Also read in

উনিশ আমাদের রক্তে, তা সত্ত্বেও মেধাতালিকায় স্থান না পাওয়ার কারণ 'বাংলা' !

বিগত কয়েকদিন ধরে আমাদের গর্বের একাদশ শহিদের স্মৃতি বিজড়িত উনিশে মে নিয়ে চলছে নাচ, গান, কবিতা, আল্পনা, আলোচনা সভা, শ্রদ্ধা নিবেদন, আর এতে এপার-ওপার একাকার। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ – তাই ১৯৬১র ১৯শে মে বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদানকারী শহিদদের নিয়ে আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস খুবই সঙ্গত।

ঠিক এই মুহূর্তে ছন্দপতন বলে মনে হলেও বলতে হচ্ছে, বাংলা ভাষা-ভাষীরা খুব একটা ভালো জায়গায় নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত মাধ্যমিকের ফলাফল নিয়ে এই কথাটা বলতেই হচ্ছে। সেবা পরিচালিত হাইস্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষায় আসামের ৩৯ জন মেধাতালিকায় স্থান পেলেও বরাক উপত্যকার একজনও ঐ তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি। বরাক উপত্যকার বেশ কয়েক শত পড়ুয়ার মার্কশিট এই ক’দিনে অনুধাবন করে একটা বিপজ্জনক সংকেত পাওয়া গেল- ‘বাংলা’ বিষয়টার জন্যই মেধাতালিকায় স্থান করে নিতে পারল না বরাকের মেধাবীরা।

আমরা কলেজিয়েট স্কুলের শ্যামলী নাথের ফলাফলকে যদি এখানে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ছয় নম্বরের জন্য কলেজিয়েটের টপার ১০ জনের মেধাতালিকায় আসতে পারেনি। আর আমরা যদি শীর্ষস্থানীয় মেঘাশ্রী বরা এবং মনীষা মালাকার (দশম স্থানে থাকা ছাত্রদের মধ্যে একজন) এর সঙ্গে তার তুলনা করি, তাহলে আমরা বিষয়টা এভাবে খুঁজে পাই,

মনীষা মালাকারের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এমআইএল’ এ রয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর, যা শীর্ষ দশে স্থান করে নিতে তাকে সাহায্য করেছিল। অথচ শ্যামলীর ক্ষেত্রে এই এমআইএল’র জন্যই তার সামগ্রিক পার্সেন্টেজ নিচে নেমে এসেছে। শ্যামলীর এমআইএল ছিল বাংলা।

শ্যামলী এখানে এক উদাহরণ মাত্র! শ্যামলীর মত আরো অনেক ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে বরাক উপত্যকায়, যারা আরো ভালো ফল করতে পারত কিংবা মেধা তালিকায়ও নিজের স্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হতো, যদি তারা বাংলায় আরও বেশি নম্বর পেত।

বাংলাতে কেন ছাত্রছাত্রীরা বেশি নম্বর পেল না? এর পেছনের কারণটা কি? অসমিয়া না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, যেখানে হিন্দি ও বড়ো ভাষায় ছাত্ররা এতটা লেটারমার্কস পেল, সেখানে বাংলায় লেটার পেয়েছে মুষ্টিমেয় ক’জন। তারচেয়েও বড় কথা, যারা অন্যান্য বিষয়ে ১০০, ৯৯, ৯৫ পেয়েছে তারাই আবার বাংলায় পেয়েছে ৬৫। এটা কি কোনও ধরনের বৈষম্য, নাকি বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা, না অন্য কিছু- এর কারণ অনুসন্ধান করতে আমরা বেশ কয়েকজন বিদ্বজনের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কি বললেন তপোধীর ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, জয়দীপ বিশ্বাস, সজলেন্দু দাস লস্কর, মন্দিরা দাস গুপ্ত, হিতব্রত ভট্টাচার্য, সুশান্ত কর প্রমুখ?

