"গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর থেকে আমাদের রেলওয়ে যোগাযোগ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, জন নেতারা বুঝতে পারছেন না
অসময়ের বৃষ্টিতে নাজেহাল অসম। ভাসছে বন্যায়।আর অসমের বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কারোর অজানা নয়। অজানা নয় ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হাজার মানুষের করুণ অবস্থার কথা। এই পরিস্থিতির কিছুকটা শিকার হয়ে এক অস্বাভাবিক এবং অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। আর এরই পরিসরে কয়েকটি বিষয়, অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
সেই বিষয়ে যাওয়ার আগে নিজের অভিজ্ঞতার কথা কিছুটা তুলে ধরতে চাই। সেই সুযোগে হয়ত আমাদের পরিস্থিতি এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের জন্য কি গুরুত্বপূর্ণ বা সোজা ভাষায় বললে আমাদের কিসেতে লাভ হতে পারে সেটা অনুধাবন করা সহজ হবে।
ভয়াবহ বন্যায় যখন হাফলংয়ে আটকা পড়ে ছিলাম তখন সবচেয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল এবার কি হবে? কি করে ফিরে যাব? সরকারের পক্ষ থেকে যখন উদ্ধারকার্য শুরু হয় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে যাতে সবাইকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া যায়, তখন আমাদেরকে বলা হয় যে প্রথমে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। সেই অনুযায়ী রেলের পিএনআর নম্বর দিয়ে নাম নথিভুক্ত করলাম। প্রথমদিন হাফলংয়ের আসাম রাইফেলসের মাঠে আড়াইটার সময় যাওয়ার জন্য বলা হলেও সেখানে হেলিকপ্টার আসেনি। পরের দিন আবার সময় দেওয়া হল এবং বলা হল হাফলংয়ের নির্দিষ্ট একটি স্কুলের মাঠে হেলিপ্যাড রয়েছে সেখান থেকে সবাইকে হেলিকপ্টারে করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেও হেলিকপ্টার না আসায় আমাদের নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়। তৃতীয় দিনে প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় যখন পৌঁছালাম তখন দেখলাম যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সেদিন কিন্তু আমাদের সঙ্গে আমাদের জিনিসপত্রও ছিল না। তবু ভেবেছি, যেখানে প্রাণ সংশয়ে সেখানে জিনিসপত্রের কি মূল্য! আমরা প্রায় তিনশ, সাড়ে তিনশো জন ছিলাম। এরমধ্যে হেলিকপ্টারে ষোল সতেরো জনের জায়গা হচ্ছিল। প্রথমে সব বয়স্ক এবং অসুস্থদের নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয় হেলিকপ্টারে সব মহিলাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আয়তনে বড় একটি হেলিকপ্টার আসায় প্রায় ৩৫ জন সেটাতে চড়তে সমর্থ হয়। আমরাও কোনক্রমে চড়ে বসলাম। অতিরিক্ত বেঞ্চ দিলেও অনেকজনকে বসার জায়গা না পেয়ে নীচে বসতে হয়। তবে কুম্ভিরগ্রাম অব্দি পৌঁছাতে কোনও অসুবিধা হয়নি।এখানে বলতেই হয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাহায্য ছিল পর্যাপ্ত। শুধু ট্রেনের যাত্রী নন, অন্যান্য যারা(তাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থও ছিলেন) বন্যার কারণে আটকা পড়েছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকেও উদ্ধার করে পৌঁছে দেওয়া হয়।
হাফলংয়ের এই পরিস্থিতিতে অনেক ধরনের ঘটনার কথা জানা যায়। কয়েকটা ছেলে তো আবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় রওয়ানা হয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে রাত আটটায় দামছড়া রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। ৮৩ কিলোমিটার হেঁটে এসে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় স্টেশন মাস্টারকে অনুরোধ করে ওদেরকে বদরপুর পাঁচগ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। সেইসময় একটা ইঞ্জিন দামছড়া থেকে বদরপুর আসার কথা ছিল, তাই স্টেশনমাস্টার তাদেরকে সেই ইঞ্জিনে বদরপুর পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি রেলযাত্রীদের যারা আটকা পড়ে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদেরও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হিসেবে সবাইকে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়।
