এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ থাকেন আত্মীয় না হলেও যাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক থাকে। আর সে সম্পর্কটা এতটাই দৃঢ় থাকে যে সময়ের ব্যবধান কিংবা দূরত্বের হিসাব কোনো অঙ্ক কষতে পারে না। চামেলীদির সঙ্গে সম্পর্কটা এরকমই ছিল। তাই অঘটনের খবরটায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মানতে চায় না মন।গলার কাছটায় দলা পাকানো কষ্ট কঠিন বাস্তবকে মনে করিয়ে দেয়।
কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে ছবিদির বাড়িতে প্রথম বার অন্তরঙ্গ ভাবে চামেলীদির সঙ্গে কথা বলার সময় এক অমোঘ টান অনুভব করেছিলাম। তাঁর সরলতায় ভরা অমায়িক হাসিটা মন ভরিয়ে দিত।আজ স্মৃতির ঘর থেকে অনেক কিছুই এসে মনের পাতায় ভিড় করছে। আমি চামেলীদির সঙ্গে নিয়মিত কাজ করিনি, আমাদের ঘন ঘন দেখা হত তাও নয়, তবু অদ্ভুত এক টান ছিল, দেখা হলে আনন্দে মন ভরে যেত। ভালোলাগায় জড়িয়ে পড়তাম দুজনেই। আসলে এই ছিলেন আমাদের চামেলীদি। সবাইকে আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিল ৬১ এর এই ভাষা সেনানীর। কতদিন গল্পের ফাঁকে সময় কোথা দিয়ে গড়িয়ে গেছে আমরা বুঝতেও পারিনি। আর সেই গল্পে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা শহীদদের কথা যেমন স্থান পেত তেমনি হাল্কা মেজাজের কথাবার্তায় আসর জমে উঠত ভালোই। চামেলীদির অনেক কিছুর সঙ্গে অমায়িক হাসিটা আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করত।
অনেক বছর বাইরে থাকার ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েক বছরের ব্যবধানে হঠাৎ একদিন শিলচরের এক অনুষ্ঠানে চামেলীদিকে দেখে প্রায় দৌঁড়ে ছুটে গিয়ে খবর নেওয়ার মুখে থমকে দাঁড়ালাম। চিনবেন তো এত বছরের ব্যবধানে? আর ঠিক তখনই আমাকে দেখে তাঁর মুখের অমায়িক হাসি আমাকে বুঝিয়ে দিল সময়ের হিসাব কিংবা দূরত্বের মাপঝোক এসব ক্ষেত্রে কতটা বেমানান। কথাবার্তায় আগের মতোই ভালোবাসার ছোঁয়া স্পষ্ট ছিল। আন্তরিকতায় কোনও কার্পণ্য ছিল না।
৬১ এর ভাষা সেনানী চামেলী কর মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতির জন্মলগ্নের প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকা তাঁর চলে যাবার সময় সহ সভানেত্রী ছিলেন। তিনি একাধারে সফল নাট্যকর্মী, সংগঠক ও প্রযোজক ছিলেন। তাঁর অভিনীত ‘আইজও আন্ধাইর’ সবার মন কাড়তে সমর্থ হয়েছিল। এছাড়াও কপাট, অক্টোপাস,লাল মোহনের সংসার,পথুয়া, ময়ূরপঙ্খী, সীমানা, তপস্বিনী এমন অনেক নাটক রয়েছে যেগুলোর হাত ধরে চামেলীদি অনেক দিন দর্শক শ্রোতাদের মনে বিরাজ করবেন। তাঁর অভিনয়গুণ উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছে আসাম, ত্রিপুরা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।বিভিন্ন নাটক প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে পুরস্কারের তালিকাও কম ছিল না। নাটক ছিল তাঁর অন্ত-প্রাণ।তিনি যেমন ছিলেন সংস্কৃতি কর্মী তেমনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।নিজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন বিভিন্ন সভা সমিতি, মিছিলে। চামেলীদির সম্পর্কে এগুলো তথ্য প্রায় সবার জানা। কিছুটা হয়ত ব্যক্তিগত ভাবে আর তা না হলে সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে হয়ত এগুলো পড়া ইতিমধ্যেই সবার শেষ। চামেলীদি কত বড় শিল্পী ছিলেন সে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তাঁর চলে যাওয়ায় বরাক উপত্যকার কতটা ক্ষতি হল সে কি আর আমাদের অজানা? তাই আমাদের সবার প্রিয় চামেলীদির প্রতি আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ্যতে এ ক্ষতির কথা ছাড়লেও আমার মত এমন অনেক আছেন যাদের ব্যক্তিগত ক্ষতির হিসেবে হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাবেন।
আরও একটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করে পারছি না।
বড় অনুষ্ঠানে সবাই নিজেকে উজাড় করে দেয়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত যারা শিল্পী তাদের কাছে ছোট বড় সব অনুষ্ঠানই হৃদয়ের খুব কাছের থাকে। চামেলীদির সঙ্গে ছোট একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে দেখেছিলাম রিহার্সাল থেকে শুরু করে মূল অনুষ্ঠান সবটাতেই নিজেকে উজাড় করে দিতে। ছোট অনুষ্ঠান বলে এতটুকু অবহেলা নেই!
আমাদের সবার ভেতরেই একটা শিশু সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সময় সুযোগে সে শিশু বেরিয়ে আসে। চামেলীদির ভেতরের সেই শিশুটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল দু তিনবার। সৌভাগ্য তো বটেই, কারণ এর পরের কার্যকলাপগুলো আমাদের এক রাশ আনন্দ উপহার দিত প্রতিবার। ছবিদির বাড়িতে সাহিত্যবাসরের পর আরও একটা আসর থাকত যেটাতে আমাদের কজনের অন্তরঙ্গ আলোচনায় সময়ের হিসেব থাকত না।তাছাড়া কত অলস দুপুর আর পড়ন্ত বিকেল আমাদের এই আড্ডার সাক্ষী ছিল। চামেলীদির এই শিশুসুলভ দিকটি আমাকে খুব আকৃষ্ট করত, এত বড় শিল্পী, এত গুণ, এত কাজ করার পরেও মনটা এত সরল। নিসন্দেহে শিক্ষনীয়।
আমরা সবাই, জীবনের রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে চলেছি। কিন্তু নাটক-অন্ত-প্রাণ চামেলীদির জীবনটাও রঙ্গমঞ্চ আবার রঙ্গমঞ্চটাও জীবন-সব একাকার। যতই ভালো অভিনয় করুন প্রকৃতির নিয়ম মেনে ৭৯ বছর বয়সে চামেলীদিকে বিদায় নিতে হয়েছে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে।একে একে চলে যাচ্ছেন অনেকেই।আগেই চলে গেছিলেন ছবিদি, এবারে চামেলীদি। আবদারের জায়গাগুলো শূণ্য হচ্ছে। বুকে পাথর রেখে মেনে নিতে হচ্ছে কঠিন বাস্তবকে।
আজ সবকিছু স্মৃতির ঘরে বন্দী। ওইসব দিনগুলোও আর ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না তুমিও চামেলীদি। কিন্তু বেঁচে আছো এবং থাকবে আমাদের হৃদয়ে, আমাদের ভালোবাসায়।
Comments are closed.