে আনন্দ পায় না।তাই আমি শংকিত বাংলাভাষার অস্তিত্ব রক্ষার কথা ভেবে।
একুশের যেহেতু একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে তাই একুশ উনিশের থেকে এগিয়ে।একুশ কেন্দ্রীয় ভাবে উদযাপন করে একটা সমগ্র দেশ। কিন্ত উনিশ সত্যিকার অর্থেই উদযাপন করে একটি রাজ্যের একটি উপত্যকার একদল মানুষ।ভাবনার পরিবর্তন না হলে এবং সরকারের আগ্রহ না বাড়লে হয়ত একদিন উনিশ কূপমণ্ডূকতায় পর্যবসিত হবে।
একুশের দেশের লোকজনদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতে হবে বৃহত্তর পরিসরে।একুশের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমস্ত মিডিয়া চ্যানেলের কিছুটা দায়িত্ব নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক অনুষ্ঠান একটি চলমান প্রক্রিয়ায় ঢেলে দিতে হবে।

অনুবাদ কেন? রিসার্চ স্কলার ছাড়া পড়বে কজন?হ্যাঁ, একটা শ্রেণী অনুবাদের আশ্রয় নেবে তো বটেই । এখনও বাংলা অধ্যুষিত অঞ্চলে কম্পিউটারে বাংলা ডিটিপি করার লোক পাওয়া যায় না অথচ ইংরেজি ডিটিপি করার লোকের অভাব হয় না।
যেগুলো আমার বিশেষভাবে মনে হচ্ছে তা হল,
১.বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের দাম কমিয়ে আনতে হবে।
২.বাংলা ভাষায় লেখা সব রকমের বইকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে পর্যাপ্ত ভাবে। এখনও শিলচরে বসে অনেক ভাল ভাল বই পাওয়া যায় না, কলকাতা থেকে আনাতে হয়।
৩.চাই আরো বেশি বেশি করে বইমেলা।
৪.বিশ্বের সকল ভাল ভাল বই এর বাংলা অনুবাদ ঐতিহ্য রক্ষা করে তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
৫.চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ ও কাজের পরিসর তৈরি করে দিতে হবে।

একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে নিয়ে একটাই কথা বলব এই দিনগুলো যেন বছরে একবারই পালিত না হয়।এর ঐতিহাসিক পর্যালোচনা যেন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় স্তরে স্তরে চলে।

শেখর দেবরায়, বিশিষ্ট নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, নাট্যাভিনেতা

শেখর দেবরায়

আমরা মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছি রক্তের অক্ষরে। একুশ থেকে উনিশের সংগ্রামী ইতিহাসের পথ চলা যেমন উজ্জ্বল তেমনি বর্তমানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বড় যন্ত্রণা আর কালো মেঘের ছায়া দেখতে পাই। কেন এমন হলো? এই সংগ্রামী ইতিহাসের কথা তো আরো বলিষ্ঠ আকার ধারণ করা উচিত ছিল। এই ব্যর্থতা আমাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজেদের জ্ঞাতে এবং সরকারি উদাসীনতা আর জীবনবোধের ক্লিষ্টতায় প্রজন্মদের শুধু দায়ী করে পার পাওয়া যায় না। বরং মাতৃভাষা চর্চার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাণ ভোমরা। তাই এই একুশ থেকে উনিশের ঐতিহ্য বহন করে ব্যক্তি জীবনের সাথে সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক চর্চাকে আরো নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি, সেটাই হোক আমাদের প্রত্যয়, আমাদের স্বপ্ন।

