Also read in

ডি-তকমা নিয়ে পৃথিবী ছাড়লেন আরেক ভারতীয়, অপমান-অভিমানে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসক রঞ্জিত সেন

পেশায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রঞ্জিত সেন অত্যন্ত স্বাভিমানী এবং সৎ ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৬৬ সাল, ১৯৭০ সাল, ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বহু নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন এবং তার সম্পূর্ণ প্রমাণ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল পুলিশের একটি দল এসে তাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং ঠেলে দেওয়া হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। তার নামের পাশে লেখা হয় ডি-ভোটার, অর্থাৎ সন্দেহজনক নাগরিক। সারা জীবন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচা লোকটি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজেকে সন্দেহজনক ভারতীয় বলে মেনে নিতে পারছিলেন না। কারাগারে থাকার সময় বাড়িতে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল, এতে আরও ভেঙে পড়েন তিনি। জামিনে মুক্তি পেলেও নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ নিয়ে আর লড়াই করবেন না বলেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। শেষমেষ করোনা আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। চন্দ্রধর দাসের পর রঞ্জিত সেন বরাক উপত্যকার দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি নাগরিকত্ব ছাড়াই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।

রঞ্জিত সেনের নাতি ঋত্বিক সেন জানিয়েছেন, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ফেরার পর তার দাদু আগের মত ছিলেন না। যেন বাঁচার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না তার মধ্যে। তিনি কয়েকবার বলেছেন, যেদিন তাকে পুলিশ বিদেশি হিসেবে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, সেই মুহুর্তেই তার মৃত্যু হয়ে গেছে। এরপর বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আর লড়াই তিনি করতে চান না। এটা অবশ্যই মনের ভেতরের অভিমান থেকে বলেছিলেন তিনি। তবে গত এক বছরে একদিনও ভালো করে খাওয়া দাওয়া করেন নি, কোনও আনন্দ করেননি এবং নিজের অধিকার পাওয়ার জন্য একেবারেই কোনও দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়নি তাকে। পুলিশের তরফে বলা হয়েছিল সপ্তাহে একদিন তাদের কাছে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে, তিনি নীরবে সে কাজটি করতেন এবং বাড়ি ফিরে আসতেন।

সম্প্রতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং তার চিকিৎসা স্থানীয় হাসপাতালে হয়। বরাবর অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় তার শারীরিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষমেষ মঙ্গলবার তিনি সব প্রশ্ন-উত্তরের সীমা কাটিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। এতে পরিবারের লোকেরা একদিকে যেমন অত্যন্ত রাগান্বিত এবং হতাশ অন্যদিকে রঞ্জিত সেনের মানসিক যন্ত্রণার মুক্তি হয়েছে বলে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।

তিনি উধারবন্দের পানগ্রাম পার্ট-টু এলাকার বাসিন্দা এবং একজন সম্মানিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন। সারাজীবন সততা এবং আত্মসম্মান তার প্রিয় ছিল। অথচ হঠাৎ করেই একদিন বিদেশি তকমাধারী হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি মন থেকে। এতেই ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যেদিন ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলে তিনি কিছুই বলতে চাননি। তবে তার চোখে ছিল এক গভীর হতাশার ছাপ।

গত বছর ডিসেম্বর মাসে একইভাবে নাগরিকত্ব ছাড়াই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ১০৪ বছরের চন্দ্রধর দাস। চন্দ্রধরের শেষ ইচ্ছে ছিল নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করবেন, তার পরই পৃথিবী ছাড়বেন। তবে ডিটেনশন ক্যাম্পের যন্ত্রণার পর তাকে দ্বিতীয়বার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের যন্ত্রণার মধ্যে যেতে হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে যারা নিজের নাগরিকত্ব প্রমান করবেন তারা আদালতের নির্ধারিত তারিখে, ঠিক সময়ে আদালতে পৌঁছে গেলেও সরকারি উকিল থাকেন না এবং তারিখ পিছিয়ে যায়। প্রতিবার তারা হতাশা এবং অপমান নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

সমাজসেবী কমল চক্রবর্তী ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা লোকদের জামিনে মুক্তি পাওয়ার পথ সহজ করে দিতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। তার পাশে দাঁড়িয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। কমল চক্রবর্তী মনে করেন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আদালত একেবারে নিরর্থক। তিনি বলেন, “কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার ফরেনার্স ট্রাইবুনাল বানিয়ে রেখেছেন, অথচ আজ পর্যন্ত সেখানে একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। সাধারণ মানুষ তাদের সঠিক কাগজপত্র নিয়ে সময়মতো সেখানে উপস্থিত হলেও সরকারি উকিল থাকেননা, অথবা সেখানে সদস্যরা কাগজ দেখে আর আস্থা রাখতে পারেন না। এতে শুধুমাত্র যন্ত্রণা বাড়ে সাধারণ মানুষের। শেষমেষ চন্দ্র দাস বা রঞ্জিত সেনের মত মানুষ সব নাগরিকত্বের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেন। এটা সরকারের ব্যর্থতা, সমাজের ব্যর্থতা এবং গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতা।”

Comments are closed.

error: Content is protected !!