Also read in

পয়লা বৈশাখ: শিলচরে তখন এবংপরবাসে এখন

পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। বাঙ্গালির প্রিয় দিনও বটে। পয়লা বৈশাখের কথা ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতি প্রিয় একটা ছবি। বাংলা সালের প্রথম দিনে বাবার হাত ধরে দোকানে দোকানে মিষ্টি খাওয়ার কথা আজও মনের কোণে খুব আদরে লালিত। আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে দোকানে দোকানে নতুন হিসাব বই বা হালখাতা শুরুর রেওয়াজ ছিল। বছরের প্রথম দিন গণেশ পুজো করে শুভারম্ভ হত। যে কোনো পুজোয় যেমন গণেশ পুজো দিয়ে শুরু হয়, তেমনি বছরের প্রথম দিনও গণপতির পুজো দিয়ে শুরু হয়। তাই সেই দিনে দোকানের মালিক সবাইকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। আমাদের কাছে অন্য আরো অনেক আকর্ষণের মধ্যে এই মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজটা অন্যতম ছিল। এখন অনেকে আর্থিক বছরের শুরুতে ১ এপ্রিল কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার দিন হালখাতা শুরুর পর্বটি সেরে ফেলেন। তাই এখন পহেলা বৈশাখের দিন সেই ভিড়টা আর জমে উঠে না।
নববর্ষ পালনের প্রস্তুতি শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। বিশেষভাবে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গাঁজন উৎসবের অঙ্গ হিসেবে চড়ক পুজা নববর্ষ পালনের এক বিশেষ প্রস্তুতি। কিছুটা যেন অধিবাস পালনের মত। তবে এই চড়ক পূজার আয়োজন কিন্তু শুরু হয়ে যায় এক মাস ধরে ঘরে ঘরে এসে শিব-গৌরী আর কালী নাচের মাধ্যমে। সংক্রান্তির দিন নিমপাতা আর হলুদ বাটার মিশ্রন গায়ে মেখে স্নান করার রেওয়াজ রয়েছে। সঙ্গে ওই দিনে টক আর তেতো খাওয়ার নিয়ম বাঙালি মনে করে পালন করে।

মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার, বাবার দেওয়া নতুন জামা কাপড় পরা, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে হৈ হুল্লোর- সব মিলিয়ে আমাদের ছোটবেলায় বছরের প্রথম দিন খুশির আল্পনায় রাঙ্গিয়ে উঠত।

এদিন প্রায় সবার ঘরে খুবই ভাল খাওয়া দাওয়া হয়। যাদের সামর্থ এত বেশি নেই তারাও চেষ্টা করে একটু ভাল মন্দ খাওয়ার। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় বছরের প্রথম দিন ভাল মন্দ খাওয়া জুটলে সারা বছরই ভাল খেতে পাওয়া যাবে। এই একটা জায়গায় পুরোন দিনের সঙ্গে এখনও মিল খোঁজে পাওয়া যায়। এখনও এই দিনে সবাই ভাল মন্দ খায়। হয়ত ভাল ভাল রান্না করা অনেকের পক্ষে কঠিন বলে ওরা সহজ রাস্তা গ্রহণ করেন। রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিংবা রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেন। এ দিনটাতে মা বাবার কাছে এমনও শুনতাম, পহেলা বৈশাখে ভাল সবকিছু করলে সারা বছর ভাল কিছু করেই কাটবে। এই দিনটার অনেক ভাল দিকের মধ্যে একটা ছিল অল্প বিস্তর দোষ করলেও বড়দের তরফ থেকে খুব বেশি বকুনি মিলত না। কারণ সেই একই, বছরের প্রথম দিন বকুনি খেলে পুরো বছর না একই ভাবে কাটে!
এই দিনটাতে আরও একটা জিনিস যেটা খুব হত সেটা হচ্ছে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড়দের প্রণাম করা আর ছোটদের অফুরন্ত ভালবাসা আর আদরে আবদ্ধ করা। আজকে ব্যস্ততার ইঁদুর দৌড়ে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে এগুলো প্রায় অসম্ভবের ঘরে ঠেলে দিয়েছি। আগে দূরে যারা থাকতেন তাদেরকে চিঠি লেখার রেওয়াজ ছিল। চিঠিটা হয়তো বা বাঁধাধরা বয়ানে লেখা হত কিন্তু সেটাতেও যেন আত্মার বাঁধন দৃঢ় হত, ভালবাসার মিষ্টি অনুভূতিতে মন ভরে যেত। এখন অন্যের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় যেমন লাটে উঠেছে তেমনি চিঠি লেখার রেওয়াজ যেন সেকেলে হয়ে গেছে। আজ ডিজিট্যালের যুগ। এখন ফেসবুক আর হয়াটসঅ্যাপ এর যুগ। তাই ওইসব সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংলিশ বাংলার মিশ্রণে ভাঙ্গা শব্দে স্টেটাস আপলোড করে এবং বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। মেসেজগুলোও আমরা বেশিরভাগ সময় নিজে লেখার কষ্ট করি না বরং মেসেজ ফরওয়ার্ড করতে সুবিধে বোধ করি।