শুক্রবার রাতে গুয়াহাটি থেকে রওয়ানা হয়ে শনিবার সকালে যখন আমরা হাফলং পৌঁছাই, তখন আমাদের ট্রেন অনেক সময় হাফলংয়ে দাড়িয়ে থাকে। আমরা তখনও জানতাম না আমাদের জন্য কি ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছিল। রেল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয় এখানে অন্ততপক্ষে এক দেড় ঘন্টা দেরি হবে। কিন্তু তারপরও অনেক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ জানান যে ধ্বস নামার ফলে আর এগোনো যাবে না, তাই ওরা আমাদেরকে আবার গুয়াহাটিতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু গাড়ি মাইগ্রেনডিসা পৌঁছার পর জানানো হয় যে আর এগোনো সম্ভব নয়। এই অবস্থায় যাত্রীরা অস্থির হয়ে উঠেন এবং স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ আমাদের হাফলংয়ে পৌঁছে দেন। তারপরের ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার কথা তো ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন।
এই ঘটনায় অনেক অসহায় মুখ দেখেছি। দেখেছি আতঙ্কিত মুখে বাড়ি ফিরতে না পাওয়ার কষ্টের চিহ্ন। আমি যদিও ভয় পাইনি। মনে মনে ভেবেছি, সবার যা হবে তাই আমারও হবে। কিন্তু অনেককেই অস্থির হয়ে উঠতে দেখেছি। আর তখনই আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্নের ঝড় উঠে।
শিলচর কুম্ভীরগ্রামে গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর তৈরি করা নিয়ে বরাকবাসীর উৎসাহের শেষ নেই। বরাকবাসী হিসেবে আমিও পিছিয়ে নই। বরাক উপত্যকার এ ধরনের উন্নতি আমিও মনেপ্রাণে চাই। বলা ভালো, চাইতাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং বিশেষভাবে এই ঘটনা আমার মনটাকে নাড়া দিয়ে গেল। গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর থেকে আমাদের রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নতি কিংবা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর যদি মুষ্টিমেয় মানুষকে স্বস্তি বা আরাম প্রদান করতে সমর্থ, তাহলে রেলওয়ে ব্যবস্থার যথাযথ উন্নতি হাজার হাজার মানুষের শান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
তাই আমার এই অভিজ্ঞতার কথা যখন ভাবি তখন নিজের অজান্তেই অনেক কথা ভাবনার জাল বুনতে থাকে। এই যে পাহাড় লাইনের অবস্থা তাতে কর্তৃপক্ষ দেড় মাস বললেও কবে পর্যন্ত পাহাড় লাইন আগের অবস্থায় ফিরে যাবে তা নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। এই অবস্থায় একটি বিকল্প রেললাইন থাকা অনেক বেশি জরুরি ছিল। অথচ বরাক উপত্যকার জননেতাদের কাছে গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জন্য সঠিক রেলযোগাযোগ কিংবা এই ধরনের পরিস্থিতিতে একটি বিকল্প রেললাইন স্থাপন কতটা স্বস্তি এনে দিতে পারে এই জনপ্রতিনিধিরা কিছুতেই সেটা অনুভব করতে পারছেন না। তাই এই মুহূর্তে গ্রীনফিল্ড বিমানবন্দর নয়, বরং সঠিক রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা করা বরাকবাসীর জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা জনপ্রতিনিধিরা না বুঝতে চাইলে আমরা সাধারন মানুষের উচিত সেটা বুঝিয়ে দেওয়া।প্রয়োজনে চোখে আঙুল দিয়ে কিসেতে বরাকবাসীর সত্যিকার অর্থে ভালো হতে পারে সেটা দেখিয়ে দিতে হবে।
Comments are closed.