সম্পাদিত অংশ তুলে ধরা হলো,

তপোধীর ভট্টাচার্য
প্রাক্তন উপাচার্য,আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, কবি, সাহিত্যিক

আমরা তো বাংলা নিয়ে অনেক কিছু করছি, এমনকি প্রাণ দেওয়ার কথাও বলছি, তাহলে নম্বরের ক্ষেত্রে কেন বাংলায় বেশি পাচ্ছে না ছাত্রছাত্রীরা? এখানে অনেকগুলো ব্যাপার রয়েছে। প্রথমে এই ছেলেমেয়েরা সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণী থেকে যে বাংলা পড়ে বা বলা ভালো, পড়ানো হয় কিংবা চাপিয়ে দেওয়া হয় সেটার মধ্য দিয়ে বাংলা সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্যের যে প্রকৃত স্বরূপ, সে সম্পর্কে তাদের কোন সত্যি ধারণা হয়? নাকি ইচ্ছে করেই এখানে যে আধিপত্যবাদী শক্তি, সে গোড়ায় গলদ করার জন্য যাতে করে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা কিংবা প্রীতি বাঙালিরাই হারিয়ে ফেলে, সে ব্যবস্থাই করছে? কাজেই নবম, দশম বা একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের সিলেবাসটা দেখতে হবে। আমরাও তো বাংলা পড়েছি। কিন্তু তখন তো আমাদের এরকম কোন সমস্যা হয়নি?

দ্বিতীয়তঃ আত্মপ্রশ্নেরও দরকার আছে। যারা বাংলা বিষয়টি পড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্কুলে কিংবা কলেজে, তারা কিভাবে পড়াচ্ছেন, কি পড়াচ্ছেন, কি মেথডে পড়াচ্ছেন? যদি আমরা এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল না হই কিংবা এ প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজি, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলায় কেন লেটার পাচ্ছে না , তার উত্তরও আমরা পাবনা।

এছাড়াও আছে আনুষ্ঠানিক দিক। সেটা বলতে গেলে তো অভিযোগের তর্জনী তুলতে হয়! যারা এর পেছনে আছেন, যেহেতু বাংলা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, তাই যারা বাংলা পড়ান, বলতে হয় এটি তাদেরই কীর্তি। আর এসব কীর্তির ফলে যদি আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষার প্রতি সব ধরনের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে!তাহলে! আমার নিজের ভাইয়ের ছেলে ছোট বেলায় আমাকে ( যে সারাজীবন বাংলা নিয়েই কাজ করেছে ) বলেছে, বিষয় হিসেবে বাংলা না নিয়ে হিন্দি নিলে ‘চাকা চাকা’ মার্কস পাওয়া যায়। এ কথাটা উল্লেখ করলাম, কারণ এটা শুধু আমার ভাইপোর কথা না! এ প্রজন্মের সবার কথা! তাহলে কেন তাদের বাংলার প্রতি ভীতি জাগলো? আমরা ফলটা দেখছি, কিন্তু ফলটা কি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হলো, সেটা যদি বিচার না করি, এটা কি একপেশে বিচার হয় না? এখানে আমারও একটা পাল্টা প্রশ্ন রয়েছে।

অমলেন্দু ভট্টাচার্য
প্রাক্তন অধ্যাপক, গবেষক

১৯৯৯ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম, সেই চিঠিটির এখনো আমার কাছে অফিশিয়াল প্রমাণও রয়েছে। সেই চিঠিতে আমি লিখেছিলাম যে, বাংলায় যেভাবে পঠন-পাঠন হয়, সেটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক।