ঝুমুর পান্ডে, লেখিকা, সমাজসেবী

ঝুমুর পান্ডে

ইংরেজি স্কুল গুলোতে পড়াশোনার দৌলতে বিপন্ন তো কিছুটা বটেই। অনেকের হয়তোবা বিষয় বাংলা রয়েছে, কিন্তু তাতেও তারা বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। এক্ষেত্রে মা-বাবা অর্থাৎ অভিভাবকদেরই দোষারোপ করব। এখন অনেক মা-ই সগর্বে ঘোষণা করেন, আমার সন্তান বাংলা জানে না। সম্ভব হলেও অনেক সময় বাংলাটা শেখান না মা বাবারা। এভাবে বাংলাকে হেয় করার ব্যাপারটা সত্যিই নিন্দনীয়‌‌। সেই ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করতো, তখন যে ওদের গোলামী করাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, সেটা যেন এখনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর অনেক দেশেই ইংরেজিতে কথা বলা হয় না। জার্মানি থেকে শুরু করে অনেকগুলো দেশই নিজেদের মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে না। তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, শুধু বাংলার নয় বরং এখন সব আঞ্চলিক ভাষাই কোন না কোন ভাবে বিপন্ন।
আরো একটা ব্যাপার খুব খারাপ লাগে, বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক বড় বড় বক্তব্য রাখছেন যারা, তাদের ছেলে মেয়েরা কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে যাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমে না হয় পড়ালেনই, অন্ততপক্ষে পিতামাতাকে সম্বোধনের মধ্যেও বাঙালিয়ানা আর রইল না। ‘মা’ আর ‘বাবা’র জায়গাটা কবেই ‘মাম্মি’ আর ‘পাপ্পা’ নিয়ে নিয়েছে।
উনিশে মে একটি দেশের অন্তর্বর্তী একটি রাজ্যের ঘটনা। অন্যদিকে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের ঘটনা। তাই হয়তো উনিশের বার্তা ততটা ছড়ায়নি। কিন্তু তবুও খুব বড় মাপের না হলেও কোথাও কোথাও আসামের বাইরেও পালিত হয়।
ভাষা তো একটা জাতির পরিচয়। নিজের মাতৃভাষাকে যদি না ভালোবাসা না যায়, লালন করা সম্ভব না হয় তাহলে আর কি বলা যেতে পারে!! অন্য ভাষা শিক্ষার মধ্যে কোন অপরাধ নেই, অপরাধ টা হচ্ছে নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান না করা। তাই যারা উনিশে মে নিয়ে এত কিছু বলেন, আন্দোলন করছেন তাদের ছেলে মেয়েরা যদি বাংলা না জানে, তাহলে এর চাইতে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।
পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তবে আমি মনে করি, এমন একটা সময় আসবে এখন অনুবাদের পরই বাংলায় লিখিত বই গুলো পড়তে পারবেন আমাদের এই প্রজন্ম।
এক্ষেত্রে আমি বলবো মা বাবার দায়িত্ব অনেক, মা-বাবা যদি সন্তানদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত করে তোলেন এবং সেই ভাষার প্রতি সন্তানকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে পারেন তবে অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষার অনেক উন্নতি হতে পারে। একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে, উনিশে মে’র সেই স্মরণীয় দিনের পর কত বছর কেটে গেল, কিন্তু আজ অব্দি সেই কমিশনের রায় বেরোলো না। শাস্তি হলো না কারো‌। উনিশে মে নিয়ে অনেক হুলুস্থুল, কিন্তু এ নিয়ে তো কোনো আন্দোলন হলো না! এখন পর্যন্ত বিচারও হলো না! প্রশ্ন জাগে মনে, কেন?

