Also read in

লক ডাউন এর ফায়দা নিয়ে দেদার কালোবাজারি ফুড গ্রেইনসের! ডালের ৩০, চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০%, অ্যান্টি করাপশন এ এফআইআর রঞ্জন রায়ের

করোনা ভাইরাসের জেরে হয়েছে লকডাউন। আর লকডাউন এর ফায়দা নিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী বিক্রির ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া কালোবাজারি করেছে শিলচর ফুড গ্রেইনস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। যা ধরা পড়ে গেছে লকডাউন এর একদিন আগে, অর্থাৎ ২৩ মার্চ কাছাড়ের খাদ্য ও অসামরিক সরবরাহ বিভাগ প্রকাশিত খাদ্যসামগ্রীর দামের তালিকা থেকে। সরবরাহ বিভাগের সেই মূল্য তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যায়, তালিকাতে চাল, ডাল, আলু এসবের যে দাম ধরে দেওয়া হয়েছে এর থেকে চালের ক্ষেত্রে কুইন্টাল প্রতি দাম আশ্চর্যজনকভাবে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে ফুড গ্রেইনস। তাও ২৫ মার্চ অর্থাৎ লকডাউন এর পরদিন সকালে। এখানেই ধরা পড়ে গেছে কেলেঙ্কারি। ফাঁস হয়েছে কালোবাজারি করে দেদার লুটতরাজ চালানোর রহস্য। এই কেলেঙ্কারির যাবতীয় তথ্য দিয়ে রাজ্যের অ্যান্টি করাপশন বিভাগে এফআইআর করেছেন শিলচর পুরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের প্রাক্তন কংগ্রেস সদস্য তথা আদর্শ এনজিওর সভাপতি রঞ্জন রায়। অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও।

দেখা গেছে ২৩ মার্চ জেলা সরবরাহ বিভাগ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যে দামের তালিকা প্রকাশ করেছে এতে চালের দাম ধরা হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা। বড় দানার মুশুরি ডালের দাম কুইন্টাল প্রতি ৫৯০০ থেকে ৬১০০ টাকা। অথচ সেই তালিকার কোনও তোয়াক্কা না করে লকডাউন এর শুরুতেই ফুড গ্রেইনস এক লাফে চালের দাম ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা কুইন্টাল প্রতি বাড়িয়ে করেছে ২৮০০ টাকা। একইভাবে বড় দানার মুশুরি ডালের দাম কুইন্টাল প্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে ফুড গ্রেইনস করেছে ৬৫০০ টাকা। লকডাউন এর শুরুতেই দাম এভাবে বাড়িয়ে তালিকা তৈরি করে কাছাড়ের তৎকালীন জেলাশাসক বর্ণালী শর্মার সঙ্গে ২৫ মার্চ সকালে দেখা করে ফুড গ্রেইনসের সদস্যরা তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লকডাউন এ জিনিসের দাম বাড়বে না। তিন মাসের খাদ্য মজুত রয়েছে ফাটক বাজারে। সাধারণ মানুষ যেন আতঙ্কিত না হন। জেলা শাসকের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসে ফুড গ্রেইনস এর সদস্যরা একই বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে দিয়ে বলেছিলেন ‘চিন্তার কোন কারণ নেই। যথেষ্ট মাল মজুত রয়েছে। অসম মেঘালয় সীমান্তে আটকে রয়েছে আরও ৫০ থেকে ৬০ গাড়ি মাল। ফলে খাদ্য নিয়ে চিন্তিত না হয়ে মানুষ করোনার নিয়ম কানুন পালনে জোর দিন।

 

 

একদিকে জেলা প্রশাসনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এই সংকটে জিনিসের দাম বাড়বে না। কিন্তু অন্যদিকে এর আগেই প্রশাসন সহ শিলচর তথা কাছাড় বাসীকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা দাম বাড়িয়ে তবেই এসে জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করেছেন ফুড গ্রেইনস এর সদস্যরা। ফলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে তারা জেলা শাসকের কাছে এসেছিলেন তা প্রমাণ হয়েগেছে সরবরাহ বিভাগের দামের তালিকা থেকে। কিন্তু লকডাউন এর মধ্যে ধাপে ধাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে ফুড গ্রেইনস লুটতরাজ চালালেও তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে কাছাড় জেলা প্রশাসন সহ শাসক-বিরোধী দুই রাজনৈতিক দলই। এমনকি নীরব থেকেছেন সাংসদ মন্ত্রী বিধায়করাও।

