Also read in

আসামের বাঙালিদের সামনে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা

সমস্যাটা নামকরণ থেকেও বটে। অনেকের ধারণা, আসামে যাঁরা বাস করেন তাঁরা অসমিয়া, আসামের ভাষা অসমিয়া। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। আসামে অসমিয়ারা তো থাকবেন, তাঁদের ভাষাও থাকবে – এতে কোনো দ্বিমত থাকার কথাই নেই। তবে কি আর কেউ এখানে থাকতে পারে না, অন্য কোনো নৃ বা ভাষিক গোষ্ঠী কি এখানে কদাপি বাস করেনি বা ভবিষ্যতে বাস করবে না? ওখানে বাঙালি ছাড়া আর কারও অস্তিত্বের বৈধতা কি নেই বা থাকতে পারে না? বিহার, পাঞ্জাব, ওড়িশা ইত্যাদি নামবাচক রাজ্যে তো বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ বৈধ নাগরিক হিসেবেই বসবাস করছেন। আর উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ড – এ সব রাজ্যের প্রধান ভাষিকগোষ্ঠী কি বিপন্ন? আমাদের প্রতিবেশী স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। ও দেশে যদিও একক ভাবে বাংলা ভাষার অধিষ্ঠান, তবুও অপরাপর ভাষিক এবং নৃগোষ্ঠীর সংস্থান তো রয়েছে। মণিপুরি, চাকমা, মার, রাজবংশী, হিন্দিভাষী, চা-জনজাতির ভাষার প্রচলন তো রয়েছে ওখানে। ওদের নিজস্ব সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমার সৃজনশীল ধারাও অব্যাহত রয়েছে, গণমাধ্যমে সীমিত হলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠানের সংস্থান রয়েছে। বিভিন্ন জনজাতির ভাষা, লোকসংস্কৃতি এবং সংগীতের চর্চা বাংলাদেশে অব্যাহত রয়েছে, রেডিও-টিভিতে ওদের ভাষার সংস্থান রয়েছে। চা-জনজাতির ভাষায় বাংলাদেশের রেডিও-নাটক শোনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। অসংখ্য তথ্যচিত্রে দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি জনজাতির জীবনচিত্রও প্রতিফলিত হয়। পাঠকরা তনবির মোকাম্মেলের ছবিগুলো দেখতে পারেন। আর পশ্চিমবাংলায় তো হিন্দি, উর্দু, নেপালি, চা-জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রচলিত। রেডিওর নব ঘোরালে অলচিকি ভাষাও শুনতে পারেন। নেপালি, উর্দু সংবাদ তো রেডিও-টিভি, উভয় মাধ্যমেই প্রচারিত হয়।

এ থেকে এটাই স্পষ্ট, বাংলার মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে যেমন অপরাপর ভাষিক এবং নৃগোষ্ঠীর সংস্থান হতেই পারে, তেমনি ভিন্নতর প্রাদেশিক ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার অবস্থানও স্বাভাবিক। আসামে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার অবস্থান কোনো অস্বাভাবিক, অনৈতিহাসিক ব্যাপারও নয়। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন যাবৎ একটা বিপরীত চিন্তা প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে – ‘আসাম কেবল অসমিয়াদের জন্য, আসামের একমাত্র ভাষা অসমিয়া’ ইত্যাদি, এবং পরবর্তীতে দাবি আরও এগিয়ে এল, ‘আসামে অসমিয়াদের জন্য একশো শতাংশ অধিকার চাই’; আর সর্বশেষ প্রবণতা, আসামে বসবাসরত বাঙালিরা সন্দেহজনক বাংলাদেশি, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, এদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণসাপেক্ষ।

এর বিপরীত চিন্তা যাঁরা করছেন তাঁদের কন্ঠস্বর উগ্র ভাষা-সম্প্রসারণবাদীদের হৈ-হট্টগোলে চাপা পড়ে গিয়েছে। বরাক উপত্যকায় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলেও রাজ্য বিধানসভা বা কেন্দ্রীয় সংসদে তা পৌঁছে দেওয়ার কেঊ নেই। একতরফা প্রচারের মাধ্যমে সারা দেশকে এটাই শোনানো হচ্ছে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। উত্তর ভারত, মধ্য ভারত, দক্ষিণ ভারত এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও একাংশ মানুষের মনে ধারণাটা বদ্ধমূল হতে চলেছে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আসামের জনবিন্যাস পালটে দিয়েছে, আসামে বাঙালিদের প্রবল দাপটে নাগা, মণিপুরি, খাসি এবং অরুণাচলিরা আলাদা রাজ্য বানিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছেন; আর যাঁরা রয়েছেন এঁদের মধ্যে বড়ো জনগোষ্ঠীও স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ার কথা ভাবছেন, কারবি-ডিমাসাদের মধ্যেও অসন্তোষ দানা বাঁধছে।

আসামে বাঙালিদের কোনো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল নেই। দু’একটি জেলাভিত্তিক সংবাদপত্র ছাড়া নিজেদের কথা বলার কোনো মাধ্যম নেই, কথায় কথায় দিল্লি গিয়ে নিজেদের কথা সরবে ঘোষণা করার সঙ্গতি নেই। সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিরা নিজেদের কথা রাজ্য স্তরের নেতাদের কাছেই পৌঁছে দিতে পারেন না, দিল্লি তো দূর।

Comments are closed.