আশিস রঞ্জন নাথ, লেখক, সম্পাদক, লিটল্ ম্যাগ

আশিস রঞ্জন নাথ

মুখে শুধু আ’মরি বাংলা ভাষা বললেই ভাষাটির উৎকর্ষ বেড়ে যায় বা যাবে এমন ভাবনাটাই ভুল। ভাষার উৎকর্ষ, লাবণ্য এবং উন্নতির জন্য বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার লালন, যত্ন এবং হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার প্রয়োজন। যেভাবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েই চলেছে তাতে বাংলা ভাষা বিপন্ন বলেই আমি মনে করি। সহজে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি নিজেদের স্মার্ট ও ইন্টিলিজেন্ট করতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা আজ ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। যে কোন মাধ্যমে পড়াশোনা চলতে পারে, তাতে তেমন সমস্যা আছে বা থাকতে পারে বলে মনে করি না। কিন্তু বাংলা ভাষাকে একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যেভাবে হচ্ছে তাতে কিন্তু অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। আগামী কুড়ি বছরে বাংলা বই পত্র, ম্যাগাজিন পড়ার পাঠক পাওয়া অনেকটাই মুশকিল হয়ে পড়তে পারে।

এক অলস দুপুরে ফেসবুকে বাংলাদেশের চটি হাসি তামাশার নাটক দেখে সময় কাটাতে গিয়ে একসময় আমার স্মার্ট ফোনের পর্দায় ভেসে উঠে এক দৃশ্য। বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধামে পালন করছেন ওপারের তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ। কোন এক টেলিভিশন চ্যানেলের বুম হাতে আনন্দে উদ্বেলিত এক তরুণীকে জিজ্ঞেস করলেন সাংবাদিক- বলতে পারেন এবার বাংলা সনটি কত? হেসে হেসে তরুণীটি বললেন- ঠিক বলতে পারছি না; একটু জেনে নেই….। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক তরুণী বললেন- এবার তো চৌদ্দই পঁচিশ বাংলার পয়লা বৈশাখের উদযাপন করছি আমরা।

অনুরূপভাবে বাংলা ছয় ঋতু এবং বার মাসের নাম ঠিকঠাক বলতে পারেননি উপস্থিত বাঙালির অনেকেই। অজস্র প্রাণ বলি দিয়ে যে বাংলা দেশটির জন্ম, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, যে দেশের কল্যাণে বা বদৌলতে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত ও মান্যতা প্রাপ্ত সে দেশটিরই যদি এমন করুণ দশা তবে বাকি অন্য ভুবনের বাংলাভাষার হাল সহজেই অনুমান সাপেক্ষ।

আজ উনিশে মে, ২১ ফেব্রুয়ারি কেবল উদযাপনের দিন। আমরা আনন্দে উদযাপন করি, কিন্তু কত সংগ্রাম আর আত্ম বলিদানে এই দিনগুলির প্রাপ্তি তা খতিয়ে দেখার বাঙালির সংখ্যা আজ ক্রম বিলীয়মান। যা অবশ্যই আক্ষেপের।

মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা যে জাতির যত আলগা হয়ে পড়বে এই ভাষার ভবিষ্যৎ ততই অনিশ্চিত হবে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই। কোনও উৎসব, অনুষ্ঠান তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে পারবে না।

