বরাক থেকেই শুরু হলো বিজেপির বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার, তবে বাঙালির আবেগ ছুঁতে পারলেন না বাঙালি-ঘরের 'জামাই' জেপি নাড্ডা
বিজেপির বিজয় সংকল্প যাত্রার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বরাক উপত্যকা থেকেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সূত্রপাত হয়েছে সোমবার। শিলচরে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারের দামামা বাজান । রাজ্যে বিজেপির শাসনকালের গত পাঁচ বছরের খতিয়ান তুলে ধরার পাশাপাশি শ্রীমন্ত শংকরদেব, মাধব দেব, গোপীনাথ বরদলৈ এবং ভূপেন হাজারিকাকে শ্রদ্ধা জানান জেপি নাড্ডা। তবে তার ভাষণে বরাক উপত্যকা বা রাজ্যের কোনও বাঙালি ব্যক্তিত্বের উল্লেখ ছিল না, এনআরসির মতো বিষয়ও তিনি এড়িয়ে গেছেন। দলের তরফে তাকে নানান উপহার তুলে দেন অনেকেই, সেগুলোতেও বাঙালি সংস্কৃতির কোনও নিদর্শন ছিল না। হিমন্তবিশ্ব শর্মা বা সর্বানন্দ সোনোয়াল যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন সেই সময় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে যতটুকু উচ্ছ্বাস দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় সভাপতির ভাষণের সময় ততটা চোখে পড়েনি। অসম আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে রাজ্যের সংস্কৃতির কথা বলার পাশাপাশি ভাষণ শেষে ‘জয় আই অহোম’ বলেন নাড্ডা। সবমিলিয়ে এটুকু বলা যায় উপত্যকার আবেগ ধরতেই পারেননি বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা। এটা তার প্রথম বরাক সফর ছিলনা, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রায় দশদিন উপত্যকায় থেকে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
এদিন দুপুরে ১টা ২০ মিনিটে বিশেষ বিমানে কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তাকে বরণ করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোটো প্রতিকৃতির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান মুখ্যমন্ত্রী। দুপুর দুটো নাগাদ শিলচরের পুলিশ গ্রাউন্ডে বিরাট সমাবেশে উপস্থিত হন নাড্ডা। তার সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। এর আগেই উপস্থিত অতিথিরা অনেকে ভাষণ রেখেছেন। তিনি মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী তাকে এক খড়্গের গন্ডারের একটি কাঠের মূর্তি উপহার দেন। বরাকের চা জনজাতি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে করিমগঞ্জের সাংসদ কৃপানাথ মাল্লাহ গ্রীন টি-র একটি প্যাকেট উপহার দেন। হিমন্তবিশ্ব শর্মা তাকে আদিবাসী টুপি পরিয়ে স্বাগত জানান। বাকিরা উত্তরীয় প্রদান করেন এবং দলের তরফে একটি বিরাট মালা পরিয়ে বিজয় সংকল্প যাত্রার সুচনা হয়।
নাড্ডা তার ভাষণে বলেন, “বরাক উপত্যকা থেকেই অসমে বিজেপির জয় যাত্রা শুরু হয়েছিল তাই এখান থেকেই আমরা পুনরায় অসম জয়ের যাত্রা শুরু করেছি। আসাম আন্দোলনকে সবথেকে বেশি সমর্থন করেছে বিজেপি, এই বিষয়কে প্রথমবার দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। তার স্লোগান ছিল ‘শ্রীনগর হো ইয়া গুয়াহাটি, আপনা দেশ আপনা মাটি’। অহোম সংস্কৃতি বিজেপির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দল সরকারে আসার পর অসমের ছয় জনজাতিকে সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অথচ এটা করতে গিয়ে অন্য কারও অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি। প্রায় ৫০ বছর ধরে চলা বড়োল্যান্ডের আন্দোলনের ফলে চার হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, অথচ আমাদের সরকার খুব সহজে সেটা সমাধান করেছে। অতীতে কংগ্রেস সরকার অনেক প্রকল্প শুরু করেছে, কিন্তু সেটা শেষ করেনি। আমাদের সরকার বহুদিন থেকে আটকে থাকা প্রকল্পগুলো শেষ করার পাশাপাশি নিজের শুরু করা প্রকল্পও সম্পন্ন করেছে। গুয়াহাটিতে আন্তর্জাতিক মানের এইমস হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে, এছাড়া রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় হাসপাতাল হচ্ছে। কেন্দ্র সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ হয়েছে এবং রাজ্যের মানুষ লাভবান হয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাছে বিজেপির কোনও বিকল্প আপাতত নেই, ফলে আমরাই আরও অনেক বেশি শক্তি নিয়ে আগামী নির্বাচনে জয়ী হব। জয় আই অহোম।”
অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল কেন্দ্রীয় সভাপতির প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “খুব অল্প সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি সব থেকে বেশি অসমের উন্নতির দিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমরা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রচার শুরু করেছি এবং তিনি সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। আমরা জানি আগামীতে জনগণের কাছাকাছি গিয়ে আমরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসবো সেটা পূরণ করতে জেপি নাড্ডা মহাশয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের সাহায্য করবেন।”
মুখ্যমন্ত্রী এদিন ঘোষণা করেন বরাক উপত্যকায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হবে এবং তার শিলান্যাস খুব শিঘ্রই হবে। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন কাজের খতিয়ান দেখিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার গত পাঁচ বছরে যেটা করেছে কংগ্রেসের সরকার ৫০ বছরেও করেনি। গতবার আমরা বরাক উপত্যকার যেসব আসনে জয়ী হয়েছি সেখানে অনেক বেশি উন্নতি হয়েছে। আমরা চাই এই বছর উপত্যকার পনেরোটি আসনেই আমাদের প্রার্থীরা জয়ী হোন, এতে উন্নতির ছোঁয়া আরও বেশি করে লাগবে।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, “২০২০ সাল আমরা অনেক কষ্টে কাটিয়েছি, এই বছর আনন্দে থাকতে চাই। আমার বিশ্বাস বরাক উপত্যকার মানুষ আমাদের দলকে ১৫ টি আসনে বিজয়ী করিয়ে সেই আনন্দ দেবেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসেই শিলচর সিভিল হাসপাতালে ৩০০-শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ শুরু হবে। অতীতে এপিএসসি পরীক্ষায় পাস করতে হলে এক কোটি টাকা ঘুষ দিতে হতো, আমাদের সরকার থাকায় সেটার প্রয়োজন হচ্ছে না। আমরা মা-কামাখ্যা এবং ভুবন তীর্থের নাম নিয়ে নির্বাচনের প্রচার শুরু করছি।”
এদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তথা মঙ্গলদৈয়ের সাংসদ দিলীপ শইকীয়া, শিলচরের সাংসদ রাজদীপ রায়, করিমগঞ্জের সাংসদ কৃপানাথ মাল্লাহ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ, বনমন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য, কাছাড় জেলার বিজেপির বিধায়করা, বিজেপির রাজ্য কমিটির সভাপতি রঞ্জিত দাস সহ অন্যান্যরা।
Comments are closed.