
পোস্টার কাণ্ড : ভাষা আইন লঙ্ঘনের দায়ে জল জীবন মিশনের চেয়ারপারসন তথা কাছাড়ের জেলাশাসকের বিরুদ্ধে বিডিওয়াইএফ এর পক্ষ থেকে মামলা দায়ের
শিলচর রেলস্টেশনে অসমিয়া ভাষায় সরকারি পোস্টার লাগানোর বিরুদ্ধে বরাক ডেমোক্রেটিক যুব ফ্রন্টের বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে সমস্ত রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠেছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে এবার মুখ খুললেন বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এর মূখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্তরায়।
এক রেকর্ডেড প্রেসবার্তায় প্রদীপবাবু বলেন যে, বিডিওআইএফ এর যুব সদস্যদের সাথে কর্মসূচি চলাকালীন তার কথা হয়েছে, এবং তাঁরা স্পষ্টতই বলেছেন যে পোস্টারে কালো কালি লাগানো তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অঙ্গ ছিলনা। কর্মসূচির নির্ধারিত সময় বেলা সাড়ে এগারোটায় গিয়ে তারা এই বিষয়টি দেখতে পান এবং সেখানে বিডিওয়াইএফ এর নামোল্লেখও দেখতে পান। তখন আবার একে সংশোধন করতে গেলে আবার বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে বলে তারা তাদের নির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে ফিরে আসেন। তিনি বলেন যে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে বিডিওয়াইএফ এর এই কর্মসূচি কোন ভাষা বা ভাষিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, এটি ভাষা আইন লঙ্ঘন করার সরকারি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। বিডিওয়াইএফ বা বিডিএফ শুধু অসমিয়া নয় সমস্ত ভাষিক গোষ্ঠীর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
প্রদীপ দত্ত রায় বলেন, আসুর মূখ্য উপদেষ্টা সম্মুজ্জল ভট্টাচার্য বা জাতিয়তাবাদী দলের লুরিন জ্যোতি গগৈ থেকে শুরু করে স্বল্পখ্যাত বা অখ্যাত সংগঠনের যেসব নেতারা অসমিয়া ভাষার অপমান হয়েছে বলে বিডিওয়াইএফ এর বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন তাদের জ্ঞাতার্থে একটি বিষয় মনে করানো দরকার। কিছুদিন আগে বরাকের ঐতিহ্যবাহী” তরুনরাম ফুকন অসমিয়া বিদ্যালয় “কে ছাত্রছাত্রীর অভাব দেখিয়ে যখন বাংলা মাধ্যমের সাথে জুড়ে দেবার প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তখন বিডিএফ এর তরফেই প্রথমে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়,কারণ এটি বন্ধ হলে এই অঞ্চলে কেউ অসমিয়া মাধ্যমে পড়তে চাইলেও পারবেন না এবং তাতে ভাষিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে। মুলত এই উদ্যোগের জন্যই তা রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম ও সরকারের নজরে আসে ও সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। তিনি বলেন যে কই,সেসময় তো এইসব নেতাদের কাছ থেকে বিডিএফ এর প্রতি একটি প্রশংশাসূচক শব্দও শোনা যায়নি। প্রদীপ বাবু বলেন আমরা এসব আশাও করিনা কারণ আমরা কাছাড়কে ‘ আসামের ক্যানসার কিম্বা ,কেলা বঙাল এইসব শব্দবন্ধ শুনেই অভ্যস্ত। তিনি বলেন আজ যেসব জাতিয়তাবাদীরা নেতারা সংবাদ মাধ্যমে বরাক ব্রহ্মপুত্র সমন্বয়ের কথা বলছেন তারা কি ভুলে গেছেন যে আশির দশকে আসুর আন্দোলন চলাকালীন গৌহাটি মেডিকেল কলেজে পাঠরত অঞ্জন মিত্রকে কারা হত্যা করেছিল ? কারা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ইন্ডিয়ান ওয়েলের ম্যানেজার রবি মিত্রকে খুন করেছিল ? কারা সেইসময়ে হত্যা করেছিল ইউএমএফ নেতা কালিপদ সেনকে ? কারা নেলী গহপুরে দশহাজার বাঙালাভাষীকে দুদিনে নৃশংসভাবে খুন করেছিল ? তিনি বলেন যে বরাকের বাঙালিরা সর্বদাই সমন্বয়ে বিশ্বাসী,তাই ভুপেন হাজারিকার গান এখানকার বাঙালিদের মুখে মুখে ফেরে,অনেকেই বিহুনৃত্যে পারদর্শী। প্রদীপবাবু বলেন যেসব তথাকথিত নেতারা বলছেন আসামে থাকতে গেলে অসমিয়াকে রাজ্যভাষা হিসেবে মানতেই হবে তাঁরা ইতিহাস কিছুই জানেন না। তাঁরা জানেন না যে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম করার সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে ১৯৬১তে বরাকে যে উত্তাল আন্দোলন হয়,যাতে ১১ জন শহিদ হন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী,মূখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা ও আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে আলোচনা ক্রমে আসাম ভাষা আইন ,১৯৬১ সংশোধনী প্রস্তাব নেওয়া হয় এবং যাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে বরাক উপত্যকার সমস্ত সরকারি কাজকর্মে বাংলা ব্যাবহার বাধ্যতামূলক এবং বাকি আসামে অসমিয়া ভাষা ব্যাবহৃত হবে। পরে বোড়ো অটোনমাস কাউন্সিলের জন্য বোড়ো ভাষাকে একই ভাবে মান্যতা দেওয়া হয়।
বিডিএফ মূখ্য উপদেষ্টা আরো বলেন যে, আসুসহ এইসব সংগঠনের নেতাদের বোঝা দরকার কেনো এতগুলো রাজ্য পৃথক হয়ে আসাম থেকে বেরিয়ে গেছে ? কেনো ৫০ লক্ষ বোড়ো জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের পৃথক অটোনমাস কাউন্সিল ও ভাষিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিল ? কেনো কার্বি, মিসিং,ডিমাসাদের জন্য স্বশাসিত পরিষদ গঠন করতে হয়েছে ? তিনি বলেন এইভাবে কি বৃহত্তর আসাম গড়ার প্রক্রিয়া সফল হতে পারে ?