আগে নববর্ষে আমরা নতুন জামাকাপড় পরলেও খুব বেশি কেনা কাটার মোটেই রেওয়াজ ছিল না। মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার মত সাধ কিংবা সাধ্য দুটোই এখনের তুলনায় কম ছিল। এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন চৈত্র মাসের সেল এতটাই জনপ্রিয় যে কোনও বাঁধাই বাধ সাধতে পারে না, কেনাকাটা এবং ক্রেতাদের মধ্যে কোন কিছুরই ঢোকার জো নেই। তাই এখন নববর্ষ পালন যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চাইতেও অনেক আকর্ষনীয় চৈত্রের সেল।

আগে নববর্ষ শুরুর পূর্বেই ঘরে ঘরে এসে যেত বাংলা পঞ্জিকা। অনেকেই উৎসাহভরে সবচেয়ে প্রথমে পঞ্জিকা খুলতেন সারা বছর কেমন যাবে রাশিফলের মাধ্যমে তা জেনে নিতে। অবশ্য রাশিফলে কে কতটা বিশ্বাসী তা বলা মুস্কিল, তবে এই নববর্ষের জন্যই আজকালকার দিনের বাচ্চারা জানতে পারে বাংলায় আলাদা করে একটা পঞ্জিকা রয়েছে।

এতো গেল আগের সঙ্গে এখনের সময়ের পার্থক্য। এখন দেখা যাক যারা বরাক উপত্যকারই কিন্তু এখন বাইরে থাকেন মানে প্রবাসী বাঙ্গালিরা কিভাবে পালন করছেন বাংলা নববর্ষ? প্রথমেই বলে রাখি এই বাছাইপর্ব কোনো নিয়ম মেনে হয়নি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এই উৎসবমুখর দিনগুলোতে নিজের জন্মভূমি তথা বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় শহর শিলচর থেকে দূরে থাকার কষ্টটা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো এক আলোড়নে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। প্রবাসে থেকেও হলুদ নিমবাটা দিয়ে স্নান থেকে শুরু করে নতুন জামা কেনা, বাঙ্গালির প্রিয় মাছ, দই, মিষ্টির আয়োজন সহ সবকিছু বজায় রাখার চেষ্টা করলেও মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি মারে, নিজের জীবনে বাঙ্গালিয়ানা কতটুকু বজায় রাখতে পারছি কিংবা নিজের মেয়েকে দিতে পারছি বাঙ্গালিয়ানায় মোড়া জীবন? অথচ পুনে শহরে বাংলা অধ্যুষিত না হওয়া সত্বেও ধুমধাম করে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পুরো বাঙ্গালিয়ানায় খাওয়া দাওয়া সবই চলে উৎসাহ আর উদ্দিপনায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেশি হলেও ভারতের অনেক প্রান্তের বাঙ্গালিদের মিলন ঘটে সেই অনুষ্ঠানে। সেদিক দিয়ে ব্যাপারটা খুব আনন্দজনক। এতে অংশগ্রহণ করে ভাল না লাগার অবকাশই নেই। কিন্তু এতসবের পরেও কোথায় যেন কি হারিয়ে ফেলার কষ্ট, কোথাও যেন কি ছুটে যাওয়ার ব্যথা! একেই কি বলে স্বদেশে ফেরার আকুলতা কিংবা স্বদেশে না ফেরার ব্যকুলতা?

