Also read in

রথযাত্রা লোকারণ্য- উৎসবমুখর  বরাক উপত্যকা

প্রবাদ আছে যে, রথের দিনে কমপক্ষে ৭ বার বৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এবছর রথের দিনে বৃষ্টির দেখা মিলেনি। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ সত্ত্বেও রথের আনন্দে কোথাও ভাটা পড়েনি। সমগ্র বরাক উপত্যকা জুড়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়।এই উপলক্ষে আজ উপত্যকার বিভিন্ন মন্দির, আখড়া ইত্যাদি থেকে জগন্নাথ মহাপ্রভু, বলভদ্র ও দেবী সুভদ্রাকে নিয়ে সুসজ্জিত রথ বিভিন্ন সড়ক পরিক্রমা করে। রথের রশি ছুঁয়ে পুণ্য অর্জনের জন্য রাস্তার দু’পাশে ভক্ত এবং পুণ্যার্থীদের ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা মাটির পুতুল, বেলুন, বিভিন্ন রঙিন খেলনা এবং খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি নিয়ে রাস্তার দু’পাশে পসরা সাজিয়ে বসেন।

শহর শিলচরেও অসংখ্য ছোট বড় রথ পথে বের হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইস্কনের রথ, নরসিংহ আখড়ার রথ, শ্যামসুন্দর আখড়ার রথ, গৌড়ীয় মঠের রথ, এবং রাঙ্গিরখাড়ি আখড়ার রথ, ভুবনেশ্বর সাধু ঠাকুর আশ্রমের রথ। রাধামাধব আখড়ার রথ আখড়া চত্বরেই পরিক্রমা করে থাকে। এখানেই সবচেয়ে বেশি জনসমাগম পরিলক্ষিত হয়। শিলচরের ইসকন মন্দিরে জেলা উপায়ুক্ত এস লক্ষনণ সোনার ঝাড়ু দিয়ে প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে রথ যাত্রার সূচনা করেন ।প্রচুর ভক্ত সমাগমে শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে এই রথ সদরঘাটে শনি মন্দিরে অস্থায়ী মাসির বাড়িতে রাখা হয় ।

 

Rath Yatra celebration in Hailakandi

পশ্চিম শিলচরের চেংকুড়ি রোড সংলগ্ন অম্বিকাপুর, ভজন্তিপুর , ভকতপুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় কুড়িটি রথ পথে বের হয়। সুসজ্জিত রথের সাথে শিল্পীদের মনিপুরি নৃত্য কলা প্রদর্শন সহযোগে শোভাযাত্রা এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের অবতারণা করে।

শহরতলীর শ্রীকোণা অঞ্চলে শ্রীশ্রী মহাপ্রভুর রথ এবং দুধপাতিলের শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের রথেও প্রচুর জনসমাগম পরিলক্ষিত হয়। এদিকে, নতুন বাজারে শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের রথ শতশত লোকের উপস্থিতিতে নরসিংপুর অঞ্চলে পরিক্রমা করে।

