Also read in

করোনা-কাউন্টডাউন - ডে-১: "তা হলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে আমার মায়ের প্রেশারের ওষুধ"

” শোন, প্রেশারের ওষুধ মাত্র দুই স্ট্রিপ আনিয়েছি। দশদিনের। এলজোলামও ওইরকম। একুশ দিন বন্ধ থাকলে, আমার ওষুধ কী হবে!”

টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ তখনও চলছে, মোবাইলে মায়ের গলা এল গুয়াহাটি থেকে। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি, বরফের একটা টুকরো আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে নামছে। আমার তিরাশি বছরের বৃদ্ধা শয্যাশায়ী মা, সদ্য বিধবা দিদি আর অবিবাহিতা ভাগ্নি গুয়াহাটির ফ্ল্যাটে কার্যত একা। নতুন আবাসন, আর শুধু একঘর পরিবার এসেছে সবে। আর যা পরিস্থিতি, কে দাঁড়াবে কার পাশে! টিভিতে দেখেছি প্যানিক বায়িং-এর অবিশ্বাস্য দৃশ্য। শোনা যাচ্ছে, লকডাউন না মানলে কারফিউ ঘোষণা করবে। পারবে আমার ভাগ্নি আমার মায়ের ওষুধ কিনে আনতে? শুধু ওষুধ তো নয়, আরও কত কী লাগে রোজকার জীবনে। কী হবে তা হলে?

বড় অসহায় লাগে আমার। তবু মায়ের কাছে লুকিয়ে রাখি আমার এই অসহায়বোধ। জোর করে গলায় কনফিডেন্স আনি৷ বলি, “এত টেনশন করো না তো, দেখো গভর্নমেন্ট ঠিক কিছু ব্যবস্থা করবে।”
নিজের কানেই নিজের অভিনয় ধরা পড়ে যাচ্ছে, আমি বুঝি।বড় ঠুনকো, ফাঁকা লাগে এই আশ্বাস বাণী।

সত্যি, এই মুহূর্তে আমরা কেউ জানি না, আগামিকাল ঠিক কী হবে। কী হতে পারে। দেখা তো দূর, এত বড় বিপর্যয় এই প্রজন্ম দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। চিন, ইতালি হয়ে ত্রাস যতই সারা বিশ্বে যত দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, আমাদের মনে এই বিশ্বাস কাজ করছিল যে, না আর যাই হোক, আমাদের দেশের কিছু হবে না। গত ক’দিনে এই বিশ্বাসটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ছে। এত দ্রুত এই ভাঙন পর্ব যে আমরা খেই হারিয়ে ফেলছি। আর যত খেই হারাচ্ছি, ততই অনিশ্চয়তার চোরাবালিতে যেন তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের যাবতীয় বোধ। টিভিতে একের পর এক ধেয়ে আসছে ধ্বংসের সব ব্রেকিং নিউজ। মৃত্যুর স্টাটিসস্টিক্স। রাষ্ট্রনেতারা কার্যত আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়ে রাখছেন। নিজেদের চোখের সামনে আমরা নিজেদের চিতা সাজানোর আয়োজন দেখতে পাচ্ছি।

