
'অসম চুক্তি নয়, জনগণের দাবিতেই ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী বরাকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মতি দিয়েছিলেন', বলছেন বিশেষজ্ঞরা
শুক্রবার আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল দাবি করেন অসম চুক্তির ফসল হিসেবেই বরাক উপত্যকাকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া হয়েছিল। তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অসম আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এতে অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন, কেননা ইতিহাস অন্য কথা বলছে, সেটা না জেনেই হয়ত মুখ্যমন্ত্রী কথাগুলো বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস নিয়ে নিরপেক্ষভাবে গবেষণা করেছিলেন অধ্যাপক সুবীর কর। তিনি সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছিলেন ছাপার জন্য, কোনও বিশেষ কারণে সেটা ছাপা হয়নি। আর পাণ্ডুলিপিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে অজ্ঞ, কারণ এব্যাপারে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়না। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বরাক উপত্যকার বরিষ্ঠ শিক্ষাবিদরা প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কথার প্রতিবাদও করেননি।
বরাক বুলেটিনের পক্ষ থেকে উপত্যকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ থেকে রাজনীতিবিদ প্রত্যেকের কাছে এব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। কেউ কেউ উত্তর দিয়েছেন কেউ আবার এড়িয়ে গেছেন। কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা দেখে নেওয়া যাক:
শিক্ষাবিদ সঞ্জিব দেব লস্কর প্রয়াত শিক্ষাবিদ সুবীর করের সূত্র ধরেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটি কাজ করছেন। দীর্ঘদিন ধরে কাজের ফলে তিনি নানান দিক নিজের চোখে দেখতে পেয়েছেন। তিনি বলেন, “বরাক উপত্যকা যে ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে তার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ১৯২০ সালের কাছাকাছি সময়ে এই অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি উঠেছিল। ১৯৪৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় শিলংয়ে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে সুরমা উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। স্বাধীন ভারতে ১৯৭২ সালে বরাক উপত্যকায় একটি রাজ্যস্তরের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি ওঠে, প্রথমদিকে সেটা গৃহীত হয়, কিন্তু পরে রাজ্যের একাংশ মানুষের বিরোধিতার ফলে তা বাতিল হয়। তৃতীয় ঘটনার পর বরাক উপত্যকার একাংশ শিক্ষক মিলে সিদ্ধান্ত নেন এবার রাজ্য নয় কেন্দ্রীয় স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুলতে হবে। শিক্ষক প্রেমেন্দ্র গোস্বামীর নেতৃত্বে ‘শিক্ষা সংগ্রাম সমিতি’ নামের এক সংগঠন গড়ে ওঠে, এতে মূলত ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। পরবর্তীতে বরাক উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ছাত্র সংগঠন আকসা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকে আওয়াজ তোলেন। আন্দোলনের প্রতিনিধিরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে গিয়ে দেখা করেন। ১৯৮৪ সালের ২ আগস্ট, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি নিজে দাবিটি মেনে নেন এবং কথা দেন বিশ্ববিদ্যালয় হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য তার মৃত্যুর সঙ্গেই বরাক উপত্যকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন ভেঙে যায়। ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং এর সমর্থন করেন বরাকের শক্তিশালী নেতা সন্তোষ মোহন দেব। তবে শিক্ষক এবং ছাত্র সংগঠন থেকে সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান। শেষমেষ ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বরাক উপত্যকার মানুষের দাবি এবং তার মায়ের দেওয়া কথাকে সম্মান জানিয়ে উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি সমর্থন করেন। সেই সময় এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন বিজয় চক্রবর্তী সহ বেশ কিছু নেতা। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে রাজীব গান্ধীও মারা যান। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিল পাস হলেও এটি বাস্তবায়ন নিয়ে আবারও আন্দোলন করতে হয় বরাক উপত্যকার মানুষকে, পাশাপাশি তীব্র বিরোধিতা উঠে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে। শেষে তেজপুরে আরেকটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় স্থাপন সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আরও কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিনিময়ে বরাক উপত্যকায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। এই ইতিহাস নিয়ে নিরপেক্ষ চর্চা হয় না, লেখালেখি হয় না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও শিক্ষক ও ছাত্ররা এই বিষয়ে অবগত নন। ফলে হঠাৎ করে এমন একটা বয়ান দিয়ে দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতো ব্যক্তি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা বিশিষ্ট গবেষক তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ইতিহাস না জেনে কথা বলছেন, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় বরাক উপত্যকার মানুষের আন্দোলনের ফসল। ধরে নেয়া যাক তিনি সত্যি কথা বলেছেন, আসাম চুক্তির ফসল আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়, তাহলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বিভিন্ন সংগঠন এবং রাজনৈতিক নেতারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ কেন করেছিলেন? তারা কোনদিন চাননি বরাক উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা কোন ধরনের উন্নতি হোক। এখন নির্বাচনের আগে এসে এলাকাবাসীকে মিথ্যে প্ররোচনা দিচ্ছেন এবং টোপ দিচ্ছেন, আমরা এটা বুঝি। আমাদের ভুলে গেলে হবে না এই সর্বানন্দ সোনোয়াল মামলা করে আইএমডিটি আইন বাতিল করেছিলেন। আর যাই হোক তিনি বাঙালিদের প্রতিনিধি হতে পারেন না।”
প্রাক্তন সাংসদ সুস্মিতা দেবের বয়ান, “বরাকের রক্ত জল করা আন্দোলনের ফসল হচ্ছে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিজেপি সাংসদ বিজয় চক্রবর্তী সহ তাদের দলের অনেক নেতাই তরুণ গগৈ’র সময়ে প্রকাশ্যে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন। এখন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এসে বলছেন আসাম চুক্তির ফসল নাকি বিশ্ববিদ্যালয়, এটা কতটুকু হাস্যকর শুধু ইতিহাসবিদরা বলতে পারেন। বিজেপি নির্বাচনে জনগণকে কাছে পেতে এসব বলে যাচ্ছে। তাদের প্রতি আমার করুণা হয়।”
আকসার প্রতিষ্ঠাতা প্রদীপ দত্ত রায় বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এই উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালের ১৫ মে শিলচর শহরের একে চন্দ্র আইন মহাবিদ্যালয় চত্বরে বৈঠক করা হল এবং জন্ম হল বরাক উপত্যকার সবথেকে সফল ছাত্র সংগঠন আকসার। ছাত্রদের গর্জন কেন্দ্র সরকারের কানে পৌঁছোয় এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আমাদের বরাক উপত্যকায় ভাষার আইন রক্ষার্থে একসঙ্গে এগারো জন তরুণ প্রাণ দিয়েছেন, পরে আরও তিনজনের আত্ম বলিদান রয়েছে। অপরদিকে বাঙালির অধিকার কেড়ে নিতে আসাম আন্দোলন হয়েছে, তারা কোনওদিন আমাদের এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা চাননি। আজ হঠাৎ করে নির্বাচনের আগে এসে সর্বানন্দ সোনোয়াল বিভ্রান্তিকর কথা বলছেন, এটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রত্যেককে তার যোগ্য সম্মান দিতে হয় তবেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা মেলে। সোনোয়াল আমার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার এবং প্রিয় ব্যক্তি, অন্তত তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য আশা করিনি।”
Comments are closed.