Also read in

শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্র-- কিছু স্মৃতি কিছু কথা: সোমাভা বিশ্বাস

১৯৯৮ এর এক শীতের দুপুরে আমি দরদর করে ঘামছিলাম। মোট তিনটি ক‍্যামেরা আমার দিকে তাক করা রয়েছে–একটি মুখোমুখি ও দু পাশ থেকে আরও দুটি। মেকআপ করা মুখে পড়েছে চড়া আলো। ছোট্ট মাইক্রোফোনটা জামার কলারের সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়েছে। ওপরের তলার কাঁচের জানালার ওপারের কন্ট্রোল রুম থেকে নির্দেশ ভেসে এলো– সাইলেন্স, রোলিং ক‍্যামেরা, স্টার্ট সাউন্ড..আমাকে থাম্বস আপ দেখানো হল। সেটাই কিউ। এবার আমায় চারপাশের সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে কেবল ক‍্যামেরার লেন্সের দিকে মনোসংযোগ করে কথাগুলো বলতে হবে। আগে কখনো এতো ঘন করে লিপস্টিক মাখেনি আমার ঠোঁট, ত্বকে লাগেনি পুরু ফাউন্ডেশনের প্রলেপ। ল‍্যাপেল’র তারের সুড়সুড়ির সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। কথা বলার সময় কখনো তো এতো জন একসঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে না। সব অস্বস্তি কাটিয়ে কীভাবে যেন যা বলবার তা বলেছিলাম। প্রথম টেকে ‘ওকে’ হয়ে গিয়েছিল শট। শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রে সেই আমার প্রথম অনুষ্ঠান। আর সেই থেকে শুরু হয়েছিল দীর্ঘ এক সফর। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ অবধি শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি।

শিলচর শহর থেকে তো বটেই, আশেপাশের গ্রামাঞ্চল, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি থেকে অনুষ্ঠান করতে আসা কতো জ্ঞানী গুণী শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় হবার সৌভাগ্য হয়েছে শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রাঙ্গনে।অনুষ্ঠান সঞ্চালনাই করেছি বেশি। কচি কাঁচার দেশে, কিশলয়, বিচিত্রা– নানান অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছি। আমাদের অঞ্চলের চিকিৎসক, শিক্ষক, মৃৎশিল্পী, রাজনীতিবিদ, ব‍্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। নাটকে অভিনয় করেছি, আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। মণিপুরি নাচের অনুষ্ঠান করেছি, বরাক নদীতে শুশুকের বিপন্ন হয়ে পড়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। এইসব অনুষ্ঠান আমার শৈশব, কৈশোরের অঙ্গ। অনেক কিছু শিখেছি, অনেক বন্ধু প্রাপ্তি হয়েছে। নিজেকে চেনার, নিজের ভালোলাগা, অক্ষমতা গুলোকে জানার সুযোগ পেয়েছি। রক্তকরবী নাটকে নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে বুঝেছি গানের সঙ্গে লিপ মেলানোর কাজটা ঠিক কতটা কঠিন। আমার স্ক্রিন প্রেজেন্স নিয়ে প্রোডাকশন এর সকলের খুশি হওয়া এবং দর্শকের ইতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও ক‍্যামেরার সামনে যে আমি প্রবল অস্বস্তি বোধ করি সেটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব কেন জানি না, ভরসা করে আমাকে দেওয়া হতো। সেই কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, লিখতে আমি ভালোবাসি।

দিনে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় নিজস্ব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে শিলচর দূরদর্শন। সেখানে গানবাজনা, নাটক, আলোচনার পাশাপাশি পরিবেশিত হয় স্থানীয় সংবাদও। বাংলার পাশাপাশি মণিপুরি, চা জনজাতি, ডিমাসা, নাগা, মার-দের নানা অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে। মনে পড়ে চা বাগানের মেয়ের সাইকেল চড়ার, শিক্ষিকা হবার স্বপ্ন নিয়ে তৈরি ‘জয়মতী’ অনুষ্ঠানটির কথা। গান, কথায় দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান ‘ফিরে এসো আগুন’এর কথা। ‘হাসতে মানা’ দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ার সন্ধ্যেগুলো কে ভুলতে পারে? আমাদের চেনা জানা মানুষের, আমাদের মাটির, আমাদের আজন্ম পরিচিত আকাশ, বাতাসের গন্ধ লেগে থাকা ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’, ‘অক্ষয় বট’ অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। স্থানীয় কৃষকদের কথা জানার, কৃষিকর্মের উপযোগী প্রয়োজনীয় নানান তথ্য কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অনুষ্ঠান ‘কৃষিজগত’ এর গুরুত্ব ছোটবেলা না বুঝলেও, সবুজ বিপ্লবের সম্বন্ধে ধারণা হওয়ার পর থেকে নিয়মিত দেখতাম। দর্শক হিসেবে শিলচর দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান কেবল উপভোগ করেছি বলাটা ঠিক হবে না। এই অনুষ্ঠান গুলোর মাধ্যমে স্থানীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ঐতিহ্যের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিত হতে পেরেছি বলে আমাদের অঞ্চলের অনন্য সৌন্দর্য ধরা পড়েছে আমার কাছে।