 

দোলনচাঁপা দে, বিলাসপুর, ছত্তিশগড় 

দোলনচাঁপা দে

নতুন বছর দোরগোড়ায়। এইসব উৎসবের দিনগুলোতে কেমন যেন নষ্টালজিক হয়ে পড়ি। চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোটবেলার দিনগুলো। নতুন জামা পরে সব গুরুজনদের প্রণামের পালা, তারপর ভাই বোন সবাই মিলে আড্ডা ও সেই সাথে খাওয়া দাওয়া। এই প্রবাসে নববর্ষ পালনের সেই আমেজ পাই না। খাওয়া দাওয়া আজও হয় কিন্তু ছোটবেলার সেই অনুভূতিটা আর ফিরে পাওয়া হয় না। কিন্তু স্বামীর কর্মসূত্রে যেখানেই থেকেছি সেখানের বাঙ্গালিরা মিলে নববর্ষে্র দিনটা আড্ডা গানে পালন করেছি। সেটারও এক আলাদা আনন্দ রয়েছে। এভাবেই পুরনো বছরের সমস্ত আবর্জনা দূরে ফেলে দিয়ে নতুন আশা ও উদ্দিপনায় নতুন বছরকে বরণ করি। সবাইকে নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

 

নীলাঞ্জনা পাল, হায়দ্রাবাদ

নীলাঞ্জনা পাল

আমার ছোটবালায় নববর্ষ মানেই ছিল নতুন জামা গায়ে দিয়ে সন্ধেবেলা পাড়ার দোকানে গিয়ে গণেশ পুজো কিংবা হালখাতা পর্ব উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়া……খুব অপেক্ষা করে থাকতাম নববর্ষের জন্য। বাড়িতে দুপুরে ভাল খাওয়া দাওয়া হত। এরপর কলকাতা আসার পর শুধু ভাল খাওয়া দাওয়াটাই বজায় থেকেছে। আর এখন হায়দ্রাবাদে তো খেয়ালই থাকে না সঠিক কবে পড়ে আমাদের সেই ছোটবেলার অতি প্রিয় নববর্ষের দিনটি। বাবা মা, ননদ কেউ কলকাতা, শিলচর থেকে ফোনে মনে করিয়ে দিলে বুঝতে পারি নববর্ষ আসছে। সেই অনুযায়ী ভাল খাওয়া দাওয়া শুধু হয়, ব্যস এই পর্যন্তই! এই দিনটিতে অন্য সব উৎসবের দিনের মত ছোটবেলাকে আর শিলচরেকে খুব মিস্ করি। এখন সারা বছর প্রচুর জামা কাপড় কিনলেও নববর্ষে আর নতুন জামা কেনা হয় না, পরাও হয় না।

শ্রাবন্তী রায় চৌধুরী, দিল্লি

শ্রাবন্তী রায় চৌধুরী

পয়লা বৈশাখের দিন সকালে উঠেই আগে স্নান সেরে নিতাম, তারপর নতুন কাপড় পরে গৃহদেবতার পুজো করতাম আর ঘরের বড়দেরকে প্রণাম করতাম। ওই দিনে নতুন কাপড় পরার একটা আলাদা আনন্দ ছিল। বাবা সাতসকালে বাজারে গিয়ে মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি নিয়ে আসতেন আর মা এসব দিয়ে সুস্বাদু নানাধরনের খাবার বানাতেন যা এখনো মন ছুয়ে যায়। বিকেলে বোনেরা মিলে পাড়ার দোকানে গণেশ পুজোতে মিষ্টি খেতে যেতাম। সেগুলো আজ স্মৃতি মাত্র!
আজ যখন শিলচর থেকে অনেক দূরে রয়েছি তখন ওই উৎসবগুলোর দিনে স্মৃতিচারণে মন উদাস হয়ে যায়। মহানগরীর ব্যস্ত জীবনে মানুষ নিজের সংস্কৃতিকে ভুলতে বসলেও আমি এখানেও ঘরে বাংলা সংস্কৃতিকে বজায় রাখার চেষ্টা করি। বাঙালি অধ্যুষিত না হলেও এখানে একটি বাঙালি ক্লাব রয়েছে যেখানে আমরা সব বাঙালি মিলে আরও অন্যান্য উৎসবের মত নববর্ষও পালন করি।আনন্দ আর উৎসাহের সঙ্গে এখানে পালিত হয় পয়লা বৈশাখ দিনটি। তাছাড়া ঘরেও আমার মায়ের মত করে প্রতিটি নিয়ম পালনের চেষ্টা করি যাতে করে আমার সন্তানরা দূরে থাকলেও বাংলা সংস্কৃতি তথা আচার অনুষ্ঠানগুলো ভালভাবে জানতে পারে। আজ কবিগুরুর একটা গান বার বার আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে।
“ নব আনন্দে জাগো আজ নবরবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে”

