উনিশের আরেক অধ্যায় সমাপ্ত, চলে গেলেন শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধরের সহধর্মিনী ধনকুমারী
১৯৬১ সালে ১৯মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন বীরেন্দ্র সূত্রধর। তখন তার বিয়ের মাত্র দুই বছর হয়েছিল এবং একটি ছয় মাসের কন্যা ছিল। তার স্ত্রী ধনকুমারী সূত্রধর সারাজীবন আর্থিক অনটনে কাটিয়েছেন, কারখানায় কাজ করেছেন। ৮৫ বছর বয়সে মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। রেখে গেছেন কন্যা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। অসুস্থ অবস্থায় কোনওদিন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে চাননি, কেননা সেখানে পুরনো স্মৃতি তাকে তাড়া করত। তার কন্যা মধুমিতা সূত্রধর জানিয়েছেন, বাবার মৃত্যুর পর তাকে বড় করতে অত্যন্ত কঠিন দিন কাটিয়েছেন তার মা। একসময় অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাদের আর্থিক অনটন কোনদিন কাটেনি। তার মৃত্যুতে শেষ হয়ে গেল ভাষা আন্দোলনের আরেক অধ্যায়।
বার্ধক্যজনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন ধনকুমারী সূত্রধর। কন্যা ছাড়াও তার পরিবারে রয়েছেন নাতি-নাতনি এবং তাদের সন্তানরা। রাধামাধব রোড সংলগ্ন এলাকায় শিলচর পুরসভার দেওয়া জমিতে তৈরি টিনের ঘরে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ ২০ বছর। সেখানে নানান ঝড়-ঝাপটার সম্মুখীন হতে হয়েছে, স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেখানে অভিভাবক হিসেবে তাদের ঢাল হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী শিবাজী রায়।
তার মৃত্যুতে শহরের প্রায় প্রত্যেক সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ শোকাহত। শিলচরের তিন প্রার্থী তমাল কান্তি বণিক, দীপায়ন চক্রবর্তী এবং দিলীপ কুমার পাল সহ অনেকেই এদিন তার শেষ যাত্রায় অংশ নিয়েছেন। শিলচর শ্মশানঘাটে তার শেষকৃত্য চলছে, মুখাগ্নি করেছেন জামাতা অমিত কুমার সূত্রধর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের সদস্য জানিয়েছেন। বিশেষ করে তমাল কান্তি বণিক দীর্ঘদিন ধরে তাদের পরিবারের পাশে ছিলেন। এদিন তার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন।
তার কন্যা মধুমিতা সূত্রধর বলেন, “যেদিন বাবার মৃত্যু হয়, তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর, আমি তখন ৬ মাসের শিশু। পরবর্তী সময়ে মা কারখানায় কাজ করেছেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করেছেন, আমাকে বড় করার জন্য। আর্থিক অবস্থার জন্য খুব একটা পড়াশোনা করতে পারিনি আমি। প্রথম কিছু বছর কেউ আমাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। বহু বছর পর শিলচর পুরসভার পক্ষ থেকে একটা জমি দেওয়া হয় এবং সেখানে ঘর বানিয়ে থাকার জন্য অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মায়ের একটা আক্ষেপ ছিল, যে বাংলা ভাষার লড়াইয়ে আমার বাবা প্রাণ দিলেন সেই বাঙালি সমাজ তাকে যোগ্য সম্মান দেয়নি। সেই আক্ষেপ মনে থাকলেও প্রকাশ্যে আনেননি তিনি।”
মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বীপায়ন চক্রবর্তী এবং তমাল কান্তি বণিক, চিকিৎসক রাজিব কর সহ বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের প্রতিনিধি দল সহ অন্যান্যরা। শ্মশানে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল সহ প্রাক্তন কমিশনার সম্পা ধর, ভাষাশহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতির স্বপন দাশগুপ্ত, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের গোড়া চক্রবর্তী, সত্যজিৎ দে, নৃত্য শিক্ষক চন্দন মজুমদার ও অন্যান্যরা।
Comments are closed.