অনেক দিনের পরিচয়ে দূরদর্শন কেন্দ্রের কর্মীরা আপনজন হয়ে উঠেছেন। এই কেন্দ্রে নির্মিত অনুষ্ঠান যতবার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পুরষ্কার লাভ করেছে, তখনই শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের সাফল‍্য, আমাদের গোটা অঞ্চলের মানুষের সাফল্য হয়ে উঠেছে। এতে আনন্দ, গর্বিত বোধ করেছি।

দুর্গা পূজার শেষে, বিজয়ার অনুষ্ঠানে, টেমস নদীর তীর থেকে ফোনের মাধ্যমে বরাক পাড়ে আমার আপন শহরবাসীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি বিলেতে পুজোর অভিজ্ঞতার কথা, শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই।

বিশেষ একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবার অভিজ্ঞতার কথা লিখছি, যার কথা আমি কখনো ভুলবো না। শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে ‘অরিগামি’, অর্থাৎ কাগজ দিয়ে তৈরি নানান ধরনের জিনিস বানিয়ে দেখিয়েছিল অরূপরতন সরকার। কাগজের টুকরো থেকে, কোনও কাটাকাটি না করে, কোনও রকমের আঠা ব্যবহার না করে কেবল কাগজকে ভাঁজ করে করে জীব-জন্তু, পাখি ইত্যাদির রূপ দিয়েছিল সে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ছেলেটির অসাধারণ দক্ষতা, সৃজনশীলতা। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার যে সঞ্চালক হিসেবে কিছু বলবার দায়িত্ব আছে। হুঁশ ফিরতে অনুষ্ঠান শেষ করবার আগে দর্শকের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম, “অরূপরতনের প্রতিভার সঙ্গে দর্শক বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল শিলচর দূরদর্শন। সেই সঙ্গে অরিগামি নামের আর্টফর্মটি সম্বন্ধেও আমাদের অঞ্চলের আরও অনেকে জানলেন, হয়তো অরূপের মতো আরও অনেকেই এ কাজে উৎসাহিত হয়ে উঠবেন।” এই বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করলাম, কারণ এ থেকে আন্দাজ পাওয়া যায় শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্রের একটি অন‍্যতম ভূমিকার। শিলচরে দূরদর্শন কেন্দ্র বিলাসিতা নয়, বরাকবাসীর একটি প্রয়োজন। অরূপরতন’র মতো আমাদের এই অঞ্চলে অনেক শিল্পী আছেন যাদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় এই সম্প্রচার কেন্দ্র।

পাঁচগ্রামের কাগজকলের পরিণতি আমরা দেখেছি। তাকে বাঁচাতে কিছুই করতে পারিনি। শিলচর দূরদর্শনকে সে পথে যেন কখনো ঠেলে দেওয়া না হয়। ‘শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে স্থানীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে’– এ খবর দেখে চমকে না উঠে বুঝতে হবে এই আশংকা যে মাঝে মধ্যেই দেখা দেয়, তার জন্যে দায়ী আমরা, দর্শকশ্রোতারাও। ফুলের তলের আনারস চাষ, কুম্ভা চা বাগানের কুলি রমনীর ঝুমুর নাচ, শনবিলের বোরো ধানের শীষ– টিভির পর্দায় এমন দৃশ্য দেখতে দেখতেই একসময় আমরা সন্ধ্যের চায়ে চুমুক দিয়েছি। সেসব কি আমরা আর দেখতে চাইনা? শিলচর দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখা, তা নিয়ে আলোচনা করা, ডিডি শিলচরের অনুষ্ঠানের মান বা ধরণে বদল চাইলে, সে কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের দর্শকদেরই।

‘শিলচর দূরদর্শন কেন্দ্র কেবল একটি রিলে স্টেশন হিসেবে কাজ করবে’- বরাক সন্তান হিসেবে একান্ত কাম্য, এমন আদেশ যেন কখনো কার্যকরী না হয়, এমন খবর যেন হোয়াটসঅ্যাপে ঘোরা ভুয়ো খবরের মধ্যেও না দেখতে হয়।

Comments are closed.