আমাদের হাইলাকান্দি সংবাদদাতা জানিয়েছেন,

বর্নাঢ্য শোভাযাত্রায় শত শত আবাল বৃদ্ধ বনিতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে  শনিবার এক উৎসবমুখর  পরিবেশে রথযাত্রা  উৎসব পালিত হল হাইলাকান্দি জেলা জুড়ে।  জেলা সদর হাইলাকান্দি সহ  লালা, কাটলিছড়া, মনিপুর, ইত্যাদি  স্থানে এদিন  সুসজ্জিত রথ বের হয়।  আর এই রথের রশিতে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে হাত লাগান অগণিত ভক্তবৃন্দ ।  জেলার সর্বত্রই এদিন রথকে কেন্দ্র করে ভক্তদের মধ্যে বাড়তি উন্মাদনা লক্ষ্য করা গেছে। হাইলাকান্দি জেলা সদরে এদিন বানেশ্বর শিবমন্দির,  পুরাতন শিববাড়ি,  বাজার আখড়া ও  রাধারমণ সেবাশ্রম থেকে পৃথক পৃথকভাবে রথ বের হয়  এবং শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পরিক্রমা করে।। রথযাত্রার শোভাযাত্রায় আবাল বৃদ্ধ বনিতার অংশ গ্রহণ লক্ষণীয় ছিল।। অন্যদিকে এবার কাটলিছড়ায় বিশেষ  সুসজ্জিত রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথদেব।  তাঁর সংগে  ছিলেন  বলরাম ও সুভদ্রা।  এবার কাটলিছড়ায়  ছোট হাল্কা  যাত্রী গাড়ির কাঠামোর ওপর কাঠ  বসিয়ে  সুসজ্জিত ডিজাইন করে  রথ নির্মাণ  করা হয় ।
মিস্ত্রী রঞ্জিত সুত্রধর এবং  শিল্পী প্রবাল নন্দীর তত্বাবধানে এবার  কাটলিছড়ায় আকর্ষণীয় রথ নির্মাণ করা হয়। এদিন বিকেলে কাটলিছড়া হরিভজন কুঠির প্রাঙ্গণ  থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রথের সূচনা করেন হরিভজন কুঠিরের প্রতিষ্ঠাতা ১০৮ বছরের আচার্য্য হরিপদ ব্রহ্মচারী। এরপর
সুসজ্জিত রথের  ৮০ হাত লম্বা রথের দড়ি টানতে থাকেন ভক্ত- দর্শনার্থীরা।  এর আগে
১৩ জুলাই শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের শুভ অধিবাস,সন্ধ‍্যারতি অনুষ্ঠিত হয়।  শনিবার দুপুরে মধ্যাহ্ন-ভোগ, আরতি,মহাপ্রসাদ বিতরণের পর বিকেলে  জগন্নাথদেবের যাত্রা প্রদক্ষিণ শুরু হয়।  অনুরূপভাবে এদিন  লালা শহরেও  বি টি রোভ, ঠাকুরবাড়ি, আব্দুল্লাপুর আখড়া থেকে রথ বের হয়ে লালা শহর প্রদক্ষিণ করে।  মনিপুর বাগান, লালপানি, পাঁচগ্রাম ইত্যাদি এলাকাতেও রথ বের হয়। সর্বত্রই রথকে ঘিরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল।।

*শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার তাৎপর্য:*
জগতের অধীশ্বর শ্রীশ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু প্রতিবছর নব রথে উঠেন। নব মানে ভক্তি দিয়ে গড়া রথ। রথের দড়ি—বাসুকি। সেজন্য বলা হয়, রথের দড়ি ধরলে পূণ্যস্বরূপ বাসুকির কৃপা লাভ হয়। পুরীর রথের সর্বমোট ৪২টি চাকা। রথ চলার সময় রাস্তায় চাকার তিনটি দাগ পড়ে—তা হল গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। যারা বার্ধক্যজনিত কারণে বা অন্যান্য কারণে রথের দড়ি ধরতে পারেন না, তারা যদি চাকার এই তিনটি দাগের ধূলি গ্রহণ করেন বা এই ত্রিদাগে গড়াগড়ি দেন, তাহলে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীতে অবগাহনের ফল লাভ করেন।
জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ বা কপিধ্বজ। এই রথের ১৬টি চাকা, মানে—দশ ইন্দ্রিয় আর ছয় রিপূ। দেবতাদের দ্বারা প্রদত্ত সুভদ্রাদেবীর রথের নাম ‘দর্পদলন’ বা ‘পদ্মধ্বজ’। এই রথে ১২টি চাকা আছে। এর অর্থ—ভজনের সময় বার মাস। সম্পূর্ণ রথ শুধুমাত্র ২০৬টি কাঠ দিয়ে তৈরি। ঠিক মানবজীবনে আমাদের দেহেও ২০৬টি হাড়।
রথ যখন চলে প্রথমে থাকে বলবেবের রথ। কারণ বলদেব দাদা, আবার জগত গুরুতত্ত্ব। তিনিই তো নিত্যানন্দ। তারপর চলে সুভদ্রার রথ। সুভদ্রা হল ভক্তি তত্ত্ব। গুরুদেব হল ভগবানের করুণামূর্তি। তারপর যায় প্রভু জগন্নাথদেবের রথ। প্রথমে গুরুদেব, তারপর ভক্তি, তারপর স্বয়ং ভগবান শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব। রথের দর্শনে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু নৃত্য করছেন। অনেক ভক্তের মাঝে মহাপ্রভুকে না দেখে জগন্নাথদেবের রথ থেমে যায়। রথ অপ্রকৃতি কারণ প্রভু জগন্নাথের ইচ্ছা শক্তিতে রথ চলে। আজও রথে অচল শ্রীজগন্নাথকে দেখে রাধা ভাবে বিভোর মহাপ্রভু আনন্দে নেচে নেচে যান।

—জয় মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের জয়—

Comments are closed.