না, এখানেই শেষ নয়, ২৪ মার্চ সন্ধ্যে ছ’টায় লকডাউন শুরু হওয়ার ১৭ ঘন্টা যেতে না যেতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে যে তালিকা প্রকাশ করেছে ফুড গ্রেইনস, সেই তালিকা মেনে তালিকায় ধরে দেওয়া দামেই জিনিস বিক্রি করতে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এই তালিকার দাম মেনে জিনিস বিক্রি করা না হলে কড়া পদক্ষেপ নেবে কাছাড় জেলা প্রশাসন। এভাবেই পরবর্তীতে ৩ এপ্রিল ফের নতুন তালিকা প্রকাশ করে কমন রাইস এর দাম কুইন্টাল প্রতি ২৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩১০০ থেকে ৩২০০ টাকা। অর্থাৎ দাম বেড়েছে প্রতি কুইন্টালে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। একই তারিখে বড় দানার মুসুরির ডালের দাম এক লাফে বেড়েছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল। ২৫ মার্চে ডালের দাম যেখানে ছিল ৬৫০০ টাকা, সেখানে ৩ এপ্রিল তা বাড়িয়ে দাম করা হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ৭৪০০ থেকে ৭৫০০টাকা। এই জায়গায় কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে প্রতি কুইন্টাল এ ১০০০ টাকা করে কালোবাজারি করেছে ফুড গ্রেইনস। এর দশ দিন পর১৩ এপ্রিল তালিকা প্রকাশ করে ফের দাম বাড়ানো হয়েছে মুশুরি ডালের। বড় দানার মুসুরির ডাল প্রতি কুইন্টাল ৭৪০০থেকে ৭৫০০ টাকার জায়গায় বাড়িয়ে দাম করা হয়েছে ৭৭০০ থেকে ৭৮০০ টাকা। এখানেও কুইন্টাল প্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

 

 

উল্লেখ করার মতো খবর হলো, লকডাউন চলাকালীন ধাপে ধাপে টানা একমাস দেদার কালোবাজারি চালিয়ে ২৭ এপ্রিল থেকে ফুড গ্রেইনস দাম কমাতে শুরু করেছে জিনিসের। দেখা গেছে ২৭ এপ্রিল তালিকা প্রকাশ করে কমন রাইস কমিয়ে আনা হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। বড় দানার মুশুরি ডালের দাম নামানো হয়েছে ৭৬০০ থেকে ৭৭০০ টাকায়। পর্যায়ক্রমে দাম কমানো হয়েছে ১, ৪, ১১ ও ১৬ মে পর্যন্ত তালিকা প্রকাশ করে। যেসব তালিকা পাঠানো হয়েছে সরবরাহ বিভাগেও। প্রশ্ন হচ্ছে লকডাউন এ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। নিম্নবিত্ত,দরিদ্র শ্রেণী বিশেষ করে শ্রমিক, দিনমজুর, ঠেলা রিকশা চালকদের অর্থের অভাবে অসহনীয় জীবনযাপন করতে হয়েছে। আর ঠিক তখনই টানা এক মাস কৌশলে দাম বাড়িয়ে কালো টাকার পাহাড় বানিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। আর এর ফলে চড়া দামে জিনিস কিনতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ মানুষ। ফুড গ্রেইনসের দেওয়া তালিকা যাচাই করা তো দূর, সরবরাহ বিভাগ কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টে এই দাম বাড়ানোয় সহযোগ দিয়ে গেছে গোপনে। জনসাধারণের চরম ক্ষোভ থাকা সত্বেও প্রথম এক মাসে ফুড গ্রেইনসের সদস্য ভুক্ত একটি পাইকারি দোকানেও অভিযান চালায়নি সরবরাহ বিভাগ।

