কোভিড কন্ট্রোলে প্রশাসনের 'গরিব-বিরোধী' নীতি, কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা!
গ্রামের অর্থনীতি লকডাউনের ফলে প্রায় বিধ্বস্ত, এগুলো চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে এখনও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, বা নেবার সময় হয়নি প্রশাসনের। সম্প্রতি জেলাশাসক কীর্তি জল্লি নির্দেশ দিলেন সাপ্তাহিক, অর্ধ-সপ্তাহিক এবং বিকেলে বসা বাজারগুলো ১০ দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। এর কারণ, সাধারণ মানুষ লকডাউন মানছেন না এবং বাজারের নামে জনসমাগম হচ্ছে। তবে এই নির্দেশের বাইরে রাখা হল ফাটকবাজার সহ শিলচর শহর এবং জেলার বড় মাপের বাজারগুলো। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, ভিড় কি শুধুমাত্র সাপ্তাহিক, অর্ধ-সপ্তাহিক এবং বিকেলে বসা বাজারগুলোয় হয়? ফাটকবাজার বা অন্যান্য বড় আকারের বাজারগুলোয় হয়না?
ছোট দুধপাতিল গাও পঞ্চায়েতের সভাপতি রঞ্জিত সরকার যিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন এই নির্দেশ গ্রামবাসীর জন্য অভিশাপের মতো। তিনি বলেন, “এই নির্দেশে গ্রামের ক্ষুদ্র স্তরের কৃষক এবং মৎস্য বিক্রেতারা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমাদের গ্রামে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা বিভিন্ন মরসুমে নিজেদের বাড়িতে সব্জি ফলান এবং এগুলো বিকেলে বসে বাজারে বিক্রি করেন। এভাবেই তারা ঘর চালান। এই করোনা পরিস্থিতিতে গ্রামের অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করা হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষ চেষ্টা করছেন নিজেরা আবার স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসতে। যারা ছোটখাটো কৃষি কাজ করে ঘর চালানোর চেষ্টা করছেন তাদের ক্ষেত্রে এই নির্দেশ অভিশাপের মতো। গ্রামের বাজার বন্ধ করে দেওয়াতে যেগুলো শাকসব্জি ফলন হচ্ছে সেটা বিক্রি করার জায়গা শুধুমাত্র শহরের বড় বড় বাজার। আমাদের ছোট কৃষকরা এগুলো নিয়ে শহরে গিয়ে বিক্রি করার সুযোগ পাবে না। আমরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারিনা, তবে অবশ্যই জেলাশাসক মহোদয়ার কাছে এব্যাপারে আবেদন জানাবো। আমার মনে হয় এভাবে বাজার বন্ধ করে না দিয়ে, বাজারে এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরে পারস্পরিক দূরত্ব বজায়ের অভ্যেস তৈরি করা বেশি ফলপ্রসূ হবে।”
প্রশ্ন হচ্ছে যদি জনসমাগম কম করার জন্যই বাজার বন্ধ করতে হয় তবে ফাটকবাজার এবং শিলচর শহরের অন্যান্য বড়বাজার গুলো কিভাবে ছাড় পায়? প্রাক্তন সাংসদ সুস্মিতা দেব যিনি বর্তমানে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তিনি সেখান থেকে ফোনে আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “আমি জেলাশাসকের নির্দেশের কপি পেয়েছি, সেটা পড়ে আমার হাস্যকর মনে হয়েছে। যদি জেলাশাসক জনসমাগমের কথাই বলেন, তবে শহরের জনসংখ্যা গ্রাম থেকে বেশি এটা জেনে রাখা উচিত। অথচ তিনি শুধুমাত্র সাপ্তাহিক, অর্ধ সাপ্তাহিক এবং বিকেলের বাজার বন্ধ করলেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রামের অর্থনীতির ওপর আরো বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যারা নিয়ম-বানান তাদের যদি গরিব শ্রেণীর প্রতি এইটুকু সহমর্মিতা না থাকে, তবে সাধারণ মানুষকে ঠকানো হয়। আমি সুস্থ হয়ে ফিরে এলে জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে এব্যাপারে কথা বলতে চাই।”
