প্রবাস জীবন আর বাঙালির আনন্দ উৎসবের গল্প গাঁথা
বাঙালির বার মাসে তেরো পার্বন । পৌষ পার্বণের উৎসব দিয়ে শুরু হয় বছর আর তারপরেই আসে বিদ্যার দেবী মা সরস্বতীর আরাধনা করার সুযোগ অর্থাৎ সরস্বতী পুজো। যা বোধ করি সকল বাঙালির বিশেষ করে ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য অতি আনন্দের উৎসব। ছোটবেলার সেই সরস্বতী পূজার আগে পর্যন্ত কুল না খাওয়া, রাত জেগে স্কুল বা পাড়ার পুজোর মণ্ডপ সাজানো বা মেয়েদের প্রথম শাড়ি পরা, বন্ধুদের সাথে অঞ্জলি দেওয়া….. কতো স্মৃতিই না জেগে ওঠে সকলের মনেই।
সরস্বতী পুজো প্রায় দোরগোড়ায়।তাই যেনো মনে হলো এই প্রবাসের পুজো , উৎসব অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু কথা লিখতে।
আজ প্রায় আঠারো-উনিশ বছর ধরে বিদেশে থাকার সুবাদে প্রবাসের বাঙালি জীবন যাত্রায় জড়িয়ে গেছি ভালো ভাবেই। আমাদের এখানে যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠান তিথি অনুযায়ী সপ্তাহের মধ্যে হলে তা সাধারনত পালন করা হয় সপ্তাহান্তে, কারণ এখানে তো আলাদা করে এইসবের জন্য কোনো ছুটি থাকে না। তাই ওই শনি-রোববারের অপেক্ষা। সত্যি কথা বলতে কি প্রবাসে থেকে এই বাঙালিয়ানা বা বঙ্গ সংস্কৃতি বজায় রাখতে তৎপর থাকেন অনেকেই। সরস্বতী পুজোর কথা দিয়ে যদি শুরু করি, এখানে তো আর স্কুল , কলেজে সরস্বতী বন্দনা হয় না, তাই বাঙালি পুজো কমিটিগুলোই ভরসা (আমাদের শহরে হয়তো এরকম ৭-৮টা কমিটি আছে) বাঙালি সন্তানদের বাগদেবীর আরাধনা করার জন্য। বড়দের সাহায্যে এভাবেই ছোটরাও জড়িয়ে যায় পুজোর আয়োজনে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে বা নিজেদের আঁকা দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়ে ।
একটা কথা এখানে উল্লেখ করি, বাইরের দেশগুলোতে তো প্রায় সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। সে মণ্ডপ সাজানো হোক বা পুজোর নাড়ু বানানো, জিনিষ বয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা পুজোর প্রস্তুতি।প্রত্যেক কাজেই সবাই এগিয়ে আসেন হাসিমুখে ,নিজেদের সারাদিনের কর্মক্ষেত্রের প্রচুর পরিশ্রমের পরেও। তখনই মনে হয় এতো সম্ভব হয় বাঙালিয়ানা বা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার তাগিদেই।
তারপর যদি পৌষ পার্বণের কথায় আসি , সপ্তাহান্তে বন্ধুরা মিলে পিঠে পুলি বানিয়ে নিজেদের মধ্যে আবার কখনও বা বড় আকারে পিঠে উৎসবের মধ্য দিয়ে উৎযাপিত হয় এই অনুষ্ঠান। এই পিঠে উৎসবে নিজেদের হাতে বানানো বিভিন্ন রকমের পিঠেতো থাকেই, সাথে থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। এবারে যদিও এই কোভিডের কারণে সব কিছু থেকেই বঞ্চিত আমরা।
রবীন্দ্র বা নজরুল জন্মজয়ন্তীও আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠানের সাজানো মালায়। আর এসব অনুষ্ঠানে ছোটো, বড় সবাই অংশগ্রহণ করেন সমান আগ্রহে।
আবার যদি দুর্গাপুজোর কথায় আসি , সারাবছরে দেশের বাঙালি দের মতোই প্রবাসের বাঙালিদের মনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বসে থাকে এই পুজোর দিনগুলোর জন্য।পুজোর কোনো ছুটি না থাকলেও শত কাজের মধ্য দিয়ে চলে এর প্রস্তুতি। নানা কমিটি গঠন হয়, কেউ রাতের পর রাত জেগে মণ্ডপ সাজানোর সব পরিকল্পনা করছেন, কেউ আছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে, আবার কেউ আছেন পুজোর খাবারের দায়িত্বে। আগেই লিখেছি এই কাজ গুলো করার জন্য বাইরের কোনো সাহায্য কিন্তু এখানে পাওয়া যায় না, তাই প্রত্যেকই নিজের দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই এই গুলো করেন,আর নিজেদের কর্মক্ষেত্রেও সবাই রয়েছেন দায়িত্ব সম্পন্ন পদগুলোতে। এমনও লোকও আছেন যাদের কাজের জন্য পুরো সপ্তাহ অন্য শহরে কাটাতে হয় এবং সপ্তাহান্তে বাড়িতে আসেন,কিন্তু তাও সময় বার করে হাত লাগান পুজোর আয়োজনে।
গতবছরের পুজোর আয়োজন কোভিডের কারণে করতে হয়েছে সম্পূর্ন ভিন্ন ভাবে। সব কিছুই হয়েছে ভার্চুয়াল। দেশের আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়তো বছরে দু বছরে একবার হয়। কখনও বা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে। সপ্তাহান্তের পূজোর এই কটা দিন তাই যেন নিজের দেশের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার মতই সবাই মেতে থাকার চেষ্টা করি আমরা।নিজের দেশ থেকে আসা অতিথি শিল্পীদের অনুষ্ঠান যেমন আকর্ষনীয়, তেমনই এখানের কচিকাচাদের অনুষ্ঠান, বড়দের নাটক, গানও বোধ করি কম মনোগ্রাহী হয় না।
এইভাবেই হয় লক্ষ্মী পুজো,কালী পুজোর অনুষ্ঠানও। ছোটদের অনুপ্রাণিত করতে তাদের লেখা, তাদের আঁকা দিয়ে বের করা হয় ম্যাগাজিন।এগুলো ছাড়াও আছে “বঙ্গমেলা”, বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা , বছরের বিভিন্ন সময়ে নাটকের অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
বিদেশে সব নিয়ম মেনে সব কিছু করা হয়তো সম্ভব হয় না, কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতি বজায় রেখে এই সব আয়োজন করা খুব একটা সহজ নয়। প্রবাস জীবনে ঘরে ডাল ভাত খাওয়ার সাথে সাথে , বাইরের জগতেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাঙালিয়ানা রক্ষা করার এই প্রয়াস এইভাবেই বজায় থাকুক, এই আশাই রাখছি।
Comments are closed.