ফুড গ্রেইনস প্রকাশিত তালিকাই ইঙ্গিত দিচ্ছে ২৪ মার্চ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে কুইন্টাল প্রতি ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। আর ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা দাম বেড়েছে বড় দানার মুসুরির ডালের। না, শুধু চাল বা ডাল নয়, একই পদ্ধতিতে দাম বেড়েছে মুগ ডাল, অড়হড় ডাল, ভোজ্য তেল, আলু, লবণ এরকম বিভিন্ন সামগ্রীর। লকডাউন এ সরকারের নিয়ম মেনে মানুষ ছিলেন ঘরবন্দী। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা এর ফায়দা নিয়ে মানবিকতার গলাটিপে কালোবাজারির চরম সীমায় পৌছে যান। প্রাক্তন কমিশনার রঞ্জন রায় প্রশ্ন তুলেছেন, তখন কোথায় ছিল কাছাড়ের জেলা প্রশাসন? কোথায় ছিল সরবরাহ বিভাগ? তার একটাই কথা, ফুড গ্রেইনস ও সরবরাহ বিভাগ মিলে যৌথভাবে কালোবাজারি হয়েছে। একদিকে জনসাধারণের সামনে সাধু সেজে ফুড গ্রেইনসের সদস্যরা মিডিয়ার সামনে বলেছেন জিনিসের দাম বাড়বে না। কিন্তু তারাই তলে তলে দুর্নীতি করে গেছেন। রঞ্জন রায় জানান, সরবরাহ বিভাগ সহ শাসক বিরোধী দল এবং সরকারের প্রতিনিধিরা যদি এ নিয়ে লকডাউন এর শুরুতেই সরব হতেন তাহলে পাইকারী ব্যবসায়ীরা চাপে পড়ে জিনিসের দাম কমাতে বাধ্য হতো।

 

 

এখানেই না থেমে আদর্শ এনজিওর সভাপতি রঞ্জন রায় বলেন, ২৯ এপ্রিল ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ফুড গ্রেইনস এর সদস্যরা বলেছিলেন, লকডাউনে জিনিসের দাম বেড়েছে মাত্র দেড় থেকে ২ শতাংশ। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সরবরাহ বিভাগ যেখানে ২৩ মার্চ প্রকাশিত তালিকায় চাল অর্থাৎ কমন রাইস এর দাম রেখেছিল কুইন্টাল প্রতি ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা, সেই দাম অনুযায়ী ফুড গ্রেইনস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন লক ডাউনে ২ শতাংশ দাম বাড়ার কথা বললে সেই বর্ধিত দাম কত হতে পারে। হিসেব বলছে ২ শতাংশ হলে দাম হওয়া উচিত ২২০০-র জায়গায় কুইন্টাল প্রতি ২২৪৪ টাকা এবং ২৫০০-র জায়গায় ২৫৫০ টাকা। কিন্তু ফুড গ্রেইনস তালিকা প্রকাশ করে লকডাউন এর শুরুতেই প্রথম দিনই কমন রাইস এর ক্ষেত্রে এক ধরনের কোয়ালিটির দাম ২২০০ থেকে বাড়িয়ে যেখানে ২৮০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল করেছে সেখানে দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশেরও বেশি। আর অন্য কোয়ালিটির ২৫০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল এর চালের দামও বাড়িয়ে ২৮০০ টাকা করায় এক্ষেত্রেও প্রথম দিনই দাম বাড়ানো হয়েছে ১২ শতাংশেরও বেশি। একইভাবে মুশুরি ডালের ক্ষেত্রেও প্রথম দিনই দু’রকম কোয়ালিটিতে দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল ২ শতাংশের ফর্মুলা? তথ্য দিয়ে রঞ্জন বলছেন, ডালের ক্ষেত্রেও সরকার প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বড় দানার মুশুরি ডালের দাম প্রতি কুইন্টাল ৫৯০০ টাকা থেকে যদি ২ শতাংশ বাড়ে তাহলে দাম হবে বড়জোর ৬১১৮ টাকা। অন্য কোয়ালিটির ৬১০০ টাকা প্রতি কুইন্টালের দাম ২ শতাংশ বাড়লে হওয়া উচিত ৬২২২ টাকা। কিন্তু কোথায় সেই দাম। ফুড গ্রেইনস এর দাম বাড়ানোর তালিকার দিকে তাকালে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। হিসেব বলছে লকডাউনের টানা এক মাস ফুড গ্রেইনস চালের দাম বাড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর মুশুরি ডালের দাম ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দুর্নীতির বাদশায় পরিণত হয়েছে।

এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্প্রতি রাজ্যের অ্যান্টি করাপশন বিভাগের এডিজিপির কাছে ২৯৪/২০২০ রেফারেন্স নম্বরে এফআইআর করেছেন রঞ্জন রায়। ১৩ মে অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, সরকার যদি এই কালোবাজারির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না নেয় তাহলে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট এর মাধ্যমে সত্বর মামলা করবেন।

Comments are closed.