দেবীপ্রীতা দত্ত, সহকারি অধ্যাপক, গুরুচরণ কলেজ

দেবীপ্রীতা দত্ত

ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার জন্য বাংলা ভাষা বা আমাদের মাতৃভাষা বিপন্ন, কথাটা আংশিকভাবে সত্য। তবে আমি ঠিক বিপন্ন বলতে রাজি নই, বলা যায় আঁচ পড়েছে, বলা ভালো কিছুটা প্রভাবিত। সবাই যে চাইছেন তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে, সেটার ও সামাজিক কারণ রয়েছে।
সামগ্রিক ভাবে যদি দেখা যায় তাহলে অবশ্যই বলতে হয়, নির্দিষ্ট একটি দিনে আমরা শুধু পালন করে থাকি একুশ কিংবা উনিশ। যারা সাধারন মানুষ, সেই আমরা কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যেমন ধরো, আমি হিন্দি থেকে বাংলা চ্যানেলগুলো দেখতে বেশি ভালোবাসি। পুজো সংখ্যা ছাড়া আমি দুর্গাপুজোর কথা ভাবতেই পারি না। আটটা থেকে দশটা পুজোসংখ্যা বাড়িতে আসে। এমনকি আমি আমার ছেলে মেয়েদেরকেও বাংলা শিখিয়েছি। আমি তো মনে করি এভাবেই আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিনই একুশ কিংবা উনিশের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
হ্যাঁ, আমি মনে করি, উনিশের বার্তা সবদিকে ছড়িয়ে পড়াই উচিত। তবু যেহেতু উনিশে মে’র ঘটনা শুধু একটি দেশের একটি রাজ্যের মধ্যে ঘটেছে তাই হয়তো তার মধ্যে এক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর অন্যদিকে একুশে ফেব্রুয়ারি যেহেতু একটি রাষ্ট্রের ঘটনা তাই পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে একুশের বার্তা। কিন্তু এটাও তো সত্যি, একুশের জন্যই আজ পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।
আরেকটা কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, আমি যখন ছোট ছিলাম, বাংলা মাধ্যমে পড়তাম। আমরা উনিশে মে’র কথা সবাই জানতাম। প্রত্যেক উনিশে মে’তে ১১টা মোমবাতি জ্বালানো হতো‌। একই রেওয়াজ আমি এসে পেয়েছি আমার শ্বশুর বাড়িতেও। আমার শাশুড়ি মা যিনি পেশায় বাংলার শিক্ষিকা,তিনিও আজ পর্যন্ত সেই রেওয়াজটা ধরে রেখেছেন। ওই সময় আমার বন্ধু বান্ধবদের ঘরে বা শিলচরের অন্যান্যদের ঘরে এরকম কিছু দেখি নি। তাই সত্যি কথা বলতে কি, ৫ /৬ বছর ধরে উনিশ নিয়ে এত হুলুস্থুল, বলা যায় প্রচারের আলোয় এসেছে। এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।
এই সংকটময় সময়ে অবশ্যই একুশের ইতিহাস আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারে কিংবা পথ দেখাতে পারে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়াই ছিল একুশের মূলমন্ত্র। অবশ্যই এই মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হতে পারি।সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতি-ধর্ম, শ্রেণীভেদ ভুলে আমরা যদি একসাথে সব অস্থির পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি তাহলে হয়তো এই সংকট থেকে আমরা উদ্ধার পেতে পারি।
না, আমি মনে করি না, ভালো বইগুলো পড়ার জন্য অনুবাদের আশায় বসতে হবে। কারণ আমি নিজেও আমার ছেলে মেয়েদের বাংলা শিখিয়েছি। আর আমার মনে হয়, একটা সময় আসে যখন সবাই নিজের শেকড়ে ফিরে যেতে চায়। বাংলা তো আমাদের শেকড়।

বাংলা ভাষার উপর নেমে আসা সংকট থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে বলতে হয়, নিজের মাতৃভাষায় সংকট মানে তো নিজের অস্তিত্বের সংকট। নিজের অস্তিত্বের সংকট নিজেকেই দূর করতে হবে। প্রত্যেকের ঘরে বাংলা সংস্কৃতির চর্চার অবকাশ থাকা চাই বাঙালি মাত্রেই। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা অবশ্যই খারাপ নয়। তবে মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্য কোন ভাষার শিক্ষাই শিক্ষা নয়।
তবে এখানে আমি একটি কথা বলতে চাই, শিলচরের এই প্রজন্মের যারা এখন লেখালেখি করছেন বিশেষভাবে বাংলায় লিখছেন যেমন অনন্যা দত্ত রায়, সোমাভা বিশ্বাস, রময়ণী চক্রবর্তী, তারা কিন্তু বেশিরভাগই ইংলিশ মাধ্যমেরই ছাত্রী। এটাও কিন্তু বলা যায় একটা ইতিবাচক এবং খুশির ব্যাপার।
সবশেষে বলবো আমার শ্বাসে প্রশ্বাসে, অন্তরে আত্মায় সর্বত্র আমার মাতৃভাষা বাংলা রয়েছে।