কমলিকা রায়, কলকাতা

কমলিকা রায়

আমি বরাক উপত্যকার শিলচরের মেয়ে, আমার শৈশব কৈশোর ও যৌবনের কিছুটা সময় ওখানেই কেটেছে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা খুব ছোট্ট মিষ্টি জায়গা শিলচর , তাই ওখানের ছোট ছোট উৎসব গুলোতেও আনন্দের হাট বসে যেতো , সবাই সেই আনন্দে সামিল হয়ে যেতাম। আজ ১লা বৈশাখ, তাই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। ১লা বৈশাখ মানেই নতুন জামা, ভাল খাওয়া দাওয়া, তাই আমারও নতুন জামা হতো, বাড়িতে মা কাকিমার সারাদিনের পরিশ্রমের ফসল দারুন খাওয়া দাওয়া হতো। কিন্তু সমস্ত মন পড়ে থাকতো বিকেলের নেমন্তন্ন গুলোর দিকে। আমি শিলচরের সেন্ট্রাল রোড এ থাকতাম আর সেই জায়গাটা ছিল শিলচরের প্রাণকেন্দ্র। তাই অনেক দোকান পাট থাকার জন্য নেমন্তন্নও অনেক পেতাম। বিকেলে নতুন জামা পরে দাদুর সাথে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতেই আমার আনন্দ হতো সবচেয়ে বেশি। তখন বসিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল, তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকত বেশি। পেট পুরে খেয়ে আবার বাড়ির সবার জন্য হাতে করে নিয়েও আসতাম, এটার মধ্যে কোনও লজ্জা ছিল না। ছোট জায়গার মানুষ বলেই হয়তো আমাদের ভাবনা চিন্তাগুলোও খুব সহজ সরল ছিল। আজ আমি কলকাতার অধিবাসী , আজও ১লা বৈশাখ আসে , নেমন্তন্নও পাই , রাতে হোটেলে খেতেও যাই পরিবারের সাথে, কিন্তু সেই অনাবিল আনন্দ আর খুঁজে পাই না , সবকিছুই যেন সাজানো। হয়তো আমি ছোট জায়গার মেয়ে বলেই বড় শহরের মেকিপনার সাথে এখনও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। তাই!

মিঠু সাহাদাস, বিশাখাপত্তনম

মিঠু সাহাদাস

‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা’
বাঙালির শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ ! ! কবিগুরুর স্মৃতিকে তার সৃষ্টিতে মনে করার জন্মদিনটির মাস বৈশাখ !নব আনন্দে নব রূপে আরও একটা বছর বরণ করার সময় এটা !প্রবাসে থেকে এখন আগের মতো আর ততটা পয়লা বৈশাখ বানানো হয় না ! এখন মনের ভেতরে ও চিন্তায় বুঝি যে আজ পয়লা বৈশাখ ! কারণ এখানে স্কুল, কলেজ সব খোলা থাকে !যদিও এই বছরটা ভাগ্যক্রমে রবিবার পড়েছে ! সেই জন্য একটু বেশি করে আয়োজন হবে ! খাওয়া দাওয়া ছাড়া সকালে উপাসনা করা, মন্দিরে যাওয়া ,নুতুন কাপড় পরা !