তাই এক্ষেত্রে প্রথমেই আমি বলতে চাই, এইযে বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদের অনাগ্রহ, সেই অনাগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে সিলেবাস। কারণ পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে গেলে দুটো বিষয় মাথায় রাখতে হয়, এর মধ্যে প্রথমত হচ্ছে, এর থেকে শিক্ষালাভ কতটুকু হবে এবং দ্বিতীয়তঃ, বইটা ছেলে মেয়েরা কতটুকু উপভোগ করতে পারবে। সিলেবাসগুলো এক পরিণত মানসিকতা থেকে করা হয় এবং এর ফলে বাচ্চাদের কাছে বিষয়টি যাচ্ছেতাই ব্যাপার হয়ে উঠে। কারণ একই সিলেবাসে বিদ্যাপতির কবিতা থেকে শুরু হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় গিয়ে শেষ হওয়া – তা অত্যধিক।

পরীক্ষার নম্বরের ব্যাপারে বলতে পারি, অধিকাংশ বাংলা শিক্ষকের মধ্যে এক অদ্ভুত মানসিকতা কাজ করে। সাহিত্যে পূর্ণ নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়, এ কথাটা যে কোথায় লেখা আছে কিংবা কে এর আবিষ্কার করেছে, তা আমার জানা নেই। আমার অধ্যাপনার জীবনে আমি কখনো এভাবে সমঝোতা করিনি। এবারের মাধ্যমিকের পরীক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের লেটার না পাওয়ার জন্য আমি সম্পূর্ণ দায়ী করবো শিক্ষককে।

সজলেন্দু দাস লস্কর
প্রাক্তন অধ্যাপক, এপিএসসি’র সদস্য

পড়ুয়াদের খাতা যারা চেক করেন, তাদের এতটা কৃপণ হওয়া উচিত নয় । আমাদের বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের মেধা এত কম নয় যে, তারা ভালো নম্বর পেতে পারে না‌। প্রায় তিন দশক পরীক্ষক থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি বলতে চাই, আমাদের দুই তিন দশক আগের গোঁড়া মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। এখন ছোট ছোট প্রশ্ন থাকে যাতে, পুরো নম্বর পাওয়া খুবই সম্ভব। ‘সাহিত্য বিষয়ে পুরো নম্বর দেওয়া যায় না’, এই গোঁড়ামি থেকে পরীক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে।

জয়দীপ বিশ্বাস
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ

মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে কম নম্বর পাওয়ার ব্যাপারটাকে আমি কোনও ধরনের পরিকল্পিত বৈষম্য বলে গণ্য করি না। পাঠ্যসূচি চয়ন থেকে প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করা এবং উত্তরপত্রের মূল্যায়ন সবই তো করছেন বাংলার শিক্ষকরা। বলাই বাহুল্য, এঁরা সবাই বাঙালি। এঁদের এই কালিদাসী আচরণের জন্যই ভুগছে বাঙালি পরীক্ষার্থীরা।

বাংলায় প্রশ্ন পত্র তৈরি করার সময় মাথায় রাখা উচিত যে এটা আধুনিক ভারতীয় ভাষার পত্র। এটা সাহিত্য-পত্র নয়। ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি আছে কিনা তাই এখানে যাচাই করা দরকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’ নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় যে এই কবিতায় কবি বাংলার সৌন্দর্য কীভাবে বর্ণনা করেছেন, তাহলে একজন পরীক্ষার্থী পুরো নম্বর পেতে পারে। কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয়, জীবনানন্দের কবিতার কী কী ধারা এই কবিতায় পাওয়া যায়, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরে পুরো নম্বর পাওয়া খুবই মুশকিল। বাংলা বিষয়ের প্রশ্নপত্রে এমন গোলযোগ চলেছে অনেকদিন ধরে।

একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরা যাক, হলিক্রস স্কুলের অনুভব চক্রবর্তী এবারের পরীক্ষায় সাধারণ গণিতে ১০০, ঐচ্ছিক গণিতে ৯৯, সমাজ বিজ্ঞানে ৯১, ইংরেজিতে ৯৫, বিজ্ঞানে ৯৫ পেয়েছে। এই পাঁচটি বিষয়ে তার গড় প্রাপ্ত নম্বর হচ্ছে ছিয়ানব্বই শতাংশ। সেই ছেলে বাংলায় পেয়েছে ৬৫। এরকম ঘটনা যারা অন্য ভাষা (এম আই এল) নিচ্ছেন, সেই ছাত্রদের ক্ষেত্রে কিন্তু ঘটছে না। এর জন্যই বরাক উপত্যকার যোগ্য পড়ুয়ারা মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছে না।

বাংলা বিষয়ে পাঠ্যসূচি নির্বাচনেও যথেষ্ট গলদ রয়েছে। বাংলা বিষয়ে ছাত্রদের আগ্রহ বাড়ানোর মত কোনও পাঠ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকে না। স্বাভাবিকভাবে আগ্রহটাও কমে যায়।

এরকম চললে অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের একাডেমিক শিক্ষায় বাংলা বিষয় গ্রহণ করতে দেবেন কিনা এ নিয়ে ভবিষ্যতে দু’বার ভাববেন।

সুশান্ত কর
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর
তিনসুকিয়া কলেজ

ভাষাশুদ্ধি নিয়ে সাধারণ শুচিবায়ুটাও দায়ী কিনা ভাবা যায়! তবে অধিকাংশ বাংলা শিক্ষক সম্পর্কে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা নেই! নিজেদেরও লেখাপড়া বিশেষ নেই! এটি বাঙালি সমাজের সমস্যা! সেদিন আমার এক সহকর্মী, বিজ্ঞানের অধ্যাপক, গুরু গম্ভীর হয়ে বলছিলেন, ভারতবর্ষের সমস্যা হচ্ছে গণতন্ত্র! ইংল্যাণ্ডে দেখেছেন, রাজতন্ত্র! কোনো নির্বাচন হয় না! তাই ওরা এতো উন্নতি করতে পেরেছে! সহকর্মীটি এককালে আমারই ছাত্র ছিল! নিষ্ঠাবান সৎসঙ্গী! এরকম শিক্ষক ব্যতিক্রম নয়! এটাই নিয়ম! পাঠ্যপুথিতে অসমিয়া অনুপ্রবেশ নিয়ে যতটা হল্লা হয় বরাকে ততটা এইসব বাকি বিষয় নিয়ে হয় না। অসমিয়া অনুপ্রবেশটাও হয় বাঙালিদের হাতেই, বাকিটা হয়— আমলা তান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্যে। ফলে এই নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আর সেটি ভালো করতে পারে বরাক বঙ্গ। প্রথমে বরাকে, পরে গোটা অসমেই। গোটা অসম নিয়ে ভাবতেই হবে। কারণ সংখ্যায় বেশি বাঙালি এই উপত্যকাতেই থাকেন। আর এরাই প্রশ্নও করেন, খাতাও দেখেন, পাঠ্যপুথিও তৈরি করেন, পড়ানও। এদের বাদ দিয়ে অবস্থা পাল্টাবে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, বাঙালির বরাক কেন্দ্রীক ভাবনা নিজেই আত্মঘাতি।

মন্দিরা দাসগুপ্ত
প্রধান শিক্ষক, কলেজিয়েট স্কুল

বাংলার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণটা আসলে এখন অনেকটা কমে গেছে। বাংলা বইও ছাত্র-ছাত্রীরা আর এখন পড়তে চায় না। টিভিতেও হিন্দি আর ইংরেজি ভাষায় সবকিছু দেখছে। বাংলা ভাষাটা তো এমনিতেই কঠিন। কাজেই ভালো করতে গেলে একটু বেশি খাটতে হয়। তুলনায় কম স্কোর হয় বলে ছাত্র ছাত্রীরা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে।

