Also read in

শিলচর ডি এস এর সচিব পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন বিজেন্দ্র, জানালেন 'দু'বছরের কুলিং পিরিয়ডে যাচ্ছি'

না, কোনো জল্পনা নয়। বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং আজ আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলেন, শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার নতুন কর্ম সমিতিতে তিনি আর সচিব পদে থাকছেন না। আসন্ন বি জি এমে সচিব পদের লড়াই থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকে নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছে। মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রথম আসন্ন বিজিএম নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করলেন বিজেন্দ্র। জানিয়ে দিলেন, দু বছরের কুলিং পিরিয়ডে যাচ্ছেন। তবে এই সময়ে ডিএসএ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবেন না। এতদিন যেভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন, ঠিক সেভাবেই জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবেন।
বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং বরাবরই পেশাদার। পোড়খাওয়া ক্রীড়া সংগঠক। যে কাজটাই করেন না কেন, তাতে পেশাদারিত্বের ছাপ থাকে। আবেগিক হয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আজ সচিব পদ থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা করার সময়ও আবেগ তাকে ধরা দেয় নি। নিজের মুখেই সাড়ে তিন বছরের তার কার্যকালের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরলেন। জানাতে ভুললেন না ব্যর্থতার কথাও।

সাড়ে তিন বছরের কার্যকালে শুরু থেকেই বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং কে। তবে তিনি তার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। ‌ আসাম অলিম্পিক সংস্থার সঙ্গে বিবাদ, মহামারী কোভিড তারপর প্রলয়কারী বন্যার পরও কিন্তু একের পর এক উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন বিজেন্দ্র। সচিব হিসাবে তার কার্যকালে শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিকাঠাময় আমূল পরিবর্তন এসেছে। একথা বিজেন্দ্রর ঘোর বিরোধী ও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

কী না হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে। ঝা চকচকে প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে গেস্ট রুম, লাইব্রেরি কাম আর্কাইভ, গোটা স্টেডিয়াম চত্বরে সিসি ক্যামেরা ইনস্টলেশন, আধুনিক জিমনাসিয়াম হল, শাখা সচিবদের রুম এবং পুরুষ ও মহিলা খেলোয়াড়দের জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্লেয়ার্স হোস্টেল। এখানেই শেষ নয়, ডিএস এর মূল প্রবেশ পথ নতুন করে ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে প্লেয়ার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড গঠন, সবকিছুই হয়েছে বিজেন্দ্র প্রসাদ সিংয়ের নেতৃত্বে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তিনি। প্লেয়ার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে বিভিন্ন সময়ে খেলোয়ারদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে খেলোয়াড়দের। ক্লাব ওয়েলফেয়ার ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এ থেকে এখন পর্যন্ত গত সাড়ে তিন বছরে ৭ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থাকে সাহায্য করা হয়েছে। ব্যাংকের একাউন্টে ১০ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছে। যার সুদ বাবধ প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা সংস্থা পেয়ে যাচ্ছে।

সচিব হিসেবে বিজেন্দ্রর কার্যকালে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। ক্রিকেট সহ টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন অ্যাথলেটিক্স ইভেন্টে নজর কাড়া সাফল্য পেয়েছেন শিলচরের খেলোয়াড়রা। এক মৌসুমে রেকর্ড সংখ্যক ক্রিকেট ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা। প্রায় দেড় দশকের খরা কাটিয়ে গত বছর সিনিয়র আন্তজেলা ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল শিলচর। এরপর শহরে ফেরার পর চ্যাম্পিয়নদের রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিল ডি এস এ। এবারও দল ফাইনাল খেলেছে। যদিও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তবে সিনিয়র আন্তজেলা ক্রিকেটের টানা দু মৌসুম ফাইনাল খেলা শিলচরের ক্রিকেটের জন্য বিরাট প্রাপ্তি।

টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টনে দারুন সাফল্য পেয়েছেন দ্বিবিজা পাল, সুরজ গোয়ালা এবং বনিপ সিনহারা। আন্তজেলা সার্কিটে অ্যাথলিটদের উৎসাহ দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন বিজেন্দ্র। সেই অনুসারে আন্তজেলায় ভালো পারফর্ম করা অ্যাথলিটদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ‌ এটা চালু করায় সুফলও মিলছে হাতে-নাতে। সব মিলিয়ে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও সচিব হিসেবে বিজেন্দ্রর কার্যকালে নজর কাড়া সাফল্য এসেছে। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আসাম ক্রিকেট সংস্থার সঙ্গে গত সাড়ে তিন বছরে শিলচর জেলা সংস্থার সম্পর্ক আরো ভালো হয়েছে। এর জন্য কৃতিত্ব বিজেন্দ্রর। যখনই দরকার খেলোয়াড়দের স্বার্থে তিনি মুখ খুলেছেন। আগে কিন্তু এমনটা হতো না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল এন এফ রেলের সাসপেনশন। শিলচরের বিরুদ্ধে ইচ্ছা করে ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ায় কোচ সহ রেল দলকে সাসপেন্ড করেছিল এসিএ। প্রথমবারের মতো এমনটা ঘটেছিল। সেটা হয়েছিল সচিব হিসাবে বিজেন্দ্রর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য। এরপর বিভিন্ন সময়ে অসম ক্রিকেট সংস্থা শিলচর ডি এস এ কে নানাভাবে সাহায্য করেছে। ১৬ স্টেশন জিম দিয়েছে। দুটি রোলার দিয়েছে। ক্লাব কাপের ফাইনালের আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছে। ‌ ইনডোর ক্রিকেট পিচ তৈরি করে দিচ্ছে। শীঘ্রই এই ইনডোর ক্রিকেট পিচের কাজ শুরু হবে। তবে নিজের কার্যকালের সাফল্যের সমস্ত ক্রেডিট একা নিতে রাজি নন বিজেন্দ্র। তাঁর মতে, গত সাড়ে তিন বছরের সময়কালে যতটুকু সাফল্য এসেছে তাতে সংস্থার প্রত্যেক সদস্যের অবদান রয়েছে। এজন্য তিনি প্রত্যেক সদস্যকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। সেইসঙ্গে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তাদেরও যারা বিভিন্ন সময়ে স্পনসর হিসাবে এগিয়ে এসেছেন।

এত কিছুর পরও যখন কেউ সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তাহলে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়, কোনো চাপে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তো? জবাবটা সোজা ব্যাটে দিলেন বিজেন্দ্র। তিনি বলেন, ‘দেখুন, আনুষ্ঠানিকভাবে আমি কখনো কিছু বলিনি। এই প্রথম মুখ খুলেছি। আর এই সিদ্ধান্তটা আজকের নয়। আমি অনেক আগেই মানসিকভাবে এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ‌ সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি তো জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে সরছি না। শুধু কোনো পদে থাকছি না। গত ২১ বছর ধরে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। আগামীতেও করে যাব। আমার হাতে দুটি স্পোর্টস প্রজেক্ট রয়েছে। সেটা আগামীতে খোলসা করব। এই মুহূর্তে আমি সেই দুটি কাজের দিকেই মনোনিবেশ করতে চাই।’