প্রদীপ বাবু বলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বরাকে সরকারি বিজ্ঞাপনগুলি অসমিয়ার পরিবর্তে বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে। এইজন্য বিডিএফ এর পক্ষ থেকে তাঁকে সাধুবাদ জানাচ্ছি আমরা। কিন্তু মাঝে মাঝেই ভাষা আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। চলছে বরাক বঞ্চনা। কিছুদিন আগে হাইকোর্টের নিয়োগ পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের অসমিয়া বাধ্যতামুলক করা হয়েছে যাতে নিশ্চিতভাবেই বরাকের প্রার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন। সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নয়নে অসম সাহিত্য সভাকে ৫ কোটি টাকা সরকারি অনুদান দেওয়া হল,বোড়ো সাহিত্য সভা পেল তিন কোটি অথচ বরাকের বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনকে কর্পাস ফান্ড থেকে কোন অনুদানই দেওয়া হয়নি।সরকারি চাকরিতে বরাকের প্রার্থীরা একইভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন ।ফিসারী বিভাগে ৬৫ টি পদে বরাক থেকে নিয়োগ শূন্য। ডিআরডিএর ২২ টি পদে বরাক থেকে একজনও সুযোগ পাননি। ৩০০ নার্সের নিয়োগ হল বরাক থেকে শিকে ছিড়ল মাত্র দুজনের। কদিন আগে বিজেপি বিধায়ক পরমানন্দ রাজবংশী এসে বলে গেলেন যে বরাকে প্রাথমিক স্তরে সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে অসমিয়া পড়তে হবে,যা ১৯৬১ এর ভাষা আইনের সম্পুর্ন পরিপন্থী। তিনি এখানের চা জনজাতি বা মনিপুরী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে সভা করলেও বাঙালিদের সাথে দেখাই করলেন না। প্রদীপ বাবু বলেন যে এই ব্যাপারে তাঁর পরমানন্দ রাজবংশীর সাথে কথা হয়েছে । তিনি বলেছেন বাঙালিদের সাথে আলাপ আলোচনার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক তরফেই সেদিন বাঙালিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি । তারমানে কি এটা ধরে নিতে হবে যে প্রশাসনে এরকম কিছু দালাল রয়েছেন যারা অসমিয়া বাঙালি বিভেদ জিইয়ে রাখতে চান ?
বিডিএফ মূখ্য আহ্বায়ক এদিন শিলচরের সাংসদ রাজদীপ রায়ের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন যে সাংসদ বলেছেন মূখ্যমন্ত্রীর পুজো সফরের পরই এই ধরণের ঘটনা দুরভিসন্ধিমূলক। প্রদীপ বাবু বলেন যে সাংসদ কি ভাষা আইন জানেন না ? তাহলে যে স্টেশন চত্তর এগারো ভাষা শহীদের রক্ত রঞ্জিত সেখানেই যে ভাষিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সে বিষয়ে তার কোন বক্তব্য নেই কেন ? এছাড়া তিনি কি দেখছেন না যে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রীন সিগন্যাল দেবার পরও এতদিন ধরে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন ‘ নামকরণ হচ্ছে না ? একবারও কি তিনি মূখ্যমন্ত্রীকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন ? একবারও কি এই নিয়ে জনসমক্ষে কোনো বক্তব্য রেখেছেন ? একবারও কি ভেবেছেন যে কেন বরাকের প্রার্থীরা ক্রমাগত সরকারি চাকরিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে ? করিমগঞ্জ মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে বরাকের অধিকাংশ সমস্যার ক্ষেত্রে তার নিষ্ক্রিয়তা প্রমান করে যে তিনি কোন অর্থেই তার পদের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। একই কথা এখানকার অধিকাংশ বিধায়কদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিডিএফ মূখ্য আহ্বায়ক এদিন বলেন পূর্বতন ও বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী যে বরাক ব্রহ্মপুত্র সমন্বয়ের কথা বলছেন তাতে আমরা আশাবাদী। তবে সত্যিই যদি তা উদ্দেশ্য হয় তবে বাঙালি তথা বরাকের বাসিন্দাদের সাথে আলোচনায়ও বসতে হবে।তাদের দাবি দাওয়া,অভাব অভিযোগকে সঠিক অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত অর্থে সমন্বয় সম্ভব হবে। শুধু বিধায়ক সাংসদের উপর নির্ভর করলে চলবে না কারণ তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেন না।
একই ভাবে যেসব অসমিয়া নেতৃবৃন্দ বর্তমানে বিডিওয়াইএফ এর উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের প্রতিও তিনি একই আবেদন জানিয়েছেন।
Comments are closed.