আর আমি যদি আমাদের সময়ের সঙ্গে তুলনা করি, তবে বলতে হয় তখন তো বাংলায় লেটার পাওয়ার কথা চিন্তাও করা যেত না। কিন্তু এখন অনেক লিবারেল হওয়ায় তুলনামূলক ভাবে অনেক ভালো ফল হচ্ছে। তবে অন্য ভাষার তুলনায় একটু কঠিন ভাবেই পেপার চেক করা হয় বলে মনে হয়। হিন্দি বা অন্য ভাষায় স্কোর করা সহজ হচ্ছে এটা তো আছেই, তাছাড়াও আরো কিছু কারণ আছে, যেমন মাধ্যমিকের পর ছেলে মেয়েরা কোনও নির্দিষ্ট লাইন ধরে পড়বে, তাই বাংলাটা ততটা প্রয়োজন নেই বলে ভাবছেন অভিভাবকরা। কোনো সময় আবার মা সিবিএসসির স্টুডেন্ট ছিলেন বলে বাংলা পড়াতে পারবেন না, তাই নিজের ছেলেমেয়েদের বাংলা নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।

বাংলা ভাষা চর্চাও আর তেমন হয় না। ঘরেও বাচ্চাদের সঙ্গে বাংলার চাইতে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করছেন অভিভাবকরা। তাই আজ যে বাংলার এই অবস্থা এ জন্য কিন্তু পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী।

হিতব্রত ভট্টাচার্য্য
আকাশবাণী, শিলচর

১৬ ই মে সব স্থানীয় কাগজে হেডলাইন “মাধ্যমিকে মেধাহীন বরাক”। বুকে আগুন ধরানো কথা। কিছু সদাব্যস্ত ‘বুদ্ধিজীবী’ সঙ্গে সঙ্গে কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে অসমিয়া আগ্রাসন জাতীয় তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করলেন। কিন্ত ব্যাপারটা একটু তলিয়ে ভাবুন। বরাকের ৯০ শতাংশের বেশি ছাত্র ছাত্রীর এম আই এল বাংলা। আর বাংলাতে নম্বর পাওয়া মানে হাড় কিপটে বুড়োর কাছ থেকে টাকা আদায় করা। বাংলার সম্মানিত পরীক্ষকেরা হয়তো নম্বরকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি ভাবেন। তা তাঁরা ভাবতেই পারেন। কিন্তু এদিকে প্রতিযোগিতার বাজারে যে বেচারা পরীক্ষার্থীর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে যায়! গত পঞ্চাশ বছর ধরে সবাই জানে বাংলায় নম্বর পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয় বাপু, লিটারেচার সাবজেক্ট, পুরো নম্বর কি দেওয়া যায়? সাহিত্যে ভালোর তো শেষ নেই, কাজেই পুরো নম্বর নৈব নৈব চ। এদিকে পাশাপাশি অন্যান্য সাহিত্যের, যেমন অসমিয়া, বড়ো, মণিপুরি, হিন্দি এগুলোর মাস্টার মশাইরা কিন্তু ঢালাও নম্বর দিচ্ছেন। গুচ্ছ গুচ্ছ লেটার আসছে। তাঁরা ভাবছেন এরকম করলে তাঁদের ছাত্ররা এগিয়ে যাবে।

অন্যদিকে বাংলার পরীক্ষকেরা বলছেন ” নম্বর দেব কাকে? এরা তো কিছুই শেখেনা, লিখতেও পারে না।” কেন পারে না? সহপাঠী অন্যরা পারলে এরা পারে না কেন? সিলেবাস কি ছাত্রবন্ধু? পাঠ্যবই কি ছাত্রদের আকর্ষণ করে? সবগুলোর উত্তর হবে ‘না’। এগুলো কে তৈরি করছে? বাঙালিরাই তো? তাহলে আগ্রাসন এল কোত্থেকে? মূলে আছে ‘আত্মঘাতী বাঙালীর’ আত্মঘাতমূলক মানসিকতা। যার বলি হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

Comments are closed.