সম্প্রতি সংস্থার পৃষ্ঠপোষক প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবের আবক্ষ মূর্তি বসানো নিয়ে কম রাজনীতি হয়নি। আম্পায়ারিং এর জন্য তিনি শহরের বাইরে থাকায় গত ২৬ মে-র অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি বিজেন্দ্র। তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। আজ তা নিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন ডি এস এর ‘বিদায়ী’ সচিব। তিনি বলেন, ‘মূর্তির ব্যাদি নির্মাণ থেকে শুরু করে ফলকের লেখাটাও তো আমি তৈরি করেছিলাম। আবক্ষ মূর্তি বসানোর যাবতীয় প্রস্তুতির কাজ আমি সেরে রেখেছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সচিব হিসেবে যদি আমার ইচ্ছে না থাকতো তাহলে কিন্তু সন্তোষ মোহন দেবের মূর্তি কেউ বসাতে পারতেন না। মনে রাখবেন, আমি সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলাম আমার কার্যকালেই সন্তোষ মোহন দেবের মূর্তি বসবে। ‌ অথচ মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তটা কিন্তু ২০১৭ সালের জিবি তে নেওয়া হয়েছিল। আমি বাইরে থাকলেও সভাপতির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলাম। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে সেদিন অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ আর আমার অবদানের কথা তুলে ধরেননি।’

সেদিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডি এস এর কর্মপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তৃণমূলের সাংসদ তথা প্রয়াত সন্তোষ মন দেবের কন্যা সুস্মিতা দেব। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ সেরে নেয় জেলা ক্রীড়া সংস্থা।’ আজ সুস্মিতাকে একহাত নিয়ে বিজেন্দ্র বলেন, ‘সুস্মিতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলার অধিকার নেই। ডি এস এ কিভাবে কাজ করবে, তার জন্য কারোর পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই। আজ পর্যন্ত যত অনুষ্ঠান হয়েছে তার নিমন্ত্রণ কার্ডের মাধ্যমে করা হয়েছে। আর সংস্থার কাজকর্মের সুবিধার জন্যই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আদান-প্রদান হয়। সংস্থার প্রত্যেক সদস্যই এমনটা করার জন্য আমায় বলেছিলেন। এর ফলে প্রত্যেকের কাছে ইনফরমেশন পৌঁছে যায়। কাজেই এ নিয়ে কারোর কোন পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই।’

ব্যর্থতা প্রসঙ্গে হকি ও ফুটবলের কথা তুলে ধরেন সচিব। তিনি জানান অনেক চেষ্টা করেও হকির জন্য এস্ট্রো টার্ফ বসাতে পারেননি। এর জন্য প্রধান বাধা ছিল অর্থ। ‌ ফুটবল প্রসঙ্গে জানান, অনেক টাকা খরচ করে রুরাল ক্যাম্প শুরু করেছিলেন। বেশ কিছু উঠতি ফুটবলার ও তুলে আনা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ফলোআপ করতে পারেননি। সচিব হিসাবে এটা তার ব্যর্থতা। আগামীতে ফুটবলের উন্নয়নের জন্য শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও শিলচর ফুটবল একাডেমিকে একযোগে কাজ করার পরামর্শ ও দিয়েছেন বিজেন্দ্র। তিনি আরও জানান, বেশ কিছু সময় থেকেই অকেজো হয়ে রয়েছে ফ্লাড লাইটের একটা পোল। এছাড়া আরো দুটো পোলের লাইটের অবস্থা ভালো নয়। এ নিয়ে শীঘ্রই কাজ করা দরকার। তবে এখানেও অর্থের অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
নিজের সাড়ে তিন বছরের কার্যকালে গত ছয় মাসের কথা ছেড়ে দিলে কোনো সরকারি অনুদান পাননি সচিব বিজেন্দ্র। শাসকগোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়া যে পরিকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব নয় সেটাও মনে করিয়ে দেন তিনি। জানান, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকাণ্ডে শাসক গোষ্ঠীকেও জড়িয়ে রাখতে হবে।‌ এছাড়া পরিকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সবশেষে তিনি একটি কথাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চান। ‌ বিজেন্দ্রপ্রসাদ সিং এর কাছে ডেভেলপমেন্ট ওই শেষ কথা। তার কার্যকাল শুরু হয়েছিল ডেভেলপমেন্ট দিয়ে। আর শেষটাও তিনি ডেভেলপমেন্ট দিয়েই করতে চান।

Comments are closed.