বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মেলা হচ্ছে বরমবাবা মেলা। চা বাগানে ঘেরা এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অবস্থিত শিলকুড়ি অঞ্চল বরমবাবার মেলাকে কেন্দ্র করে মুখরিত হয়ে উঠে। ধর্মীয় এই মেলাকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। আগেও চা বাগিচার মানুষের কাছে বরমবাবার মেলা খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু হাল সময়ে তার জনপ্রিয়তার বিস্তৃতি এতটাই বৃদ্ধি হয়েছে যে বরাক উপত্যকার নানা প্রান্তের মানুষ আর ঘরে থাকতে পারেন না। প্রাণের টানে ছুটে আসেন মেলায়। এক তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। সামরিকোণা- শিলচর পূর্ত সড়কের শিলিগুড়িতে বরমবাবার মেলা সিদ্ধেশ্বরের বারুণি মেলা বা ভুবন পাহাড়ের শিবরাত্রির মেলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
প্রত্যেক বছর কার্তিক পূর্ণিমায় আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার সূচনা হয়। চলে তিন দিন। এই কদিন শিলিগুড়ির পূর্ত সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৪২ সালে যে বরমবাবার মেলার সূচনা হয় সেই মেলা আজও নিজ মাহাত্ম্য নিয়ে চলে আসছে। সাংবাদিক সনৎ কুমার কৈরি তার “শ্রীশ্রী বরমবাবা ও মেলার ইতিহাস” পুস্তিকায় সূচনাপর্বের কথা লিখেছেন – “গোড়ার দিকে শিলকুড়ি ও তৎসংলগ্ন এলাকা বাগবাহার, ভরাখাই, ধরমখাল, বারিক নগর, এলেনপুর, দরগাকোণা, আইরংমারা, ধোয়ারবন্দ সহ আশপাশ গ্রামের বিশেষ করে হিন্দিভাষীরা কার্তিক মাস ব্যাপী সকালে স্নানাদি সেরে ঘরেই পুজো করতেন। অনেকে বরমবাবা ধামে এসেও পুজো করতেন। মাসান্তে কার্তিক পূর্ণিমার সময় বরমবাবার ধামে এসে সত্যনারায়ণ কথা পাঠ প্রবচন পূজা যজ্ঞাদি কীর্তন ইত্যাদি করার কাজ শুরু হয়। পূর্ণিমার ভোর থেকেই ভিড় জমতে শুরু করে ধীরে ধীরে সারা দিন ব্যাপী এই পূজা অর্চনাদি চলতে থাকে। জনসমাগম বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা পসরা নিয়ে হাজির হন। দোকানপাট বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে বরমবাবার ধামে মেলার সূচনা হয়।
কে এই বরমবাবা? বরমবাবা মানে ব্রাহ্মণ সন্তান। ব্রাহ্মণ শব্দের অপভ্রংশ বরম। ১৯৬০ সালে শিলকুড়ি চা বাগানের পত্তন হয়। তার আগে বরাক উপত্যকায় প্রথম চা শিল্প স্থাপিত হয় ১৮৫৫ সালে। স্থানীয় ভিত্তিতে উপযুক্ত শ্রমিকদের অভাবে ব্রিটিশ চা -কররা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য থেকে শ্রমিক এনেছিল। সেই সুবাদে উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর থেকে একদল মানুষের সাথে পিতার হাত ধরে এসেছিলেন এই ব্রাহ্মণ সন্তান। মাত্র ৭-৮ বছর বয়সে তিনি ব্রহ্ম’ গায়ত্রী সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর আসল নাম লংটু রাম। ইংরেজ মালিক, ম্যানেজাররা শ্রমিকদের উপর অকথ্য নির্যাতন করতেন। এসব নির্যাতন দেখতে দেখতে বিক্ষুব্ধ মনে লংটু রাম প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। এতে তাঁকে অপদস্থ করা হয়। অপমান সহ্য করতে না পেরে শিলিকুড়ি রাস্তার ধারে এক বিশাল বটবৃক্ষের নিচে তিনি স্বেচ্ছায় সমাধিস্থ হন। এ খবর চাউড় হতেই চা শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপরই বাগান সংলগ্ন এলাকায় নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটে।
কথিত আছে, যে বট গাছের নিচে বরমবাবা স্বেচ্ছায় সমাধিস্থ হয়েছিলেন, সেই বটগাছের ডালপালা বড় হতে হতে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং যানবাহন চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করে। তখন পাঁচ কিলো লাড্ডু মানত্ করে ডালপালা কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু জনৈক পুরোহিতকে বরমবাবা স্বপ্নাদেশে বলেন, লাড্ডুর ভোগে চলবে না, মহাবিষ্ণু যঞ্জ করতে হবে।
বরমবাবার মেলাকে ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম হয়। নানা অসুবিধার কথা ভেবে ১৯৪২ সালে শিলকুড়ি চা বাগানের তদানীন্তন ম্যানেজার ও স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৪২ সালের পর ১৯৬১ সালে বানারস থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিতদের সহযোগে ধামের যাত্রীশালা মণ্ডপে শতচণ্ডীর অনুষ্ঠান নয় দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে ধামে শ্রীশ্রী দুর্গা মূর্তি স্থাপিত হয়। এর অনেক আগে ১৯৪২ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে এই মন্দির পুনঃনির্মাণ হয়। এই ধামে রয়েছে হনুমান মন্দিরও।
দেশের জরুরি অবস্থা চলার সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। জওহরলাল নেহেরু, লোকনাথ মিশ্র, প্রণব মুখার্জি, অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এখানে এসেছিলেন।
প্রত্যেকবারই কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে এখানে উৎসব ও মেলা হয়। দূর-দূরান্তের পুণ্যার্থী সহ হাজার হাজার মানুষ প্রাণের টানে সমবেত হন এবং এই উদযাপনে সামিল হন।
Comments are closed.