গতকাল সন্ধেতে আমাদের চারতলা আবাসনের ছাদে টাইমপাস গুলতানি চলছিল। মায়ের ওই অসহায় ফোন আমার ভিতটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আড্ডা থেকে সরে এসে আমি ছাদের কোমর-উঁচু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াই। নির্মেঘ আকাশ, ছাদে বেশ ফুরফুরে বাতাস। এটা বসন্ত না? ঋতুরাজ বসন্ত! বসন্তের এই মৃদুমন্দ বাতাস নিয়ে কত রোমান্টিকতা। অথচ এই বাতাসেই কি ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যুবীজ?
ছাদে গোল করে চেয়ার পেতে গল্প করছি আমরা। লকডাউন ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। চারপাশের স্তব্ধতা চিরে চলে যাচ্ছে ভয়-ছড়ানো সাইরেন। শুনলাম, রবিবার বিকেলের সেই থালি-করতালি-করতালের তুমুল আওয়াজকে না কি রেকর্ড করে রাখা হয়েছে, প্রশাসন সেটাই বাজাচ্ছে। হয়তো ত্রস্ত মানুষকে এ ভাবে খানিকটা ভরসা জোগানো যাবে বলে ভাবছেন তাঁরা। সারা দেশ জুড়ে ওই শঙ্খধ্বনি আর করতালি বাম্পার হিট। ফেসবুকে টিটকারির পাশাপাশি অনেকেই লিখেছেন, ওইভাবে করতালি বাজিয়ে এক অনাস্বাদিত তৃপ্তি পেয়েছেন তাঁরা। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনেও যে এক অনাবিল আনন্দ থাকে, জাগতিক সব সম্ভারে তা ধামাচাপা পড়ে থাকে।

লক্ষ্য করি, ছাদে আমরা বসে আছি, খুব সচেতনভাবেই নিজেদের মধ্যে একটা দূরত্ব বজায় রাখছি। কেউ কি খুকখুক কাশলো, কানও সতর্ক। সোশাল মিডিয়া আমাদের এক ভার্চুয়াল বিশ্বে নিয়ে গেছে সেই কবেই। ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে বিছানায় শোয়া, সব কিছুই উইশে মোড়া। আমরা এক ভ্রান্ত ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা একে অন্যের সঙ্গে সামাজিক ভাবে যুক্ত। এক ভার্চুয়াল সমাজে আমরা একে অপরের সুনাগরিক, যাঁরা আমার ডলুর রিসোর্টে লাঞ্চের সেলফিতে লাইকি পাঠান।
কিন্তু বাস্তবে?

এই সংকটের সময় সোশাল ডিস্টেন্স-এর কথা বলা হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে, একমাত্র সামাজিক দূরত্বই মানব প্রজাতিকে রক্ষা করতে পারে। আর আমরা? লকডাউনের দুঃসহ প্রহরে মানুষের সাহচর্য চাইছি। সাবধানতার যাবতীয় দূরত্ব বজায় রেখেও আমরা মানুষের সংস্পর্শ চাইছি। চাইছি, কেউ আসুক আমার বাড়ি। যেমন আমার ছোটবেলায় বাবার বন্ধুরা, মায়ের লতা-পাতায় সম্পর্কের কোন দিদি। আমরা আজ অতিথির প্রতীক্ষায়। কিন্তু আমরা জানি যে সামাজিক লকডাউন আমরাই কায়েম করে রেখেছি, তা ডিঙিয়ে অতিথি আর আসবে না।

অদৃশ্য ওই মৃত্যুবীজ কি আমাদের ওই সোশাল ডিস্টান্সিঙের সংজ্ঞা ও পরিধি পালটে দেবে?

আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে বাঙ্কের এক অফিসার ভাড়া থাকেন। ফ্যামিলি থাকে শিলং। আমাদের সঙ্গে ওই হাই- হ্যালো সম্পর্ক। আজ সকালে কী ভেবে যেন আমি ওই ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটের কড়া নাড়ি। জিজ্ঞেস করি, বাজার-টাজার আছে তো? রান্নার মাসি না এলে সোজা চলে আসবেন। ভদ্রলোক বিস্ময় কাটিয়ে শুধু বলেন, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।

লকডাউনের মাত্র একটা দিন কাটলো। সামনে বিশাল অজগরের মত দুঃসহ অলস আরও কুড়িটি দিন। এই কুড়ি দিনেও গুমোট
বাতাসে বসন্তের দোলা লাগবে, কী নিশ্চয়তা। যদি লকডাউন এক্সটেন্ড করতে হয়? তা হলে? তা হলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে আমার মায়ের প্রেশারের ওষুধ?

আচ্ছা, পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোককে একবার জিজ্ঞেস করবো?!

এই প্রবন্ধের লেখক অরিজিৎ আদিত্য একজন খ্যাতনামা লেখক

Comments are closed.