তবে সুস্মিতা দেব জেলায় নিজস্ব যানবাহনে জোড় বেজোড় নীতি আরোপ করার প্রশংসা করেছেন।
অসম বিধানসভার উপাধ্যক্ষ তথা সোনাইয়ের বিধায়ক আমিনুল হক লস্কর মনে করেন সামাজিক দূরত্ব বজায়ের জন্য কিছু নিয়ম নীতি প্রয়োজন, তবে নিয়ম সকলের জন্য সমান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “কাছাড় জেলার সব থেকে বেশি সব্জি উৎপাদন হয় সোনাই বিধানসভার বিভিন্ন এলাকায়। সোনাই স্থানীয় উৎপাদনের হাব হিসেবে পরিচিত। নতুন নির্দেশে যেসব বাজার বন্ধ হচ্ছে এর মধ্যে বেশ কিছু রয়েছে সোনাই অঞ্চলে। আমরা এব্যাপারে জেলা শাসকের সঙ্গে আলোচনা করব।”
লক্ষীপুরের বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালা বলেন, করোনা ভাইরাসের আক্রমণ এখন আগের থেকে অনেক কঠিন রূপ নিয়েছে। রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা আগের থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন নিয়ম নীতি পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। তবে একই সঙ্গে গত কয়েক মাসের লকডাউনে গ্রামীণ অর্থনীতি পিছিয়ে পড়েছে। ফলে হঠাৎ করে বাজার বন্ধ করে দিলে হয়তো অনেকেই অসুবিধার সম্মুখীন হবেন। গ্রামের অর্থনীতি দুর্বল হলে এর প্রভাব পুরো সমাজে পড়বে। আমি জেলাশাসকের নির্দেশকে সম্মান জানাই, তবে পাশাপাশি এটুকু বলতে চাই, প্রশাসনের কোনও নির্দেশ জারি করার আগে ভালো করে সব দিক যাচাই করা উচিত।
সিপিআইএমের কাছাড় জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক দুলাল মিত্র বলেন, “এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় যে গ্রামীণ বাজারে শহরের বাজার থেকে জনসমাগম বেশি হয়। এই নতুন নির্দেশের ফলে যারা গ্রামে-গঞ্জে বাজার করতেন তাদের এখন শহরে আসতে হবে। একইভাবে বিক্রেতাদের নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে শহরের বাজারের দিকে এগোতে হবে। জেলাশাসক নির্দেশ দিয়ে দিলেন, কিন্তু একজন লোক, যার নিজের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি না করলে খাবার জোটে না, সে ঘরে বসে থাকতে পারবে না। এই কয়েক মাসে এমনিতেই গ্রামের মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে, এখন এধরনের নীতি বানিয়ে এদের আরও অসহায় করে দেওয়া হচ্ছে। এটা প্রশাসনের গরিব বিরোধী নীতি। আমাদের কথায় প্রশাসনের নীতিতে কোন প্রভাব পড়ে কিনা জানিনা, তবে আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানাই, গরীবের বিরুদ্ধে এভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন না। দশ দিন বাজার বন্ধ করে দিলে, গ্রামের মানুষ উৎপাদিত সব্জিগুলো নিয়ে কি করবে? এই প্রশ্নের উত্তর জেলা শাসকের কাছে আছে কি?”
কিছুদিন আগে ফাটকবাজার এলাকায় রাস্তার পাশে বসা বিক্রেতাদের উঠে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। অথচ এলাকার বড় বড় দোকানগুলো খোলাই থাকলো। যদি জনসমাগমের জন্য বাজার বন্ধ করতেই হয় তবু নির্দেশ একাংশের প্রতি প্রযোজ্য এবং একাংশের জন্য নয়, এমনটা যেন বারবার চোখে পড়ছে।
Comments are closed.