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য, সহকারি অধ্যাপক ,শিলচর কলেজ অফ এডুকেশন

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

ডাকে ঐ উনিশে মে, একাদশ শহীদের রক্তে রাঙা, আয় চলে আয় চলে.. কিংবা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী,আমি কি ভুলিতে পারি?
__গান গুলি হৃদয়ে দোলা দিতে দিতে আমাদের বড় করেছে,বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে । কিন্তু আজকের এই সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা হচ্ছে ।

ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতি ছাড়া আমাদের আগামী প্রজন্মের অগ্রগতি সম্ভব নয় — এটা আজ খুব সহজ ভাবে উপলব্ধ । কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি আমাদের উত্তরসূরীদের আবেগ ও ভালবাসা তৈরি করাও কি আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পরে না ? আমরা ছোট ছোট বাচ্চাদের এখন আর
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
শেখাই না, আমরা শেখাই
Twinkle twinkle little stars
How I wonder what you are…

শিশুকাল থেকেই তাদের আমরা ইংরেজি বিলাসী তৈরি করি । রবি ঠাকুরের “মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধসম” কথাটা আজকাল আমরাই ভুলতে বসেছি, ছোটদের আর কি দোষ দেব?

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কিংবা উনিশে মে’তে পথ নাটক,পথ আলপনা,পুষ্পঞ্জলি অর্পণ, প্রভাত ফেরি সঙ্গে একঝাক ইতি উতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।এই package program ই আমাদের উদযাপন করিয়ে দেয় আমার ভাষা, তোমার ভাষার কথা।কিন্তু ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় চোখ রাখলে শোনা যায় দুয়ো রানীর গল্প।তারা ২১ চেনে ১৯ জানে না । কেন? ১৯ আজও ব্রাত্য। সারা ভারতের ভাষা আন্দোলনের অবিসংবাদী ঘটনা ১৯ শে মের ১১ জন শহিদ বরাক তথা ভারত বা বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় কিছু স্থানে জায়গা করে নিলেও এক ডাকে সবাই আজ ১৯ কে চেনে না।চেনে না কমলা, বীরেন্দ্র,শচীন্দ্র,সুকোমলদেরকে ।
১৯শের পীঠস্থান বরাকেও আজ আমার মনে হয় বাংলাভাষার স্থান আমাদের পিরবর্তী প্রজন্মের কাছে খুব নড়বড়ে ।কারণ সব মা বাবারা তাদের সন্তানদের আজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ইঁদুর দৌড়ে সামিল করাতে গিয়ে ইংরেজির দাঁত ভাঙ্গা উচ্চারণে সহজ বাংলা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।

বাংলার এই সংকটময় সময়ে আমার মনে হয় উত্তরণের চাবি কাঠি আমরা প্রত্যেক অবিভাবকের কাঁধে ন্যস্ত ।আমরা যদি ছোট থেকে তাদের ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখাই,ভোর হলো দোর খোল শেখাই,অ এ অজগর আসছে তেড়ে শেখাই,বাংলা বারো মাসের নাম, ছয় ঋতুর নাম, বাংলা তিথি গুলোর নাম শেখাই, সাত ভাই চম্পা, রামায়ণ, মহাভারত,কিংবা বাঙলার মনীষীদের পাঠ দেই ,তবে আশাকরি বাঙালির ইংরেজি প্রীতিতে ভাটা পড়বে না ? কারণ বাংলাকে অর্থাৎ মাতৃভাষাকে মনে প্রাণে ভালো না বাসলে যে আমরা নিজের মা বাবাকে মন খুলে ভালো বাসতে পারব না!
তাই বেঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রম গুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে আসুন আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ছড়িয়ে দিই প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে——–।