আগে আমরা গনেশ পূজাতে যেতাম ! সব মন্দির এ গিয়ে মিষ্টি ভোগ অর্পণ করে নুতুন কাপড় পরে বড়দের প্রণাম দিয়ে শুরু হতো পয়লা বৈশাখ ! দূরে থাকায় এখন শুধু হোয়াটসঅ্যাপ আর ফোন করে প্রণাম জানিয়ে থাকি ! আগের ওই দিনগুলো আজ হারিয়ে গিয়ে স্মৃতির মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমদেরও পরিবর্তিত হতে হয়। তবু পয়লা বৈশাখের দিনটাতে যতটা পারি বাঙ্গালিয়ানায় কাটাতে ভালবাসি বা চেষ্টা করি।

জুহু চক্রবর্তী, গৌহাটি

জুহু চক্রবর্তী

শিলচরে জীবনে ছিল ঝর্ণার গতি। আর প্রবাসী হয়ে জীবনের গতি হল দীঘির মত। যার এক ধারে হাতী স্নান করলেও অন্য ধারে কোনো হিল্দোল নেই। তাই বাংলা নববর্ষ পালনে এমন কিছু আয়োজন থাকে না এখন। অথচ ছোটবেলায় শিলচরে নতুন কাপড় পরে মায়ের সাথে হালখাতার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য উৎসাহের শেষ ছিল না। এখানে এসে এগুলো কিছুই পাইনি। তবে এ সময়ে এখানে বিহু উদযাপনে খুব উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়। প্রখ্যাত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সঙ্গে বিহু নৃ্ত্য হয়। প্রচুর লোকসমাগম হয়। খাবারের স্টল সহ অনেক দোকান বসে ওইসব অঞ্চল জুড়ে। এখন অবশ্য বিহুর অনুষ্ঠানেও তেমন করে যাওয়া হয় না। এখন নববর্ষ পালনের আয়োজন সীমিত হয়ে এসছে। এদিন একটূ ভাল মন্দ খাওয়া আর এরপরে নববর্ষের প্রণাম জানাতে ভাসুরের বাড়িতে যাই। এটুকুই!
সবশেষে আমরা দেখে নেই বাংলা বর্ষের যাত্রা কিভাবে শুরু হয়। ইংরেজি বর্ষ শুরু হয় মধ্যরাত থেকে, সূর্যাস্ত থেকে শুরু হয় আরবি বর্ষ। আর বাংলা বর্ষের শুরু সূর্যোদয় থেকে।
বাংলা বর্ষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালে। মুঘল সম্রাট আকবর এই বর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন । সম্রাট আকবরের আমলে ইংরেজি ও আরবি সনের পাশাপাশি এক নতুন সন প্রবর্তিত হয় প্রজাদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। সম্রাটের নির্দেশে তৎকালীন বিখ্যাত চিন্তবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি ফসল তোলা ও খাজনা আদায়ের সময় বিবেচনায় রেখে ইংরেজি সৌর সন এবং হিজরি চন্দ্র সনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সনের নিয়ম প্রবর্তন করেন। এই সনের নাম শুরুতে ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়।
সম্রাটের সময়ে চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে মানুষদের খাজনা শোধ করতে হত। পরের দিন পহেলা বৈশাখে নিজেদের অঞ্চলের অধিবাসিদের ভূমির মালিকরা মিষ্টিমুখ করাত। বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। তখনকার সময় পহেলা বৈশাখের প্রধান ঘটনা ছিল একটি নতুন হিসাব বই বা হালখাতা তৈরি করা। এদেশে এখনও হালখাতার প্রচলন রয়েছে। যদিও পরিসর কমে এসেছে।

 

তারপর ধীরে ধীরে নববর্ষ বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ নেয়। বৈশাখ মাসের প্রথমদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। সকল দুঃখ-গ্লানি ও জরা মুছে ফেলে পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে বাঙালি নিজের মত করে।তাই রবীন্দ্রনাথের সুরের অনুরণনে যেমন বলতে পারি “ বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা কর আজিকার মতো, পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।” তেমনি আজ এও বলতে ইচ্ছে করছে” নতুন বছর নতুন আশা, নতুন করে আবার ভালোবাসা। নতুন সূর্য, নতুন প্রাণ, নতুন সুর , নতুন গান, নতুন উষা, নতুন আলো, নতুন বছর কাটুক ভালো, কাটুক বিষাদ, আসুক হর্ষ, শুভ হোক নববর্ষ।।

Comments are closed.