উনিশে মে-য়ের শুভেচ্ছা!! শিলচরে দাঁড়িয়েই শহীদ কন্যাকে শুনতে হয়, প্রমাণ কোথায় তিনি ভাষাশহীদের মেয়ে?
অসম আদোলনের শহীদদের পরিবারকে সরকার শুধু আর্থিক সাহায্য দেয় না, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তাদের সুরক্ষা নিয়ে অসমীয়া সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সচেতন। অথচ বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উজাড় করে দেওয়া উনিশের শহীদের মেয়েকে শিলচর শহরে দাঁড়িয়েই অনেকে প্রশ্ন করেন, তার কাছে কি প্রমাণ আছে তিনি শহীদের কন্যা? ঠিক যেমন বহু ভারতীয় বাঙালিকে ডিটেনশন ক্যাম্পে নেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনার ভারতীয়ত্বের প্রমাণ কোথায়?”
৬ এপ্রিল ভাষাশহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধরের স্ত্রী ধনকুমারী সূত্রধর ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি রেখে গেছেন কন্যা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। প্রতিবছর উনিশে মে নিয়ে বরাক উপত্যকায় উচ্ছাস দেখা গেলেও এদিন ধনকুমারী সূত্রধরের শেষ যাত্রা একেবারে উচ্ছ্বাসহীন। শহরের সংস্কৃতিমনস্ক কিছু মানুষ এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছাড়া, কেউ তার শেষ যাত্রায় অংশ নেননি। তবে সারা জীবন এভাবেই কেটেছে ধনকুমারী সূত্রধরের।
বীরেন্দ্র সূত্রধর যেদিন শহীদ হন, তখন তার বিয়ের মাত্র দুই বছর হয়েছিল এবং একটি ছয় মাসের কন্যা ছিল। তার স্ত্রী ধনকুমারী সূত্রধর সারাজীবন আর্থিক অনটনে কাটিয়েছেন, কারখানায় কাজ করেছেন। অসুস্থ অবস্থায় কোনওদিন শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে চাননি, কেননা সেখানে পুরনো স্মৃতি তাকে তাড়া করত। তার কন্যা মধুমিতা সূত্রধর জানান, বাবার মৃত্যুর পর তাকে বড় করতে অত্যন্ত কঠিন দিন কাটিয়েছেন তার মা। একসময় অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাদের আর্থিক অনটন কোনদিন কাটেনি। রাধামাধব রোড সংলগ্ন এলাকায় শিলচর পুরসভার দেওয়া জমিতে বাঁশ এবং টিনের ঘরে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ ২০ বছর। সেখানে নানা ঝড়-ঝাপটার সম্মুখীন হতে হয়েছে, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি জীবিত থাকতে অনেকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা পুরসভার দেওয়া জমিতে থাকতে পারবেন না। এবার তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত। এই বছর উনিশে মে তারা এই আতঙ্কেই কাটিয়েছেন।
উনিশে মে-র সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে নিজের এবং পরিবারের আতঙ্কের কাহিনী শোনালেন শহীদ-কন্যা মধুমিতা সূত্রধর। তিনি বলেন, “প্রায় দুই দশক আগে শিলচর পুরসভার তরফে শহরের মাটিতে ভাষাশহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধরের স্ত্রী এবং সন্তানদের থাকার জন্য এক টুকরো জমি দেওয়া হয়েছিল। তবে সেখান থেকে আমাদের উৎখাত করতে অনেকে ভয় দেখিয়েছেন। এক বড় সংস্কৃতিকর্মী একদিন মাকে চুপি চুপি একটি কাগজে সই করানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেটা হয়ে গেলে, মা জীবিত অবস্থায় ঘরছাড়া হতেন। মা অনেক লোকের বাড়িতে গেছেন এবং অনুরোধ করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তার সন্তানদের এই মাটি থেকে উৎখাত না করা হয়। এমনও হয়েছে মাঝরাতে আমাদের বাড়িতে লাগাতার ঢিল ছোড়া হয়েছে, গালাগাল দেওয়া হয়েছে এবং আইনের ভয় দেখানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, আমরা যাতে এই জমি ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যাই। আমার মা অনেক শক্ত মনের মানুষ ছিলেন, তার সাহসে আমরা হাল ছাড়িনি। তবে এবার ভয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে একদিন শিলচর শহরের মাটি থেকে ভাষাশহীদের পরিবারকে হয়তো ভয়ে পালাতেই হবে।”
কেন তাকে ভয় দেখানো হয় এবং কারা ভয় দেখায়, এই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যমে এলে সেই সংস্কৃতিমনস্ক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গরিব শহীদ কন্যার পরিবারের ক্ষতি করতে পারেন, তাই আমরা নামপ্রকাশে আনছি না। তবে শহীদ কন্যা জানিয়েছেন, পুরসভার পক্ষ থেকে দেওয়া যে জমিতে তাদের ঘর রয়েছে সেটা মাত্র দুই কাঠা। এর ঠিক পেছনে এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির জমি রয়েছে। শহীদ-কন্যার জমির একটা অংশ সেই প্রভাবশালী পরিবার তাদের জমিতে যাতায়াতের রাস্তা সুবিধায় ব্যবহার করতে চান। এক সময় তাদের ঠান্ডা মাথায় হুমকি দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে, “আপনারা কোনওভাবেই এখানে থাকতে পারবেন না, কেননা আমাদের সঙ্গে টাকার জোর, এলাকার মানুষের জোর এবং আইনের জোর রয়েছে। আপনাদের উৎখাত করতে বেশি সময় লাগবে না।”
উনিশে মে ভাষা শহীদ দিবস নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শন হয়, এবার তো সোশ্যাল মিডিয়াও এতে ভরে গেছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বঘোষিত সংস্কৃতি কর্মী এবং সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই নিজের সাধ্যমত দিনটি উদযাপন করছেন। তবে প্রদীপের নিচেই অন্ধকার থাকে, ভাষাশহীদের শহরে দাঁড়িয়ে শহীদ কন্যাকে যখন স্বনামধন্য সংস্কৃতিকর্মীরা জোর গলায় বলেন, “আপনার কাছে প্রমাণ কোথায় আপনি আপনার বাবার মেয়ে?” তখন অবশ্যই ভাষা শহীদকে শ্রদ্ধা জানানো হয় না।
ধনকুমারী সূত্রধর যতদিন সুস্থ ছিলেন উনিশে মে-তে শিলচর শ্মশানঘাট, রেল স্টেশন এবং গান্ধীবাগ পার্কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে যেতেন। সঙ্গে নিয়ে যেতেন তার পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তিকে। এই বছর লকডাউন রয়েছে এবং ধনকুমারী সূত্রধর আগেই মারা গেছেন। তবু পরিবারের সদস্যরা সকাল সকাল শিলচর শ্মশান ঘাটে গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ১১ জন শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন।
ধনকুমারী সূত্রধরের মৃত্যুর পর তার নাতি অনেকদিন খাওয়া-দাওয়া করেননি। কারোর সঙ্গে কথাও বলেন না তিনি।
Comments are closed.