সর্বানী ভট্টাচার্য, স্কুল শিক্ষক

সর্বানী ভট্টাচার্য

বাংলা ভাষা আজ কিছুটা হলেও বিপন্ন। এখন তো উনিশ এবং একুশ উদযাপনের মধ্যে অনেকাংশে সীমাবদ্ধ। উনিশে মে একুশে ফেব্রুয়ারির মতই হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। খুবই দুঃখের বিষয়। এটা বরাক উপত্যকা আর দেশের কিছু কিছু জায়গায় পালন হচ্ছে যা আরো ছড়িয়ে পড়া উচিত।

একুশ’ই তো পথ দেখিয়েছিল উনিশকে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তো সেটা ভালো করে জানে না। আমার মনে হয় অনেক বেশি প্রচারের দরকার। আগামী প্রজন্ম কি বাংলা কিছু পড়বে? সেটাই চিন্তার বিষয়। আর পড়তেও হয়তোবা ওদের অনুবাদের দরকার পড়বেই।

বাংলা ভাষার সংকট থেকে উদ্ধার অনেক বড় বিষয়। বই পড়ার উৎসাহ বাড়াতে হবে আমার মনে হয়। আর যেসব বাচ্চারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ওরা যেন নিজের বাংলাকে অল্টারনেটিভ ইংলিশ বা হিন্দির পরিবর্তে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরও ভূমিকা রয়েছে। ভালো বই পড়ার জন্য অভিভাবকদেরই উৎসাহিত করতে হবে।

২১ এবং ১৯ যেন শুধু উদযাপন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। আমরা যেন সেটা আমাদের সত্ত্বার মধ্যে অনুভব করতে পারি‌। এই দুটো দিন যে আমাদের পরিচয় সেটা যেন মনে থাকে। এবং ২১ আর ১৯ যেন সকল ভাষাভাষী মানুষের মনে নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান করার জন্য উৎসাহিত করে।

জ্ঞানেন্দ্র দাস, ছাত্র

জ্ঞানেন্দ্র দাস

আমারও মনে হয় বাংলা ভাষা আজ সত্যি সংকটের মুখে। কারণ আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, আজকালকার দিনের কিছু মা-বাবারা গর্ববোধ করেন যে তাদের ছেলে মেয়েরা বাংলা কথা বলতে পারে না। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বাংলার প্রতি টান কমছে বলেই আমার মনে হয়।
উনিশে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা কিছুটা হলেও বাংলা ভাষা বা বাংলা ভাষার জন্য যারা আত্ম বলিদান করেছিলেন তাদের কথা ভাবি। অথচ বছরের অন্য দিনগুলোতে আত্ম বলিদানের কথা ও ভুলে যাই। তাইতো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন একসঙ্গে কথা বলে তখন বাংলা থেকে ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে।
তাই যেখানে বাংলার পরিবর্তে অন্য ভাষা বলতেই স্বস্তিবোধ করে, সেখানে তো এ প্রজন্মের বাংলা বইয়ের পাঠকের সংখ্যা নেহাত হাতেগোনা যাবে। তাই বাংলা ভাষায় লেখা বইগুলো অবশ্যই অনুবাদের পরই এ প্রজন্মের পড়া সম্ভব বলে আমি মনে করছি। আরো একটা ব্যাপার এখানে বলতে চাই, কেউ যদি হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা সামাজিক মাধ্যমে বাংলায় বার্তা পাঠায় সেটা কিন্তু বাংলাতে লেখা হয় না। ইংরেজি অক্ষরে বাংলা কথাগুলো লেখা হয়।
বাঙালিদের মাতৃভাষার প্রতি উদাসীন থাকার এই নতুন নেতিবাচক দিককে ইতিবাচক দিকে পরিণত করতে সবচেয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে ঘরের মানুষদের। নিজের ছেলে মেয়েকে মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য কিংবা বাংলা অর্থাৎ মাতৃভাষা শেখার জন্য মা-বাবাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে।

Comments are closed.